গাজায় না খাইয়ে মানুষ মারা ও আমাদের বৈশ্বিক লজ্জা by বিনাইফার নওরোজি
চামড়া হাড়ের সঙ্গে লেগে যায়, শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। একে একে অঙ্গগুলো বিকল হয়। দৃষ্টিশক্তি কমে আসে। শরীর ফাঁকা হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়। এটি এক দীর্ঘ ও যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু।
আজ আমরা সে দৃশ্যই গাজায় দেখছি। কঙ্কালসার নবজাতক আর শিশু মায়ের কোলে ধুঁকে ধুঁকে মারা যাচ্ছে অনাহারে। এর মধ্যেই ইসরায়েল যুদ্ধ আরও তীব্র করেছে। তারা গাজা সিটি ‘দখল’ করার নামে নতুন অভিযান শুরু করেছে। ফলে আরও হাজার হাজার ফিলিস্তিনি হয় বোমার আঘাতে, নয়তো অনাহারে মারা যাবেন।
জাতিসংঘের জ্যেষ্ঠ মানবিক কর্মকর্তা রমেশ রাজাসিংহাম ১০ আগস্ট নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, ‘এটি আর ভবিষ্যতের দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি নয়, এটি সরাসরি অনাহারে মানুষ মেরে ফেলা।’ দুর্ভিক্ষবিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স ডি ওয়াল জানান, গাজার হাজারো শিশু এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে যে তারা খাবার পেলেও খেতে পারবে না। তাঁর ভাষায়, তাদের শরীর এখন আর খাবার হজম করতে সক্ষম নয়।
ইতিমধ্যে ঐকমত্য তৈরি হচ্ছে যে গাজায় ইসরায়েল গুরুতর অপরাধ করছে। তারা যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহারকে ব্যবহার করছে। যুদ্ধ শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই ফিলিস্তিনি ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো সতর্ক করেছিল। এরপর বিশ্বের প্রতিটি মহাদেশের দেশ থেকেই এ বিষয়ে সতর্কবার্তা এসেছে। এমনকি ইসরায়েলের ভেতর থেকেও অনেকে স্বীকার করেছেন।
সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্ট বলেছেন, গাজায় যা ঘটছে, তা যুদ্ধাপরাধ। আর শীর্ষস্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এটি গণহত্যার সমান।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় ১ হাজার ২০০ জনের বেশি ইসরায়েলি নিহত এবং ২০০ জনের বেশি জিম্মি হওয়ার দুই দিন পর ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট ঘোষণা দেন, ‘আমি গাজা উপত্যকায় পূর্ণ অবরোধের নির্দেশ দিয়েছি। সেখানে কোনো বিদ্যুৎ থাকবে না, খাবার থাকবে না, জ্বালানি থাকবে না। সেখানে সবকিছু বন্ধ থাকবে। আমরা মানবপশুর সঙ্গে যুদ্ধ করছি এবং সে অনুযায়ী কাজ করব।’
এ ঘোষণায় পুরো গাজার মানুষকে অমানবিকভাবে চিত্রিত করা হয়। সেখানে আর বেসামরিক ও যোদ্ধাদের মধ্যে কোনো পার্থক্য রাখা হয়নি। এটি আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের মৌলিক নীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। সেই অবরোধ টানা ৭০ দিন চলেছিল এবং সব সরবরাহ বন্ধ ছিল। এটি ছিল সরাসরি সমষ্টিগত শাস্তি।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে ইসরায়েল সামান্য কিছু সরবরাহ গাজায় ঢুকতে দেয়। কিন্তু সেই এপ্রিলেই ইউএসএইডের প্রধান সামান্থা পাওয়ার সতর্ক করেন, গাজার কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়েছে। এর পরের মাসে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির নির্বাহী পরিচালক সিন্ডি ম্যাককেইন ঘোষণা দেন, উত্তর গাজায় পূর্ণমাত্রার দুর্ভিক্ষ চলছে।
আন্তর্জাতিক আইন স্পষ্টভাবে বলেছে, যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে অনাহার ব্যবহার নিষিদ্ধ। দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের বাধ্যবাধকতা হলো বেসামরিকদের যথেষ্ট খাবার, পানি, ওষুধ ও প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিশ্চিত করা। যদি গাজার ভেতরে এগুলো জোগাড় না হয়, তবে বাইরে থেকে, এমনকি ইসরায়েল থেকেই সরবরাহ করতে হবে।
কিন্তু ২১ মাস ধরে অনেক দেশ ও সংস্থা সাহায্য পৌঁছাতে চাইলে ইসরায়েল বাধা দিয়েছে। এ অনুমতি দেওয়া শুধু নৈতিক নয়, আইনি দায়িত্বও। ইসরায়েলের কর্তব্য ছিল অন্যদের ত্রাণ কার্যক্রম সহজ করা। কিন্তু তারা বারবার তাতে বাধা দিয়েছে। এখনো মানবিক সংস্থাগুলোকে সাহায্য পৌঁছাতে দেওয়া হচ্ছে না।
স্পষ্টতই ফিলিস্তিনিদের ইচ্ছাকৃতভাবে অনাহারে মারা হচ্ছে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাসের মধ্যেই এর লক্ষণ স্পষ্ট ছিল, কিন্তু অনেক সরকার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। তারা বলেছে, সাহায্য নাকি হামাস পাচ্ছে। যার কোনো প্রমাণ ইসরায়েলের কাছেই নেই। বরং এসব সরকার গাজায় সাহায্য পাঠানোর তুলনায় ইসরায়েলকে বেশি অস্ত্র দিয়েছে। এখন তারা গণহত্যা ঠেকানো ও থামানোর দায়িত্বে ভয়াবহভাবে ব্যর্থ হচ্ছে।
ইতিহাস এ মুহূর্তকে চিরকাল বৈশ্বিক লজ্জা হিসেবে মনে রাখবে। কঙ্কালসার শিশুদের ছবি যোগ হবে অতীতের সেই ছবিগুলোর পাশে, যখন পৃথিবী তাদের জন্য কিছু করেনি। আশা একটাই, পৃথিবী যেন এখনই জেগে ওঠে, মানবতার শেষ আলোটা অন্তত বাঁচিয়ে রাখে। তার আগে যদি কিছু করা না যায়, তবে আরও অসহায় শিশু ক্ষুধার্ত চোখ মেলে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়বে।
● বিনাইফার নওরোজি, ওপেন সোসাইটি ফাউন্ডেশনসের সভাপতি
- স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
![]() |
| গাজায় খাবার ঢুকতে না দেওয়ায় সেখানে চরম খাদ্যসংকট দেখা দিয়েছে। ছবি: এএফপি |

No comments