যুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান–চীনের ‘ত্রিভূজ প্রেম’: মিলনবিন্দু নাকি সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র by মুহাম্মদ আমির রানা

গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ খনিজ খাতে ৫০ কোটি ডলারের ঐতিহাসিক বিনিয়োগের ঘোষণা দেয়। একই সময়ে ওয়াশিংটন পাকিস্তানকে বিধ্বংসী বন্যার কারণে জরুরি সহায়তাও প্রদান করে। এটি একটি উদ্যোগ, যা অনেককে বিস্মিত করেছে, বিশেষ করে এমন সময়ে, যখন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অন্যত্র মানবিক প্রতিশ্রুতি কমিয়ে দিচ্ছে। এ সাহায্য প্যাকেজটি পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের অতীতের উষ্ণ মুহূর্তগুলোর স্মৃতি ফিরিয়ে আনে; আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসনের সময় থেকে শুরু করে ৯/১১-পরবর্তী সময় পর্যন্ত, যখন ইসলামাবাদ যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানের কেন্দ্রীয় অংশীদার হয়ে ওঠে।

সাম্প্রতিক সময়ে এ পদক্ষেপগুলো ইঙ্গিত দেয় যে পরীক্ষিত এ সম্পর্কটি অন্তত নিকট ভবিষ্যতে স্থিতিশীল থাকবে। তবে বড় প্রশ্ন হলো, পাকিস্তান কি এ সম্পর্ককে আরও টেকসই কিছুতে রূপ দিতে পারবে? অর্থনৈতিক সংযোগ একটি দিক হতে পারে। তবে আসল পরীক্ষা হবে ইসলামাবাদ ও ওয়াশিংটন এমন ভূরাজনৈতিক উদ্দেশ্য তৈরি করতে পারে কি না, যা দীর্ঘস্থায়ী।

ইতিহাস দেখায়, এমন সমন্বয় গড়ে তুলতে কয়েক দশক সময় লাগে এবং তা ধরে রাখা আরও কঠিন। পাকিস্তানের চেয়ে এটি আর কেউ ভালো বোঝে না। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে বহুবার উত্থান-পতন দেখেছে। আজ ভারতও ওয়াশিংটনের কৌশলগত হিসাবের সঙ্গে নিজের প্রত্যাশার ভারসাম্য রাখতে একই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে।

পাকিস্তানের জন্য অভ্যন্তরীণ শক্তিই প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার সবচেয়ে নির্ধারক উপাদান। আশাবাদীরা বলতে পারেন যে ইসলামাবাদ অবশেষে এসব অগ্রাধিকারের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে, যদিও প্রমাণ এখনো দুর্বল। লক্ষণীয় হলো, দুর্বল অর্থনীতি, ক্ষতিগ্রস্ত বৈশ্বিক ভাবমূর্তি, ভঙ্গুর নিরাপত্তা ও হতাশাজনক সামাজিক সূচক থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তান আশ্চর্যজনকভাবে এক অশান্ত আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে। এর অনেকটাই ইসলামাবাদের নিজস্ব কৌশলের ফল নয়—বরং বহিরাগত ধাক্কা—ইউক্রেন যুদ্ধ, গাজা সংঘাত ও যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে হয়েছে।

এসব ঘটনায় তৈরি হওয়া ঢেউ পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তবে সম্প্রতি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যখন কাতারে হামাসের ওপর ইসরায়েলের আক্রমণকে পাকিস্তানে ওসামা বিন লাদেনকে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের সঙ্গে তুলনা করলেন, সেটি ছিল বিপজ্জনক ও অপছন্দনীয় একটি তুলনা।
পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর একটি ছিল মে মাসে ভারতের সঙ্গে

অচলাবস্থা দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেওয়া, যা আঞ্চলিক ভারসাম্য নষ্ট করতে পারত। যদিও ভারত এখনো পুনর্বিন্যাস করছে। এটি প্রমাণ করে যে সীমিত কিন্তু সঠিক পদক্ষেপ পাকিস্তানের জন্য কিছুটা সুযোগ তৈরি করতে পারে। তবে এ সুযোগকে দীর্ঘমেয়াদি সুবিধায় রূপান্তর করা নির্ভর করবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ দৃঢ়তা ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য নির্ধারণের ওপর, বড় শক্তিগুলোর উদারতার ওপর নয়।

