ইসরায়েলকে মোকাবিলায় উপসাগরীয় দেশগুলোর আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কতটা শক্তিশালী
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের (জিসিসি) যৌথ প্রতিরক্ষা পরিষদ গত বৃহস্পতিবার কাতারের রাজধানী দোহায় জরুরি বৈঠক করেছে। এর উদ্দেশ্য ছিল কাতারে ইসরায়েলের হামলার পর এ অঞ্চলের জরুরি নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা করা। সম্প্রতি দোহায় হামাসের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে ছয়জন নিহত হন।
জিসিসির মহাসচিব জাসেম মোহাম্মদ আল-বুদাইউই বলেন, কাতারের ওপর এ হামলাকে সব জিসিসি সদস্যদেশের ওপর হামলা হিসেবে দেখা যেতে পারে।
আল–বুদাইউই জানান, সদস্যদেশগুলো যৌথ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় করবে, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময় জোরদার করবে, আকাশ প্রতিরক্ষায় সমন্বয় করবে, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধে আগাম সতর্কতামূলক বার্তাব্যবস্থা চালু করবে ও যৌথ মহড়া চালাবে। এর মধ্যে একটি আঞ্চলিক বিমানবাহিনী মহড়াও অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
এ বছর শুরু হওয়ার পর থেকে কাতার হলো সপ্তম দেশ, যেখানে ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়েছে।
জিসিসিভুক্ত দেশ কারা, সামরিক খরচ কত
গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি) একটি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জোট। এটি ১৯৮১ সালে গঠিত হয়। এর সদস্য আরব উপদ্বীপের ছয় দেশ—বাহরাইন, কুয়েত, ওমান, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)।
জিসিসি মূলত নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে সহযোগিতা বাড়াতে গঠিত হয়েছিল। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নানা বিষয়ে এ জোট প্রায়ই একসঙ্গে অবস্থান নেয়।
গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মিলিটারি ব্যালান্স ২০২৪ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে জিসিসি দেশগুলো সম্মিলিতভাবে ১১৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন (১১ হাজার ৪৫০ কোটি) ডলার সামরিক খাতে ব্যয় করেছে। এর মধ্যে সৌদি আরবের ব্যয় সবচেয়ে বেশি—কমপক্ষে ৬৯ বিলিয়ন (৬ হাজার ৯০০ কোটি) ডলার। সামরিক ব্যয়ের দিক থেকে বিশ্বে সপ্তম স্থানে রয়েছে দেশটি।
এরপর রয়েছে ইউএই (২০ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার), কাতার (৯ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার), কুয়েত (৭ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার), ওমান (৬ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার) ও বাহরাইন (১ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলার)।
মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি কোথায়
যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে তার সামরিক ঘাঁটি পরিচালনা করে আসছে। কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশনসের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তত ১৯টি স্থায়ী ও অস্থায়ী ঘাঁটি রয়েছে।
ঘাঁটিগুলোর মধ্যে স্থায়ী আটটি আছে জিসিসির পাঁচটি দেশ—বাহরাইন, কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। এ ছাড়া মিসর, ইরাক ও জর্ডানেও ঘাঁটি রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র–কাতার কৌশলগত সম্পর্ক
১৯৯৬ সালে কাতারে আল উদেইদ বিমানঘাঁটি স্থাপন করা হয়। এটি মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। ২৪ হেক্টর (৬০ একর) জায়গাজুড়ে থাকা এ ঘাঁটিতে প্রায় ১০০টি বিমান ও ড্রোন মোতায়েন আছে। প্রায় ১০ হাজার সেনাও অবস্থান করছেন এখানে।
এ ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) অগ্রবর্তী সদর দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং ইরাক, সিরিয়া ও আফগানিস্তানে সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
সম্প্রতি দোহায় ইসরায়েলের হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও কাতার সফরে যান। এর এক দিন আগে তিনি ইসরায়েলে বৈঠক করেছিলেন।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি এ সফরের সময় বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁদের কৌশলগত সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘আমরা আমাদের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অঙ্গীকারবদ্ধ এবং এমন হামলার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ব্যবস্থা নেব।’
সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তি
গত বুধবার রাতে সৌদি আরব পারমাণবিক অস্ত্রধারী পাকিস্তানের সঙ্গে একটি ‘কৌশলগত পারস্পরিক প্রতিরক্ষা চুক্তি (এসএমডিএ)’ স্বাক্ষর করেছে।
