ক নিলে চাঁদা, খ নিলে ডোনেশন, গ নিলে ইয়ানত, ঘ নিলে হাদিয়া! by সারফুদ্দিন আহমেদ

মিটফোর্ডে ভাঙারি ব্যবসায়ী লাল চাঁদকে প্রকাশ্যে প্রস্তরযুগীয় কায়দায় পাথর মেরে জানে মারার পর জানা যাচ্ছে, এলাকার যে দাদারা তাঁকে চাঁদাবাজ আখ্যা দিয়ে মেরেছেন, তাঁরাই বড় চাঁদাবাজ। তাঁরা মূলত রাজনৈতিক জীব। আওয়ামী আমলে অফিশিয়ালি অপজিশনে আর বর্তমানে আনঅফিশিয়ালি পজিশনে থাকা যুবদল, ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দল তাঁদের আসল বল। তাঁরা এসব দলের মারদাঙ্গাধর্মী নেতা-কর্মী।

গণভবন পতনের পর দেশ লুটেপুটে খাওয়ার মতো এলোমেলো হয়ে গেছে ভেবে যাঁরা আনন্দে বাঙ্গিফাটা হয়ে চান্দার ধান্ধায় টেকনাফ টু তেঁতুলিয়া, নীলক্ষেত টু খিলক্ষেত ছলে এবং বলে দখলে নিয়েছেন, সেই কৃতিসন্তানদের মধ্যে এই নেতাকর্মীরাও আছেন।

৫ আগস্টের পর বিএনপি ছাড়াও জামায়াত এবং এনসিপিসহ অন্যান্য নতুন পুরোনো দলের বুড়ো থেকে খোকা এবং সিকি থেকে আধা নেতাদের চাঁদাবাজি, দখলবাজি এবং তদবিরবাজির খবর দেখতে পাচ্ছি। তবে বলশালী খলদের দখল আর তদবির ছাপিয়ে আলোচনায় এখন চাঁদা।

চাঁদা, মানে চান্দা কোনো ধান্দার জিনিস না। এক সময় পাড়া-মহল্লায় মসজিদ-মক্তব, পাঠশালা-পাঠাগার গড়ার মতো মহৎ কাজের খরচ যোগাতে আদা-ব্যাপারী ফকিরজাদা থেকে জাহাজ-কারবারি সাহেবজাদা চাঁদা দিতেন। গাঁও গেরামে পাগার পারাপারের সাঁকো লাখো লোকের হাসিমুখে দেওয়া চাঁদার টাকায় হতো। এখনো হয়তো হয়। দাদা-পরদাদার আমল থেকে চাঁদার চল চলছে। সেই চাঁদায় কালি ছিল না। সেই চাঁদা কালা ছিল না, ছিল সাদা।

পরে সাদা চাঁদায় ‘বাজি’ ঢুকে পড়েছে। চাঁদাবাজিতে হাজিপাড়া-কাজীপাড়া একাকার হয়ে গেছে। ‘দালান উঠছে তাও রাজনীতি, দালান ভাঙছে তাও রাজনীতি’র মতো বাড়ি কিনলে নতুন চাঁদের মতো চাঁদাবাজ উদয় হচ্ছে, বাড়ি বেচলেও বাজ পড়ার মতো ফাজিল চাঁদাবাজ নাজিল হচ্ছে। টং দোকান থেকে শপিং মলে ছলেবলেকৌশলে তলে তলে চাঁদাবাজি চলে।

আওয়ামী চাঁদাবাজি অস্ত গেছে। এখন এসেছে নতুন চাঁদাবাজ, তাঁকে ছেড়ে দিতে হচ্ছে স্থান। মোবাইল মনিটরে ঝুঁকে ফেসবুকে ঢুকে দেখছিলাম, মোহাম্মাদপুরের এক যুবদল নেতা বলছেন, ‘আওয়ামী লীগের চাঁদাবাজরা পালাইছে, এলাকায় কেউ চাঁদা তোলার নাই। কেউ তাল পাইতাছে না, তাই আমি হাল ধরছি।’