এমন প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের শীর্ষ নেতৃত্ব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ৫০ কোটি ডলারের খনিজ চুক্তি স্বাক্ষরের সময় একসঙ্গে উপস্থিত ছিল—এমন একটি দৃশ্য চীনের কাছে জটিল বার্তা বয়ে এনেছে। বেইজিং ইতিমধ্যেই সিপিইসি ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার মাধ্যমে পাকিস্তানে প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সম্প্রতি চীন সফরে পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী আরও ৮ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন। তাহলে প্রশ্ন ওঠে, যখন চীন অনেক বড় অঙ্কে বিনিয়োগ করছে, তখন ইসলামাবাদ কেন তুলনামূলকভাবে ছোট একটি মার্কিন বিনিয়োগ নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত?

বিশ্লেষকদের মতে, এটি একদিকে পাকিস্তানের পশ্চিমমুখী ঝোঁকের ইঙ্গিত হতে পারে, অন্যদিকে আঞ্চলিক ভারসাম্য তৈরির কৌশলও হতে পারে। তবে পাকিস্তানি নেতৃত্ব মনে করে, এটি মূলত বিশেষ বিনিয়োগ সহায়তা কাউন্সিলের সাফল্য, যা বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য গঠিত হয়েছিল।

তবে বাস্তবতা কঠিন। বিদেশি বিনিয়োগ টেকসইভাবে আকর্ষণ করতে হলে পাকিস্তানকে প্রথমে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও নিরাপত্তাসংকট কাটিয়ে উঠতে হবে। নিরাপত্তা ইস্যুটি, বিশেষ করে চীনা বিনিয়োগকারীদের জন্য বড় উদ্বেগের বিষয়। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং নিজেই পাকিস্তানে কর্মরত চীনা নাগরিকদের নিরাপত্তার গুরুত্বের ওপর জোর দিয়েছেন। একই খাতে মার্কিন বিনিয়োগ এলে চীনের সঙ্গে সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে। তবে উল্টো দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা পাকিস্তানের নিরাপত্তাসংকট মোকাবিলায়ও সহায়ক হতে পারে।

ওয়াশিংটন ইতোমধ্যেই বেলুচিস্তান লিবারেশন আর্মির মজিদ ব্রিগেডকে নিষিদ্ধ করেছে, যা বেলুচ বিদ্রোহীদের ওপর চাপ বাড়াবে। তবে এর ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করবে আফগানিস্তানের ভূমিকায়, যেখানে চীন কাবুলের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করছে এবং যুক্তরাষ্ট্র শাস্তিমূলক অবস্থান নিচ্ছে। এদিকে তালেবান নিজেরা আন্তর্জাতিক চাপ উপেক্ষা করে স্থায়ী শাসনের দাবিতে এগোচ্ছে, যা পাকিস্তানের জন্য সরাসরি হুমকি।

এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানে মার্কিন বিনিয়োগ শুধু অর্থনৈতিক নয়, ভূরাজনৈতিক দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। দুই বৃহৎ শক্তি যখন একই সঙ্গে পাকিস্তানের নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জে জড়িত হয়, তখন তা ভবিষ্যতের কূটনৈতিক ভারসাম্যের দিক নির্ধারণ করবে; এটি একটি মিলনবিন্দু হবে, নাকি সংঘাতের ক্ষেত্র, সেটাই এখন মূল প্রশ্ন।

* মুহাম্মদ আমির রানা, নিরাপত্তাবিশ্লেষক
- ডন অনলাইন থেকে নেওয়া
- ইংরেজি থেকে অনুবাদ

যুক্তরাষ্ট্র–পাকিস্তান–চীনের ‘ত্রিভূজ প্রেম’: মিলনবিন্দু নাকি সংঘাতের নতুন ক্ষেত্র

No comments

Powered by Blogger.