চুক্তিতে বলা হয়েছে, যেকোনো একটি দেশের ওপর আগ্রাসনকে অপর দেশের ওপর আগ্রাসন হিসেবে ধরা হবে।
এ চুক্তি এমন এক সময় করা হলো, যখন হামলার পর কাতারের পাশে সংহতি জানাতে আরব লিগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) প্রায় ৬০টি সদস্যরাষ্ট্র দোহায় সমবেত হয়েছিল।
উপসাগরীয় দেশগুলোর বিমান প্রতিরক্ষাব্যবস্থা
জিসিসির ছয় দেশ নিজেদের জন্য স্তরভিত্তিক আকাশ প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া ও চীনের তৈরি নানা ধরনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা রয়েছে।
এগুলোর মধ্যে রয়েছে দীর্ঘ, মাঝারি ও স্বল্পপাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। দীর্ঘপাল্লা ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) বা এর বেশি দূরের হুমকি ঠেকায়, মাঝারি পাল্লা ৩০ থেকে ১০০ কিলোমিটার (১৯ থেকে ৬২ মাইল) ও স্বল্পপাল্লা ১ থেকে ৩০ কিলোমিটারের (শূন্য দশমিক ৬ থেকে ১৯ মাইল) মধ্যে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করে।
সৌদি আরব
উপসাগরীয় অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সৌদি আরবের। এ ব্যবস্থায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি থাড সিস্টেম ও দীর্ঘপাল্লার প্যাট্রিয়ট পিএসি-৩ ক্ষেপণাস্ত্র। এ ছাড়া রয়েছে মাঝারি পাল্লার আই-হক, স্বল্পপাল্লার ফরাসি ক্রোটাল, শাহিন ও মিকা ক্ষেপণাস্ত্র। আরও আছে অসংখ্য পয়েন্ট ডিফেন্স লঞ্চার, যেমন স্টিঙ্গার, অ্যাভেঞ্জার, মিস্ত্রাল ও এমপিসিভি।
প্রতিরক্ষাব্যবস্থার সহায়ক হিসেবে রয়েছে বিভিন্ন দেশ, যেমন যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ভালকান, সুইস/জার্মান ওয়েরলিকন ও সুইডিশ বোফর্স এল/৭০ কামান।
সৌদি আরব একমাত্র জিসিসি দেশ, যাদের কাছে চীনের তৈরি সাইলেন্ট হান্টার লেজার সিস্টেম আছে। এটি নিচুতে উড়তে থাকা ড্রোন এবং অন্যান্য হুমকি শনাক্ত ও ধ্বংস করতে পারে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই)
ইউএইর হাতে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের থাড ও প্যাট্রিয়ট সিস্টেম। পাশাপাশি ইসরায়েলের তৈরি বারাক প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। মাঝারি পাল্লার জন্য রয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার চেওংউং ২। স্বল্পপাল্লার প্রতিরক্ষায় আছে ফরাসি ক্রোটাল ও মিস্ত্রাল, রুশ ইগলা ও প্যানসির-এস১, সুইডিশ আরবিএস-৭০ ও ব্রিটিশ র্যাপিয়ার। এগুলোকে সহায়তা করে ইউরোপীয় বিমানবিধ্বংসী কামান।
সৌদি আরব ও আরব আমিরাত জিসিসির দুই দেশ, যাদের হাতে থাড (টার্মিনাল হাই অলটিচিউড এরিয়া ডিফেন্স) সিস্টেম আছে। এটি তাদের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের হুমকির বিরুদ্ধে উন্নত ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ক্ষমতা প্রদান করে।
কাতার
কাতারের দীর্ঘ ও মাঝারি পাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট সিস্টেম ও নাসামস-৩। স্বল্পপাল্লার জন্য রয়েছে রুশ ইগলা, মার্কিন স্টিঙ্গার, চীনা এফএন-৬ ও ফরাসি মিস্ত্রাল ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোকে সহায়তা করে জার্মানির তৈরি গেপার্ড ও স্কাইনেক্স বিমানবিধ্বংসী কামান।
কুয়েত
কুয়েতের দূরপাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্যাট্রিয়ট পিএসি-৩। স্বল্পপাল্লার জন্য আছে ইতালির আসপিদে ক্ষেপণাস্ত্র ও স্কাইগার্ড ব্যবস্থা, স্টিঙ্গার, স্টারবার্স্ট ও এফআইএম-৯২ ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোর সঙ্গে রয়েছে জার্মান ওয়েরলিকন জিডিএফ কামান।
বাহরাইন
বাহরাইন সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যাট্রিয়ট পিএসি-৩ এমএসই ব্যবস্থা কিনেছে। ফলে সৌদি আরব, ইউএই, কাতার ও কুয়েতের পর তারাও দীর্ঘপাল্লার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা অর্জন করেছে।
মাঝারি ও স্বল্পপাল্লায় বাহরাইন নির্ভর করে যুক্তরাষ্ট্রের আই-হক ও ফরাসি ক্রোটালের ওপর। এ ছাড়া রয়েছে রুশ ইগলা, মার্কিন স্টিঙ্গার, সুইডিশ আরবিএস-৭০ পয়েন্ট ডিফেন্স ক্ষেপণাস্ত্র ও ওয়েরলিকন বিমানবিধ্বংসী কামান।
ওমান
উপসাগরীয় অন্যান্য দেশের তুলনায় ওমানের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা খানিকটা দুর্বল। দেশটির স্বল্পপাল্লার প্রতিরক্ষাব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে নরওয়ে ও যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি নাসামস, ফরাসি মিস্ত্রাল, মার্কিন জ্যাভলিন ও রুশ স্ট্রেলা-২ ক্ষেপণাস্ত্র। এগুলোকে সহায়তা করে রুশ, সুইস ও সুইডিশ কামান।
![]() |
| একটি থাড আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। ছবি: রয়টার্স |

No comments