কারওয়ানবাজার–কাপ্তানবাজার–ঠাঁটারীবাজার–রাজাবাজারে হাজার হাজার ‘রাজা’র উদয় হয়েছে। ফেসবুকে ভেসে আসা আরেক ভিডিওতে দেখেছি, গাজীপুরে রাম দা আর চাপাতিধারী জনাবিশেক স্যাঙাত নিয়ে যুবদলের এক ‘রাজা’ হ্যান্ডমাইকে অমায়িক হুমকি দিয়ে খোলাবাজারে রীতিমতো বাজনা বাজিয়ে ‘খাজনা’ আদায় করছেন। মুরগির ছাও ছো মেরে নেওয়া বাজের মতো চাঁদাবাজ পেয়াদায় আদায় করছেন ‘খাজনা’।

ষোলো বছরের না খাওয়া গাল হা করে যে রাহু লম্বা গলায় সব গিলতে চাচ্ছে, তাকে বাহু তুলে বাধা দেবে এমন কাউকে দেখা যাচ্ছিল না।

আজিমপুর গোরস্থান, মানে কবর থেকেও এক বিএনপি নেতার ‘তোলা’ তোলার খবর আমরা জেনেছি। গুগলে ‘বিএনপির চাঁদাবাজি’ লিখে সার্চ দিলে এই সংক্রান্ত সংবাদের অন্ত মিলবে না।

গত ১৩ জুলাই রোববার ঝালকাঠিতে এসে পথসভায় সবাইকে অভয় দিয়ে এনসিপির নেতা নাহিদ ইসলাম বলছিলেন, ‘যারা চাঁদাবাজির রাজনীতি করতে চায়, তাদের বিদায় হবে হাসিনার মতো।’ নতুন বাংলাদেশে নতুন নেতার এই কথা নতুন আশা জাগিয়েছিল।

সমস্যা হলো, ওই দিনই একটি ভিডিও ভাইরাল হয়। সে ভিডিওতে দেখা যায়, এনসিপির কেন্দ্রীয় সদস্য ইমামুর রশিদ ইমন গাড়িতে বসা এক নারীর কাছ থেকে সাত লাখ টাকা নিচ্ছেন।

ভিডিওতে ইমনকে উদ্দেশ করে ওই নারীকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাই’কে দশ লাখ টাকা দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আছে সাত লাখ। ইমন বলছিলেন, ‘এখানে যে সাত লাখ আছে, তা ভাই জানে?’ নারী বললেন, ‘জানে।’

ধরা যাক, ওই নারীর নাম সাদিয়া। ভিডিও দেখে মনে হয়েছে, সাদিয়ার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার জন্য ইমনকে ‘ভাই’ পাঠিয়েছেন।

ভিডিওটি যিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন, তাঁর ভাষ্যমতে, সাদিয়া একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা। বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ পাওয়ার আশায় এনসিপি নেতাদের বাসায় বিভিন্ন সময় তিনি প্রায় ৪৮ লাখ টাকা পৌঁছে দিয়েছেন।

ধরে নিচ্ছি, এই টাকা চাঁদার টাকা না। ধারণা করি, এই টাকা কোনো জুলাই বীরের তদবিরের হাদিয়া। কোন ‘ভাই’ নিয়েছেন সাদিয়ার হাদিয়া, তা দিয়া আপাতত কাজ নাই। তবে ‘সমন্বয়ক’ পরিচয়ে চাঁদা আদায়ের অল্পবিস্তর গল্প সারা দেশেই শোনা যাচ্ছে।

এর আগে আমরা এনসিপি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কয়েকজন ‘জনগণমনঅধিনায়ক’-এর বিরুদ্ধে ‘বীরোচিত’ তদবিরবাজির অভিযোগ শুনেছি।

এনসিপির যুগ্ম সদস্যসচিব থাকাকালে হাজি সাহেবের মতো দেখতে গাজী সালাউদ্দিন তানভীর ডিসি নিয়োগে প্রভাব খাঁটিয়ে দলটির ভাবমূর্তি খাটো করেছেন। তিনি কাগজ-কলম থেকে তরি-তরকারির মতো দরকারি জিনিসের সরকারি কেনাকাটার কমিশন বিজনেসেও বিজি ছিলেন বলে দুদকের তদন্তে দেখা যাচ্ছে।

উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়ার এপিএস থাকাকালে ফাঁকতালে মোয়াজ্জেম হোসেন শতকোটি টাকার সম্পদ হাতিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

হাজার হাজার মানুষের রক্তে ভেজা জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে জন্ম নেওয়া এনসিপির অনেকের সঙ্গে এ ধরনের অযাচিত অর্থযোগের যোগসাজশের অভিযোগও আমরা পেয়েছি।

কোনো রকমের কামাই রোজগার ছাড়াই এনসিপি গত রমজানে কন্টিনেন্টাল হোটেলে সদ্যোজাত পলিটিক্যাল পার্টি হিসেবে ইফতার আর ডিনার পার্টি দিয়েছিল। সেই খরচের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠলে তাঁরা বলেছিলেন, এই টাকা চাঁদা হিসেবে ব্যবসায়ীরা দিয়েছেন। তবে সেই ব্যবসায়ীদের ‘অনুরোধে’ তাঁরা তাঁদের নাম বলেননি।

তারও আগে গণ অধিকার পরিষদের নেতারা দল চালানোর বল বাড়ানো বাবদ ক্যাশে ও বিকাশে দেশি-প্রবাসীদের কাছ থেকে চাঁদা তুলেছিলেন। দলটির এক ‘গুরু’ সেই টাকা ফাঁকা করা শুরু করেছিলেন বলেও জোর জনশ্রুতি আছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জামায়াতের সমাবেশ থেকে নেতারা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘চাঁদা নিতে দেব না, দুর্নীতি সহ্য করব না।’ কিন্তু বেশ আগে থেকেই চাঁদাবাজির জামাতে জামায়াত নেতাদেরও কাতারবন্দী হতে দেখা গেছে।

প্রথম আলোর প্রতিবেদনে বেদনাজনকভাবে দেখা যাচ্ছে, কুড়িগ্রামের রাজীবপুরে জামায়াত নেতা আনিসুর রহমান অন্য সব চাঁদাবাজের সুরে সুর ধরেছেন। চাঁদা আদায়ে রহমানও রহম করেননি। তিনি মামলা সামলানোর কথা বলে এক ব্যবসায়ীর কাছে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা চেয়েছেন।

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় জামায়াতের ‘ত্যাগী নেতাদের’ আদাজল খেয়ে চাঁদাবাজিতে নেমে ইয়ানতের খিয়ানত করতে দেখা গেছে।

আসলে আমাদের উদীয়মান, উদিত, এমনকি অস্তমান রাজনীতিকেরাও চাঁদাঅন্তপ্রাণ। বিতাড়িত আওয়ামী চাঁদাবাজির কথা নতুন করে বলার কিছু নাই। বিএনপি সেই জায়গা দখল করেছে বলে জামায়াতের দিক থেকে অভিযোগ আসার পর মেজাজ হারিয়ে মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘আমরা নিলে চাঁদা, আর জামাত নিলে হাদিয়া!’

আসলে সাদিয়াদের দেওয়া হাদিয়া দিয়া যেহেতু দলের লোক চলে, সেহেতু তা না দিয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া শুধু বিস্কুট কিংবা চা দিয়া তাঁদের বোঝানো কঠিন।

অনেকে বলছেন, ‘বিএনপি নিলে চাঁদা, এনসিপি নিলে ডোনেশন, জামায়াত নিলে ইয়ানত, চরমোনাই নিলে হাদিয়া, গণঅধিকার নিলে বিকাশ।’ কিন্তু দিন শেষে যা দিতে হবে এবং যা না দিলে ব্যবসা-বাণিজ্যে বাধা আসবে, তার আদি নাম চাঁদা।

