চিরকাল কেউ বন্ধু বা শত্রু থাকে না, এই বক্তব্য দিয়ে কাকে বোঝাতে চাইলেন ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী

শুল্কযুদ্ধের আবহে ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং জানিয়ে দিলেন, স্থায়ী বন্ধু বা শত্রু বলে কিছু হয় না। স্থায়ী শুধু স্বার্থ। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি আয়োজিত ‘ডিফেন্স সামিট’ বা প্রতিরক্ষা সম্মেলনে যোগ দিয়ে আজ শনিবার রাজনাথ সিং এই মন্তব্য করেন।

ভারতের রপ্তানির ওপর একসময়কার ‘প্রিয় বন্ধু’ ডোনাল্ড ট্রাম্পের হঠাৎ ৫০ শতাংশ শুল্ক চাপানো ও তার পাল্টা ‘শত্রুভাবাপন্ন’ দেশ চীনের সঙ্গে মিত্রতার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনাথের এই মন্তব্য যথেষ্টই তাৎপর্যপূর্ণ।

ট্রাম্পের শুল্কনীতির পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে ভারত নতুন করে সম্পর্ক স্থাপন করছে চীনের সঙ্গে, যাদের সঙ্গে ২০২০ সালে পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বেধেছিল। আগামীকাল রোববার চীন যাচ্ছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

চীনের তিয়ানজিনে এসসিও সম্মেলনের অবসরে মোদির সঙ্গে বৈঠক হবে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ওই আসরে উপস্থিত থাকবেন। মোদির সঙ্গে বৈঠক হবে পুতিনেরও। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কযুদ্ধের মোকাবিলায় এই তিন দেশ আপাতত জোটবদ্ধ।

সাম্প্রতিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতির ব্যাখ্যা করে রাজনাথ বলেন, পৃথিবীতে চিরকালীন বন্ধু বা চিরকালের শত্রু বলে কিছু নেই। স্থায়ী শুধু স্বার্থ। দেশের মানুষের স্বার্থ, শ্রমিক–কৃষকদের স্বার্থ, উদ্যোক্তাদের স্বার্থ রক্ষাই দেশের কাজ। দেশের সব মানুষের স্বার্থরক্ষাই আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ভারত যা করছে, তা দেশের স্বার্থরক্ষার জন্যই।

রাজনাথ বলেন, আজকের বন্ধু কালকের শত্রু হতে পারে। ভারত যদিও কাউকেই শত্রু মনে করে না। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘আজকের পরিবর্তনশীল ভূরাজনীতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে অন্য দেশের প্রতি নির্ভরতা আমাদের জন্য বিকল্প হতে পারে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ও নিরাপত্তার স্বার্থে ভারতের স্বনির্ভর হওয়া জরুরি।’

কেন জরুরি সেই ব্যাখ্যায় রাজনাথ বলেন, ‘পৃথিবী আজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আমাদের সামনে উঠে আসছে নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ। মহামারি হোক, সন্ত্রাসবাদ হোক কিংবা আঞ্চলিক সংঘাত—এই শতাব্দীতে এখনো অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই পরিস্থিতিতে কৌশলগত প্রয়োজনীয়তাকে চিনতে হবে। তবে আত্মনির্ভরতার কোনো বিকল্প নেই। আত্মনির্ভরতাই সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয়তা।’

ভারত যে সেদিকেই এগোচ্ছে তা জানিয়ে রাজনাথ বলেন, ২০১৪ সালে ভারেতর প্রতিরক্ষা রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৭০০ কোটি রুপিরও কম। সেই প্রতিরক্ষা রপ্তানি আজ বেড়ে হয়েছে ২৪ হাজার কোটি রুপি। এ থেকেই বোঝা যায়, ভারত আত্মনির্ভর হয়ে উঠছে। ভারতের পরিচয় আমদানিকারক থেকে রপ্তানিকারক দেশ হয়ে উঠছে।

দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে ভারতের দূরত্ব বেড়ে গেছে। পেহেলগামকাণ্ড ও অপারেশন সিঁদুরের পর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ সেই দূরত্ব বাড়িয়ে তুলেছে। ‘বন্ধু’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বেড়ে যাওয়া দূরত্ব ঘোচাতে ভারত দ্রুত ঝুঁকেছে ‘শত্রুভাবাপন্ন’ চীনের দিকে।

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই কালক্ষেপণ না করে ভারতে এসে দেখা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে। মোদিও এসসিও সম্মেলনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতকে সার ও ‘রেয়ার আর্থ’ বা বিরল খনিজ পদার্থ বিক্রির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া ছিল, চীন তা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

পরিস্থিতির মোকাবিলায় দ্রুত কাছাকাছি আসছে ভারত, চীন ও রাশিয়া। কাছাকাছি আসছে পারস্পরিক স্বার্থরক্ষায়। রাজনাথ এই স্বার্থেরই উল্লেখ করে বলেছেন, এটাই একমাত্র স্থায়ী।

সীমান্ত সংঘাত ভুলে ভারতে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত জু ফেইহংও বলেছেন, ভারতের পণ্য যুক্তরাষ্ট্র না কিনলে চীন তা কিনবে।

শুল্কযুদ্ধের অবসান কীভাবে ঘটবে, তা এখনো অজানা। ভারত বুঝিয়ে দিয়েছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনার জন্য অতিরিক্ত যে ২৫ শতাংশ শুল্ক জরিমানা হিসেবে চাপানো হয়েছে, তা তুলে না নিলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

যুক্তরাষ্ট্রও নানাভাবে বোঝাচ্ছে, রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করলে ভারতের ওপর চাপানো ৫০ শতাংশ শুল্ক বহাল থাকবে। এই পরিস্থিতিতে ভারতের বাণিজ্যমন্ত্রী পীযূষ গোয়েল জানিয়ে দিয়েছেন, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাপের কাছে ভারত কখনো মাথা নোয়াবে না। এমন কিছু করবে না, যাতে মনে হয় ভারত দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ভারত বৈষম্য মেনে নেবে না। ১৪০ কোটি মানুষের আত্মসম্মান নষ্ট করে কিছু করবে না। ভারত বরং নতুন বাজার খুঁজবে, যেখানে পণ্য রপ্তানি করা যাবে।

গত শুক্রবার নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে এই কথা জানিয়ে পীযূষ গোয়েল বলেন, ২০২৪–২৫ সালে ভারতের রপ্তানি যা ছিল, চলতি অর্থবর্ষে তার চেয়ে বেশি রপ্তানি হবে।

https://media.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2025-08-30%2F4pkv9xpq%2FRajnath.jpg?rect=0%2C0%2C600%2C400&w=622&auto=format%2Ccompress&fmt=avif
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। ছবি: এএনআই

No comments

Powered by Blogger.