‘যুদ্ধ’ নয়, ইসরাইল একটি জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করছে: সাবেক সিআইএ কর্মকর্তার নিবন্ধ by পল আর. পিলার
আমি বহু বছর ধরেই যুদ্ধবিরতির আলোচনা নিয়ে ভাবছি। প্রায় ৫০ বছর আগে আমি একটি বই লিখেছিলাম— 'নেগোশিয়েটিং পিস: ওয়ার টার্মিনেশন এজ এ বার্গেইনিং প্রসেস’ যেখানে দেখানো হয়েছিল কীভাবে দুই পক্ষ যুদ্ধের মধ্যেই শান্তি প্রতিষ্ঠার কূটনৈতিক ও সামরিক প্রক্রিয়াগুলো অনুসরণ করে। কিন্তু গাজায় এখন যা ঘটছে তা মূলত কোনো যুদ্ধ নয়—যদিও প্রচলিতভাবে একে ‘যুদ্ধ’ বলা হয়। এটি বরং একটি একতরফা হামলা, যা একটি জনগোষ্ঠী ও তাদের জীবনধারণের উপায়গুলোকে ধ্বংস করছে। এটি এমন এক পরিস্থিতি যেখানে একটি পক্ষ—ইসরাইল—ট্রাম্পের ভাষায় ‘সব কার্ড হাতে রেখেছে।’
গাজা থেকে প্রতিদিনই যে খবর আসছে, তা মূলত ইসরাইলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ও হামাস যোদ্ধাদের মধ্যে সংঘর্ষ নয়। বরং সেগুলো সাধারণত গাজার মানুষের ওপর, বিশেষ করে বেসামরিক জনগণের ওপর, ইসরাইলের চালানো ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের বিবরণ—যা ২০২৩ সালের শেষ ভাগে এই হত্যাযজ্ঞের নতুন পর্যায় শুরু হওয়ার পর থেকে গড়ে প্রতিদিন ১৫০ জন মৃত্যুর হার বজায় রেখেছে। এসব বেসামরিক মানুষদের অনেকে নিহত হচ্ছেন বিমান হামলায়, আবার অনেকেই গুলিবিদ্ধ হচ্ছেন খাবার সংগ্রহের চেষ্টা করার সময়।
গণ-অনাহার এখন গাজার সবচেয়ে বেদনাদায়ক বিপর্যয়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসরাইয়েল আবারও দায় চাপানোর চেষ্টা করছে হামাসের ওপর। ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরেই জাতিসংঘের ত্রাণ সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ বন্ধের পক্ষে যুক্তি দিয়ে আসছে এই অভিযোগ তুলে যে হামাস নাকি সংস্থার বিতরণকৃত খাদ্য চুরি করছিল। ট্রাম্পও এই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করেছেন। তবে ট্রাম্প প্রশাসনের আগে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএইড যে গবেষণা চালায়, তাতে গাজায় মার্কিন ত্রাণ চুরি বা হারিয়ে যাওয়ার যেসব ঘটনা রিপোর্ট হয়েছিল, তার কোথাও হামাসের মাধ্যমে সহায়তা চুরি বা অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার কোনও প্রমাণ মেলেনি। সাম্প্রতিক সংবাদ প্রতিবেদনে এমনকি আইডিএফ নিজেও স্বীকার করেছে, হামাসের ত্রাণ ছিনিয়ে নেয়ার কোনও প্রমাণ তারা পায়নি।
আসলে ইসরাইলের ইউএনআরডব্লিউএ-বিরোধিতা হামাস বা ত্রাণ চুরি নিয়ে নয়। বরং এটা সংস্থাটির মূল পরিচয় নিয়ে—ইউএনআরডব্লিউএ একটি জাতিসংঘ সংস্থা যা সরাসরি ফিলিস্তিনিদের জন্য কাজ করে—যা ফিলিস্তিনিদের ‘একটি জাতি’ হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের অনেকেই নিজভূমি থেকে বিতাড়িত শরণার্থী—এটিই ইসরাইল মেনে নিতে চায় না। যখন ইসরাইল ইউএনআরডব্লিউএ-কে কার্যত সরিয়ে দিতে সফল হয়, তখন গাজার মানবিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে পড়ে। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট এবং ইসরাইলি নিয়ন্ত্রিত ‘বিকল্প’ সহায়তা ব্যবস্থাটি শুধু অপ্রতুল নয়, বরং সেটি পরিকল্পিতভাবে ইসরাইলের জাতিগত নির্মূল অভিযানের অংশ। ত্রাণ বিতরণকে মাত্র কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে সীমাবদ্ধ রাখার উদ্দেশ্য হচ্ছে জীবিত গাজাবাসীদের জোর করে এক ধরনের ঘেরা শিবিরে পাঠানো—যেটিকে ভবিষ্যতে গাজা উপত্যকা থেকে পুরোপুরি বিতাড়নের প্রস্তুতি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
সম্প্রতি কিছু ত্রাণ বিমান থেকে গাজায় ফেলা হয়েছে। কিন্তু এই বিমান থেকে ত্রাণ সরবরাহ পদ্ধতি অত্যন্ত অকার্যকর ও অদক্ষ। সরবরাহের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত, যা প্রকৃত চাহিদার সামান্য অংশও পূরণ করতে পারে না। এতে খরচও অনেক বেশি পড়ে। এমনকি পূর্ববর্তী মার্কিন চেষ্টায় দেখা গেছে, কিছু ত্রাণ সামগ্রী সাগরে পড়ে নষ্ট হয়, আর কিছু আবার ত্রাণ ফেলার সময় মানুষের ওপর পড়ে মৃত্যু ঘটায়। তবুও কিছু দাতার কাছে এটি একটি দৃশ্যত মানবিক কিন্তু কার্যত অকার্যকর ‘অন্তরাত্মা শান্ত রাখার’ কৌশল। ইসরাইলের জন্য এটি আরেক ধাপ এগিয়ে প্রকৃত বাস্তবতা থেকে দৃষ্টি ঘোরানোর উপায়—যে গাজার ভেতরে ত্রাণ পৌঁছাতে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে ইসরাইলের স্থল অবরোধ। এই ধোঁকা রক্ষা করতে গিয়েই ইসরাইলও এখন বিমান থেকে ত্রাণ ফেলা শুরু করেছে। কিন্তু একই সময়ে, তারা স্থলপথে ত্রাণ প্রবেশ কার্যত বন্ধ রেখেছে—ফলে শত শত ত্রাণবাহী ট্রাক নষ্ট হয়ে পড়ে থাকছে বা আইডিএফ সেগুলো ধ্বংস করে দিচ্ছে।
আমার বহু দশক আগের বইয়ে আমি যুদ্ধ সমাপ্তির একটি বিকল্প রূপ চিহ্নিত করেছিলাম—‘বিনাশ/বিতাড়ন।’ এর অর্থ সামরিকভাবে প্রভাবশালী পক্ষটি তার প্রতিপক্ষকে হয় সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয় অথবা বিতাড়ন করে দেয় বিরোধপূর্ণ অঞ্চল থেকে। গাজায় ইসরাইলের উদ্দেশ্যকে ‘বিনাশ/বিতাড়ন’ বলা একেবারে যথার্থ। গাজার ক্ষেত্রে ইসরাইলের কাছে ‘শত্রু’ বলতে পুরো ফিলিস্তিনি জনগণকেই বোঝানো হয়—এই দৃষ্টিভঙ্গি হামাসের ২০২৩ সালের অক্টোবর হামলার আগেই ডানপন্থী ইসরাইলি রাজনীতিতে গেঁথে ছিল এবং এখন তা আরও গভীর ও ব্যাপক হয়েছে। এখন পর্যন্ত আইডিএফ-এর মাধ্যমে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সংঘটিত প্রাণহানিই ইসরাইলের ‘বিনাশ’ লক্ষ্যকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে। আর ‘বিতাড়নের’ দিকটি এতদিন অভ্যন্তরীণ আলোচনার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলেও সেটি প্রকাশ্যে আসে যখন ট্রাম্প নেতানিয়াহুর সরকারকে ‘গাজায় রিভিয়েরা প্রকল্প’ দিয়ে জাতিগত নির্মূলতায় আনুষ্ঠানিক সমর্থন দেন।