তবে লাল চাঁদ হত্যার পর চাঁদাবাজের দাদাগিরি বাধা খাচ্ছে। মেপে কথা বলা লোকও খেপে গেছে। ভিডিওতে দেখলাম, কেরানীগঞ্জে পাবলিক চারদিক ঘিরে খুঁটিতে বাঁধা এক জুটি চাঁদাবাজের ঝুঁটি ধরে টুঁটি টেনে ছিঁড়ে ফেলার হুমকি দিচ্ছে; রাজধানীতে চাঁদা নিতে আসা দাদাদের বুড়ো থেকে বালক বয়সী সিএনজি চালক ও সাধারণ লোক প্রতিরোধ করেছেন; নরসিংদীতে তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যবসা থেকে চাঁদা তোলা ঠেকাতে ব্যবসায়ীরা মিছিল করেছেন, কিল একটাও মাটিতে পড়বে না জেনে চাঁদাবাজ ফটকেরা সটকে পড়েছেন।

অনেক বাস স্ট্যান্ড, টেম্পু স্ট্যান্ড বা বাজারে গত কয়েক দিন চাঁদাবাজি বন্ধ আছে। কালেকটররা মারের ভয়ে কোনো কোনো লোকেশনে কালেকশনে যাচ্ছেন না।

এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম সম্প্রতি একটি বেসরকারি টিভিকে বলেছেন, তাঁরা রাজনীতি করবেন মানুষের জন্য, দলও চালাবেন মানুষের টাকায়। গণচাঁদা বা ক্রাউডফান্ডিংয়ের মাধ্যমে দল চালানো হবে বলে তাঁদের নিজেদের মধ্যে আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে।

নাহিদ বলেছেন, ‘আমরা চাই এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে একজন রিকশাওয়ালাও আমাদের দলকে সমর্থন করতে পারেন, প্রবাসে থাকা একজন ভাই বা বোনও যেন আমাদের তহবিলে চাঁদা দিতে পারেন।’ তিনি বলেছেন, ‘যারা করাপ্টেড অলিগার্ক বা দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, তাদের কাছ থেকে আমরা কোনো চাঁদা নেব না।’

গণচাঁদায় স্বচ্ছভাবে দল চালানোর নজির আছে। ভারতের আম আদমি পার্টি ২০১৩ সালে চালু করেছিল অনলাইন ডোনেশন প্ল্যাটফর্ম। ডেবিট/ক্রেডিট কার্ড, ইন্টারনেট ব্যাংকিং-এর মতো ডিজিটাল মাধ্যমে সেখানে জনগণ চাঁদা দিত। চাঁদার হিসাবপত্র উন্মুক্ত ছিল। দাতার সম্মতি সাপেক্ষে তাঁর নাম, ঠিকানা, চাঁদার পরিমাণ এবং সময় সাইটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রকাশিত হতো। চাঁদার তালিকা প্রতিদিন হালনাগাদ হতো। মোট কত টাকা জমা পড়েছে, তা সবাই দাঁড়ি–কমাসহ দেখতে পেত। দল কোথায় কী পরিমাণ খরচ করছে, সেই তথ্যও সবাই দেখতে পেত। মোদি সরকার অনেক চাঁদা দাতাকে হয়রানি করায় ২০১৪ সালে সেই সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয়।

গণচাঁদার এই ধারণা রাজনীতিকেরা ধারণ করতে পারলে রাজনীতির মান এবং সম্মান বহুদূর যেত। তবে তার আগে গণচাঁদায় দলের চলা উচিত এবং চাঁদা তুলে দলের নেতার চলা উচিত না—এই উচিত বুঝ সব দলের বুঝে আসতে হবে। তা কি আর হবে? হলেও হবে কবে?

* সারফুদ্দিন আহমেদ, প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
- ইমেইল: sarfuddin2003@gmail.com

ষোলো বছরের না খাওয়া গাল হা করে যে রাহু লম্বা গলায় সব গিলতে চাচ্ছে, তাকে বাহু তুলে বাধা দেবে এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না
ষোলো বছরের না খাওয়া গাল হা করে যে রাহু লম্বা গলায় সব গিলতে চাচ্ছে, তাকে বাহু তুলে বাধা দেবে এমন কাউকে দেখা যাচ্ছে না। কার্টুন: খলিল রহমান

No comments

Powered by Blogger.