পুতিনের কৌশলের কাছে ট্রাম্প কি অবস্থান বদলেছেন! by অ্যানড্রু হিগিন্স
রাশিয়াকে ভুক্তভোগী হিসেবে উপস্থাপন করা, অথচ যুদ্ধের সূচনা তারাই করেছে- এটি ক্রেমলিনের প্রচারণার অংশ হয়ে আছে ২০২২ সালে পুতিনের তথাকথিত বিশেষ সামরিক অভিযান ঘোষণার পর থেকে। লিথুয়ানিয়ার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী লরিনাস কাসচিউনাস বলেন, পুতিন আর রাশিয়া পুনর্মূল্যায়নবাদী। তারা ঠাণ্ডা যুদ্ধ হেরে যাওয়াকে মেনে নিতে পারে না। লিথুয়ানিয়া একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল এবং এখন ন্যাটোর সদস্য। একইভাবে পোল্যান্ড, চেক প্রজাতন্ত্র, রোমানিয়া ও ওয়ারশ চুক্তির অন্য সাবেক সদস্যও এখন ন্যাটোতে।
রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ আলাস্কার হোটেলে পৌঁছান এমন একটি সোয়েটশার্ট পরে, যেখানে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতীকী লেখা সিসিসিপি খোদাই করা ছিল। কিন্তু পুতিন ও ট্রাম্পের বৈঠকের ঠিক আগে, ওয়ারশতে পোল্যান্ড রাশিয়াকে স্মরণ করিয়ে দিল পুরোনো শাসন চলে গেছে। ভিসচুলা নদীর তীরে তারা ট্যাঙ্ক ও সামরিক সরঞ্জামের এক শোভাযাত্রা আয়োজন করল, যার অধিকাংশই আমেরিকান তৈরি। এই প্রদর্শনী ১৯২০ সালে লাল সেনার বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের বিজয় উদযাপন করল এবং বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবচেয়ে বড় সেনাবাহিনী হিসেবে পোল্যান্ডের শক্তি প্রদর্শন করল।
পুতিনের ক্ষতিগ্রস্ত অহং মেটাতে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প সম্মেলনের পর সিয়ান হ্যানিটিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে রাশিয়ার মর্যাদা বাড়িয়ে চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে উপেক্ষা করে তিনি বললেন, ‘আমরা নাম্বার ওয়ান, আর তারা নাম্বার টু।’ রাশিয়ার সরকারি প্রচারমাধ্যম ও জাতীয়তাবাদী বিশ্লেষকরা এটিকে রাশিয়ার ‘সম্মানিত দেশগুলির ক্লাবে’ পুনঃঅভ্যর্থনা হিসেবে উদযাপন করল।
আক্রমণাত্মক ভূরাজনৈতিক তাত্ত্বিক আলেকজান্ডার দুগিন টেলিগ্রামে বললেন, আমি এমন ফল আশা করিনি। আমাদের সবাইকে অভিনন্দন। এটি ছিল বিশাল। সবকিছু জয় করা আর কিছুই না হারানো- এমন কেবল আলেকজান্ডার তৃতীয়ই করতে পেরেছিলেন।
জাতীয়তাবাদী সিনেটর আন্দ্রেই ক্লিশাস বললেন, সম্মেলন প্রমাণ করেছে রাশিয়ার দীর্ঘমেয়াদি ও ন্যায্য শান্তির ইচ্ছা এবং দেশটি এখন বিশেষ সামরিক অভিযান সামরিক বা কূটনৈতিক- যেকোনো পথে চালিয়ে যেতে স্বাধীন। তিনি আরও দাবি করলেন, রাশিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে এগিয়ে আছে এবং ক্রমশ নতুন নতুন এলাকা মুক্ত করছে।
এই নতুন বিশ্ব নিরাপত্তা কাঠামো আসলে কী রূপ নেবে তা পরিষ্কার নয়। তবে এর মূল স্তম্ভ হলো- রাশিয়াকে ঠাণ্ডা যুদ্ধকালীন মর্যাদা ফিরিয়ে দেয়া, আঞ্চলিক প্রভাবশালী শক্তি হিসেবে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমান বৈশ্বিক শক্তি হিসেবে। ২০২২ সালের আক্রমণের ঠিক আগে, রাশিয়া ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রকে খসড়া চুক্তি দিয়েছিল, যাতে বলা হয়েছিল ন্যাটোকে পূর্ব ইউরোপ থেকে সরে যেতে হবে এবং ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোতে নেয়া যাবে না। এই দাবিগুলি দ্রুত প্রত্যাখ্যান করা হয়।