যতটুকু হামাসকে ‘শত্রু’ হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে, ততটুকু ইসরাইলের এই বিনাশ পরিকল্পনা আরও খোলামেলা। ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলের বহুবার ঘোষিত হামাসকে নির্মূল করার লক্ষ্যকে প্রকাশ্য সমর্থন দিয়েছে। ২০২৪ সালে আইডিএফ-কে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতায় নেতানিয়াহু বলেন, ‘আমরা হামাস নেতৃত্বকে হত্যা করব’ এবং এই হত্যা ও গাজা উপত্যকার প্রতিটি প্রান্তে অভিযান চালানোই ‘সম্পূর্ণ বিজয়’-এর অংশ, যা সামরিক অভিযান শেষ হওয়ার আগে অর্জন করতে হবে। এই ‘বিনাশ/বিতাড়ন’-এর লক্ষ্য কোনোভাবেই একটি শান্তিচুক্তিকে সম্ভব করে না। কেউ তার নিজের ধ্বংস নিয়ে কখনো চুক্তি করে না। নেতানিয়াহুর আরও কিছু ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণ রয়েছে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার। এর মধ্যে রয়েছে তার দুর্নীতির মামলার বিচার এড়ানো এবং ডানপন্থী উগ্রবাদী জোটকে টিকিয়ে রাখা—যারা ফিলিস্তিনিদের নির্মূল ও বিতাড়নে সবচেয়ে কট্টর এবং যুদ্ধবিরতির ঘোরতর বিরোধী।
এই সরকারের কাছে ‘যুদ্ধবিরতি’ মানে কখনোই গাজায় শান্তির দিকে অগ্রসর হওয়া নয়। বরং এটি সাময়িক বিরতি—সরবরাহ পুনর্বিন্যাস, কূটনৈতিক চাপ কমানো, অথবা কোনো সুবিধাজনক কৌশলের জন্য। যেমনটা দেখা গেছে এ বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতির সময়—ইসরাইল যখন ইচ্ছা, তখনই তা ভঙ্গ করেছে। হামাস অনেক আগেই যুদ্ধবিরতির পক্ষে ছিল। কেনই বা হবে না? তাদের অনেক নেতাই নিহত হয়েছেন, প্রতিরোধ ক্ষমতাও মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। গাজাবাসীর দুর্ভোগ যত দীর্ঘ হবে, হামাসকে দায়ী করে তাদের সমর্থন ততই হ্রাস পাবে। সংঘাত চলতে থাকলে হামাসের আর কিছুই লাভ নেই, বরং ক্ষতি ছাড়া কিছুই নেই।
২০২৪ সালের শেষ দিক থেকে যেসব যুদ্ধবিরতি আলোচনা হয়েছে, তাতে মূল দ্বন্দ্ব ছিল এই—হামাস স্থায়ী যুদ্ধশেষ চায়, ইসরাইল চায় আক্রমণ আবার শুরু করার সুযোগ ধরে রাখতে। হামাস চেষ্টা করেছে গাজাবাসীদের জন্য মানবিক সহায়তা, গাজা শহর ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চল থেকে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার, এবং ইসরাইলে বন্দি কিছু ফিলিস্তিনির মুক্তির মতো দাবিগুলোর মাধ্যমে কিছুটা স্বস্তি আদায় করতে। সাম্প্রতিক কাতারের আলোচনায় অভ্যন্তরীণ নথিপত্রে দেখা যায়—হামাসের আলোচকরা কাতারি ও মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে অত্যন্ত মনোযোগ ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করেছে। হামাস মধ্যস্থতাকারীদের প্রণীত কাঠামো চুক্তির বেশিরভাগ বিষয়েই সম্মত হয়।
