১০৮ বছর পর ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দিলো বৃটেন, বালফোর ঘোষণা পরবর্তী ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত by মাযিয়ার মোটামেদি ও ফেদেরিকা মারসি

বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ের স্টারমার ঘোষণা করেছেন, যুক্তরাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। বালফোর ঘোষণা দিয়ে ফিলিস্তিনে ইহুদি জাতির জন্য ‘একটি জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার সমর্থন জানানোর ১০৮ বছর পর এবং বৃটিশ ম্যান্ডেটাধীন ফিলিস্তিনে ইসরাইল রাষ্ট্র সৃষ্টির ৭৭ বছর পরে এমন স্বীকৃতি দিলো বৃটেন। স্টারমার এক ভিডিও বার্তায় রবিবার বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমবর্ধমান ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে আমরা এমন এক পদক্ষেপ নিচ্ছি যা শান্তি ও দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনাকে জীবিত রাখবে।

যুক্তরাজ্যের অবস্থান পরিবর্তন: জুলাই মাসে বৃটিশ সরকার জানায়, তারা বহুদিনের নীতি থেকে সরে আসছে। সেই নীতিতে বলা হয়েছিল ‘সবচেয়ে প্রভাবশালী মুহূর্তে’ স্বীকৃতি দেয়া হবে। কিন্তু শর্ত ছিল- ইসরাইলকে গাজায় গণহত্যা বন্ধ করতে হবে, একটি টেকসই শান্তি প্রক্রিয়ায় অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে এবং অবরুদ্ধ উপত্যকায় আরও বেশি ত্রাণ প্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। এরপরও গাজায় পরিস্থিতি আরও বিপর্যয়কর আকার ধারণ করে। ইসরাইলি সেনারা গাজা নগরী ধ্বংস করে দখল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। পাশাপাশি ক্ষুধার্ত ও বাস্তুচ্যুত জনগণকে অনাহারে রাখছে। পশ্চিম তীরেও প্রতিদিন ইসরাইলি সেনা অভিযান এবং বসতি স্থাপনকারীদের হামলা চলছে। একইসাথে ইসরাইল পশ্চিম তীর দখল ও পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি যুক্ত ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে ‘দাফন’ করতে চাইছে।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ঢেউ: এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও পর্তুগালও ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের (ইউএনজিএ) ৮০তম অধিবেশন শুরু হওয়ার দু’দিন আগে এ ঘোষণা আসে, যেখানে ইসরাইলের দশকব্যাপী দখল ও বর্ণবৈষম্যের পর ফিলিস্তিনি সার্বভৌমত্ব বড় আলোচ্য বিষয় হবে।

বৃটিশ নেতাদের বক্তব্য:
স্টারমার জানিয়েছেন, হামাস নেতৃত্বের সিনিয়র ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, হামাসের কোনো ভূমিকা ভবিষ্যতের ফিলিস্তিনে থাকবে না। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভেট কুপার বলেন, এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আমাদের অবিচল দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান প্রতিশ্রুতিকে প্রতিফলিত করছে এবং ফিলিস্তিনি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অবিচ্ছেদ্য অধিকারকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। ডেপুটি প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি সতর্ক করে বলেন, স্বীকৃতি দেয়ার অর্থ এই নয় যে রাতারাতি ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে। তিনি বলেন, আমরা এই পদক্ষেপ নিচ্ছি কারণ আমরা চাই দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের সম্ভাবনা টিকে থাকুক।

ফিলিস্তিনের প্রতিক্রিয়া: ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারসেন আঘাবেকিয়ান শাহিন বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা। সবচেয়ে বড় কথা, এটি ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য আশা- একটি স্বাধীন, সার্বভৌম রাষ্ট্রের আশা। এটি একইসাথে প্রমাণ করে যে ইসরাইলের আমাদের ভূমিতে কোনো সার্বভৌমত্ব নেই। তিনি আরও বলেন, ইসরাইল মানবতার অস্তিত্বের ওপর পরিকল্পিত আঘাত চালাচ্ছে, যাতে ফিলিস্তিনি জনগণ, তাদের সংস্কৃতি ও ভবিষ্যৎ মুছে ফেলা যায়। বৃটেনের সংসদে প্রথম ফিলিস্তিনি বংশোদ্ভূত প্রতিনিধি লায়লা মোরান বলেন, দশকের পর দশক ধরে চলে আসা এক অবিচারের সংশোধন হলো রোববার। তবে তিনি এটিকে যাত্রার শুরু মাত্র বলে উল্লেখ করেন এবং যোগ করেন, আমাদের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে একটি গণহত্যা ঘটতে হয়েছে, যা হওয়া উচিত ছিল না।

ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া: ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এই স্বীকৃতিকে হামাসের জন্য একটি ‘পুরস্কার’ আখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, এটি ঘটবে না। (অর্থাৎ ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পাবে না)। জর্ডান নদীর পশ্চিমে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। উগ্রপন্থি মন্ত্রীরা নেতানিয়াহুকে পশ্চিম তীর দখলের পথে অগ্রসর হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির বলেন, তিনি অবিলম্বে ইসরাইলি সার্বভৌমত্ব প্রয়োগের প্রস্তাব দেবেন। অন্যদিকে ওৎজমা ইয়েহুদিত দলের মন্ত্রী ইসহাক ভাসারলাউফ দাবি করেন, ইসরাইলের ভূমি একচেটিয়াভাবে ইহুদি জাতির। ফিলিস্তিনি জনগণ বলে কিছু নেই, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রও নেই।

আন্তর্জাতিক মঞ্চে চাপ: মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প এই স্বীকৃতির বিরোধিতা করেন এবং জানান এটি তাদের কয়েকটি মতভেদযুক্ত বিষয়ের একটি। আজ সোমবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘে ফ্রান্স ও সৌদি আরব যৌথভাবে একদিনের সম্মেলন আয়োজন করছে। সেখানে দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান অগ্রসর করার পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। বিশ্লেষকরা বলছেন, ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেয়ার এ উদ্যোগ ইসরাইলি উগ্রবাদীদের পশ্চিম তীর দখলের পথে আরও উস্কে দিতে পারে, যদিও আন্তর্জাতিক চাপ ও নিন্দা ক্রমেই বাড়ছে।
(অনলাইন আল জাজিরা থেকে অনুবাদ)

https://mzamin.com/uploads/news/main/181235_bls.webp

No comments

Powered by Blogger.