ইউক্রেনে আক্রমণ ঘোষণা করার সময় টেলিভিশন ভাষণে পুতিন মূলত পশ্চিমাদের হয়রানি আর রাশিয়ার স্বার্থকে উপেক্ষা করার অভিযোগ তুলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন- ৩০ বছর ধরে আমরা ধৈর্যের সঙ্গে ন্যাটো দেশগুলির সঙ্গে সমান নিরাপত্তার নীতি নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছি। কিন্তু আমাদের প্রস্তাবের জবাবে আমরা পেয়েছি প্রতারণা, চাপ ও হুমকি- এবং ন্যাটো আমাদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সম্প্রসারণ চালিয়ে গেছে।
ঠাণ্ডা যুদ্ধপরবর্তী ব্যবস্থাকে বদলানোর প্রচেষ্টার একটি কেন্দ্রীয় অংশ ছিল রাশিয়ার উদ্যোগ-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী ট্রান্স-আটলান্টিক সম্পর্ক দুর্বল করা, যা ১৯৯১ সালের পর ন্যাটোর সম্প্রসারণে আরও শক্তিশালী হয়। কিন্তু ইউক্রেন আক্রমণ উল্টো ফল দিয়েছে- ন্যাটোর উপস্থিতি রাশিয়ার সীমান্তের কাছেই বেড়েছে। ২০২৩ সালে ফিনল্যান্ড, যার সঙ্গে রাশিয়ার ৮৩০ মাইল সীমান্ত রয়েছে, সামরিক নিরপেক্ষতা ছেড়ে ন্যাটোতে যোগ দিল। সুইডেনও যোগ দিল। তবুও, আলাস্কায় ট্রাম্প তার অবস্থান দিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি করলেন। তিনি আগে যেমন বলেছিলেন জরুরি যুদ্ধবিরতির পক্ষে, তার বদলে পুতিনের বিস্তৃত শান্তিচুক্তি প্রস্তাবের সঙ্গে তাল মেলাতে দেখা গেল। ইউরোপীয় নেতারা এটি ভালোভাবে নেননি, কারণ তারা আগেও দেখেছেন- পুতিনের সঙ্গে কথা বলার পর ট্রাম্প বারবার ইউক্রেন নিয়ে অবস্থান বদলেছেন।
ট্রাম্প ফক্স নিউজকে বলেন, রাশিয়া একটি বিশাল শক্তি, আর তারা (ইউক্রেন) নয়। তিনি যোগ করেন, যুদ্ধ শেষ হওয়া নির্ভর করছে ইউক্রেন ও ইউরোপের ওপর, যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নয়। এখন সত্যিই প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির দায়িত্ব এটি শেষ করার। আমি আরও বলব, ইউরোপীয় দেশগুলিকে কিছুটা বেশি জড়িত হতে হবে।
রাশিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ সম্মেলনকে স্বাগত জানালেন এভাবে যে, এটি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে সর্বোচ্চ স্তরের বৈঠকের পূর্ণাঙ্গ কাঠামো ফিরিয়ে দিয়েছে। তার মতে, এটি প্রমাণ করে- দুই শক্তির মধ্যে আলোচনার পাশাপাশি ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান চালানো সম্ভব।
(নিউ ইয়র্ক টাইমস থেকে অনূদিত)
![]() |
| যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শনিবার বলেছেন, ‘যুদ্ধ বন্ধে ইউক্রেনের উচিত রাশিয়ার সঙ্গে একটি চুক্তি করা। কারণ, রাশিয়া খুব বড় একটি শক্তি। তারা (ইউক্রেন) তা নয়।’ ট্রাম্প জেলেনস্কিকে জানান, যদি কিয়েভের পক্ষ থেকে দোনেৎস্ক অঞ্চলের পুরোটা ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে রাশিয়া বেশির ভাগ জায়গায় যুদ্ধ থামাবে—এমন শর্ত দিয়েছেন পুতিন। |

No comments