গাজায় ইসরাইলি সেনাদের মানসিক ভাঙন ও যুদ্ধ-অপরাধের সাক্ষ্য

হারেৎজের রিপোর্টঃ ধ্বংসস্তূপের ভেতর দিয়ে হাঁটছে নাহাল ব্রিগেডের একদল সেনা। চারপাশে ভাঙাচোরা বাড়ি। দেয়ালের ধ্বংসাবশেষ। সেখানে একসময় মানুষ বেঁচে ছিল। সেনাদের কাজ হচ্ছে ‘তল্লাশি অভিযান’ চালানো। এরপরই আসবে বুলডোজার। তা ধ্বংসস্তূপের ওপর আরও ধ্বংস চাপিয়ে দেবে। সেনারা ঘিরে দাঁড়ায়। পাহারা দেয়, যেন কেবল ভারী যন্ত্রপাতির নিরাপত্তারক্ষী তারা। ইয়োনি ছদ্মনামের ওই সেনা বলেন, কখনো ভাবিনি আমার সামরিক জীবনে এ কাজ করতে হবে। গাজায় ইসরাইলের চালানো নৃসংসতা নিয়ে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন এভাবেই তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু গত মে মাসে বেইত লাহিয়ায় ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে। ‘সন্ত্রাসী, সন্ত্রাসী’- এক সেনা চিৎকার করতেই ইয়োনি উন্মত্ত হয়ে মেশিনগান থেকে শত শত গুলি ছুড়তে থাকেন। পরে বুঝতে পারেন ভীষণ ভুল হয়েছে। সন্ত্রাসী নয়- দুই শিশু, বয়স হয়তো ৮ বা ১০। ইয়োনি বলেন, সব জায়গায় রক্ত। আমি জানতাম সব আমারই কাজ। বমি করতে ইচ্ছে করছিল। কোম্পানি কমান্ডার এসে ঠাণ্ডা গলায় বলেন, তারা নির্মূল জোনে ঢুকেছে। তাদেরই দোষ, এটাই যুদ্ধ।

ইয়োনি মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে জানতে পারেন, তিনি নৈতিক আঘাতের শিকার। যেখানে নিজ মূল্যবোধের বিপরীতে কাজ করতে হয়। পরবর্তীতে তাকে যুদ্ধ থেকে সরিয়ে সাপোর্ট ভূমিকায় দেয়া হয়। কিন্তু শিশু দু’টির মুখ তাকে তাড়া করে ফিরছে। বিনই ছদ্মনামের আরেক সেনা নাহাল ব্রিগেডের স্নাইপার। প্রতিদিন ভোর থেকে তার কাজ-  উত্তর গাজায় ত্রাণবাহী ট্রাক পাহারা। এক অদৃশ্য রেখা টেনে দেয়া হয়েছে। কেউ সেটা অতিক্রম করলে স্নাইপারের গুলি। তিনি বলেন, প্রতিদিন ৫০-৬০টি গুলি চালাই। গুনে রাখি না। অনেকজনকে মেরেছি। শিশুদেরও। অনেক সময় গুলি করতে না চাইলেও কর্মকর্তারা রেডিওতে চাপ দেন, কেন গুলি করছ না? তারা এগিয়ে আসছে, বিপজ্জনক। তিনি বলেন, আমাকে জোর করে শিশুর ওপরও গুলি চালাতে বাধ্য করেছে। এতে আমার জীবন ক্ষতবিক্ষত হয়ে গেছে। এখন রাতে দুঃস্বপ্নে কাঁপতে কাঁপতে জেগে উঠি। কখনো প্রস্রাব ধরে রাখতে পারেন না, মনে হয় মৃতদেহের গন্ধ পাচ্ছেন।

অ্যারন নামের আরেক সেনা বলেন, বেইত হানুনে এক অভিযানে হঠাৎ বিস্ফোরণে সবাই ভেবেছিল হামলা হয়েছে। অযথাই গুলি চালানো হয়। পরে জানা যায়, সেনাদের নিজেরাই ভুলবশত বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। এরপর বাড়ি ফিরে তিনি বুঝতে পারেন শরীর কাঁপছে, বাজারে শিশুদের চিৎকারেও ভয়ে আঁতকে উঠছেন। কমান্ডারকে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে যাওয়ার অনুরোধ করলে অপমান করা হয়, তুমি কি পালাতে চাইছ? তুমি কি বিশ্বাসঘাতক? অনেক টানাপোড়েন শেষে তাকে সাপোর্ট প্লাটুনে বদলি করা হয়।
একই সময়ে গাজায় বহু সেনা মানসিক বিপর্যয়ে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে। এক প্লাটুনে তো এক সেনা বন্দুক মুখে দিয়ে বসেছিল। অফিসার কটাক্ষ করে বলেছিল, ট্রিগার টানলে ছুটি কাটা যাবে। সহযোদ্ধারাই অস্ত্র কাড়তে বাধ্য হয়েছিল। পরে ওই সৈন্যকে মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী দেখে সেনাবাহিনী থেকে অব্যাহতি দেয়। আরও একজন প্রকৌশলী কর্মকর্তা গত জুলাই মাসে পরিবারকে লিখেছেন, একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটেছে, আমি ঠিক আছি। পরের দিন তিনি নিজেই গ্রেনেড বিস্ফোরণে আত্মহত্যা করেন।
আইডিএফ এখন পর্যন্ত কোনো আনুষ্ঠানিক সংখ্যা প্রকাশ করেনি। তবে নেসেটে আলোচনায় প্রকাশিত হয়েছে- যুদ্ধ শুরুর পর থেকে ১১৩৫ জন সেনা ও রিজার্ভিস্ট পিটিএসডি কারণে ছাড়পত্র পেয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসল সংখ্যা আরও অনেক বেশি। অনেকেই সরাসরি যুদ্ধে না গিয়ে লজিস্টিক, ড্রাইভার বা রাঁধুনি হতে চাইছে। নাহাল, গিভাতি ও সাঁজোয়া ব্রিগেডে ডজন ডজন সেনা ইতিমধ্যেই কমব্যাট থেকে সরে গেছে।

এক সেনা স্বীকার করেন, তারা ভুলবশত এক নারী ও দুই শিশুকে হত্যা করেছে। তার ভাষায়, আমরা তিনটি অবয়ব দেখেছিলাম। আদেশ মেনে গুলি চালিয়েছি। এর পর তিনজন সহযোদ্ধা পিটিএসডিতে ভেঙে পড়েন। কিন্তু সেনা কর্তৃপক্ষ তা আমলে নেয়নি। কখনো বন্দুকধারী অফিসার নিজের সেনার পায়ে গুলি চালিয়েছিল মজা করার নামে। আরেকজন বলল, আমি আর পারছি না। অর্থহীন মিশন- সবকিছুর অবসান চাই।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.