হামাস যে সংশোধন প্রস্তাবগুলো দেয়, সেগুলো মূলত ছিল ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদের জন্য বেশি সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট ভাষা সংযোজনের উদ্দেশ্যে। যেমন, ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহারের ক্ষেত্রে জানুয়ারি ২০২৫ সালের যুদ্ধবিরতি অনুযায়ী অস্পষ্ট ‘কাছাকাছি অঞ্চল’ শব্দের বদলে তারা চেয়েছিল মানচিত্র অনুযায়ী নির্দিষ্ট রেখা নির্ধারণ। এ জন্য তারা নিজেদের প্রস্তাবনাও দিয়েছিল, যেখানে পার্থক্য ছিল মাত্র ১০০ থেকে ২০০ মিটার। বন্দি বিনিময়ের ক্ষেত্রেও তারা চেয়েছিল নির্দিষ্ট সংখ্যা নির্ধারণ—যেন ইসরাইলি বন্দিদের সংখ্যার সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকে। ত্রাণের ক্ষেত্রে তারা চাইছিল জাতিসংঘের মাধ্যমে পরিচালনা এবং রাফাহ সীমান্ত আবার খুলে দেয়া। এই সমস্ত বিষয়ে আন্তরিক আলোচনার পর হামাস গভীরভাবে বিস্মিত হয় যখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল হঠাৎ করে আলোচনার টেবিল ছেড়ে চলে যায় এবং ট্রাম্প হামাসকে দোষারোপ করেন আলোচনা ভেঙে পড়ার জন্য।
ট্রাম্পের দাবি, ‘হামাস আসলে চুক্তি করতে চায়নি, তারা মরতে চায়,— এটা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। কাতারের আলোচনা ভেঙে পড়ে কারণ নেতানিয়াহুর সরকার এই মুহূর্তে কোনো চুক্তি করতে চায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বরাবরের মতো নেতানিয়াহুর পদাঙ্ক অনুসরণ করেছে। গাজায় চলমান বিপর্যয়ের জন্য হামাসকে দোষারোপ করা মানে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ আন্দোলনকে—হামাস হোক বা অন্য যেকোনো দল—দায়ী করা, যেন তারাই সহিংসতার উৎস। অথচ প্রকৃত সহিংসতা এসেছে একটি জনগোষ্ঠীর দমন, দখল ও অধিকার হরণ থেকে—যার ফলশ্রুতি এই প্রতিরোধ। অন্যদিকে, নেতানিয়াহু অতীতে হামাসকে আজকের মতো ‘অশুভ শক্তি’ মনে করেননি। বরং, তিনি হামাসকে কাতারি আর্থিক সহায়তা পৌঁছাতে সহায়তা করেছিলেন, যেন সেটি ফাতাহ-নিয়ন্ত্রিত ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে একটি পাল্টা শক্তি হিসেবে দাঁড়ায়।
এই কৌশল ছিল ইসরাইলের দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার অংশ, ফিলিস্তিনিদের বিভক্ত রাখা, যাতে ইসরাইল সবসময় বলতে পারে ‘আমাদের আলোচনার কোনো সঙ্গী নেই।’ যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইলের শক্তিশালী লবিও এই বক্তব্য তুলে ধরে। এই পন্থাই প্রমাণ করে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করতে ইসরাইল আগ্রহী নয়।
(পল আর. পিলার, জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর সিকিউরিটি স্টাডিজের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো, কুইন্সি ইনস্টিটিউট ফর রেসপনসিবল স্ট্যাটক্রাফট-এর ফেলো এবং জেনেভা সেন্টার ফর সিকিউরিটি পলিসির অ্যাসোসিয়েট ফেলো। তিনি ১৯৭৭-২০০৫ পর্যন্ত সিআইএ কর্মকর্তা ছিলেন। নিবন্ধটি রেস্পন্সিবল স্ট্যাটক্রাফট-এ প্রকাশিত তার ‘দিস ইজ নট এ ওয়ার—ইসরাইল ইজ ডেস্ট্রায়িং এ পপ্যুলেশন’ শীর্ষক প্রবন্ধের অনুবাদ।)

No comments