সুপারম্যান বিতর্ক: ফিলিস্তিনিদের বাঁচাতে পশ্চিমা সুপারহিরোর দরকার নেই by জো জিল

জেমস গানের নতুন ‘সুপারম্যান’ ছবিটি মুক্তির পর থেকেই আলোচনা ও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এই ছবির গল্পে আমেরিকান সুপারহিরো ফর্মুলাকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে এবং এতে নতুন ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপট যুক্ত হয়েছে।

পরিচালক গান এই ছবিতে আমেরিকা–সর্বস্ব ক্লিশে বিষয়গুলো এড়িয়ে গেছেন; যদিও এই প্রথম তিনি সামরিক-প্রযুক্তিগত পুঁজিবাদের বিপদ নিয়ে কাজ করেছেন, এমনটা মোটেও নয়। কিছু দর্শক মনে করছেন, এই ছবিতে ইসরায়েলকে আক্রমণ করা হয়েছে।

ছবিতে দেখা যায়, বোরাভিয়া নামের একটি কল্পিত শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয় রাষ্ট্র (যার নেতা ডেভিড বেন-গুরিয়নের মতো দেখতে) তার দরিদ্র, অ-শ্বেতাঙ্গ প্রতিবেশী জারহানপুরে আক্রমণ করে।

মূল দৃশ্যগুলোতে সশস্ত্র সেনাবাহিনীকে একটি নিরাপত্তা বেড়ার কাছে নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীদের মুখোমুখি হতে দেখা যায়। এটি স্পষ্টতই গাজায় ইসরায়েলের বিভাজন প্রাচীর এবং ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে তাদের বারবার আক্রমণের কথা মনে করিয়ে দেয়।

ডানপন্থী সমালোচকেরা এই ছবিকে অতিমাত্রায় ‘প্রগতিশীল’ বলে আখ্যা দিয়েছেন। গান এই ছবির কাজ ২০২২ সালে শুরু করেছিলেন। তাই ধরে নেওয়া যায়, এটি ২০২৩ সালের অক্টোবরে হামাসের আক্রমণ এবং ইসরায়েলের গাজায় অভিযানের আগের ঘটনা নিয়ে বানানো।

ছবির প্রধান খলনায়ক লেক্স লুথর ইলন মাস্ক ঘরানার একজন শতকোটিপতি। তিনি বোরাভিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করেন এবং জারহানপুর দখলের পরিকল্পনা করেন। সুপারম্যান এখানে একজন সরলমনা ভালো মানুষ। তিনি তাঁর সুপার-কুকুর ক্রিপ্টোকে ভালোবাসেন এবং দানবদের হাত থেকে শহর বাঁচান।

গান দাবি করেছেন, ছবিটি মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে নয়। এটি একটি কল্পিত কাহিনি। এটির পটভূমি ইউরোপে। বোরাভিয়ায় রাশিয়ান ভাষাভাষীদের ও পুতিন ঘরানার একনায়কত্বের ছাপ দেখা যায়। এটি ইহুদি রাষ্ট্রের ধারণাকে ঝাপসা করে দেয়। (যদিও অনেক ইসরায়েলি পূর্ব ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত হওয়ায় ইসরায়েল-ফিলিস্তিন কাহিনির সঙ্গে এর মিল থাকার ইঙ্গিত মেলে)

ছবিতে দেখা যায়, সুপারম্যানের বান্ধবী ও সাংবাদিক লোয়িস লেন ডেইলি প্ল্যানেট নামের একটি সংবাদমাধ্যমের জন্য তাঁর একটি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন। তিনি জানতে চান, কেন সুপারম্যান জারহানপুরের ওপর বোরাভিয়ার আক্রমণ থামিয়ে দিয়েছেন।

লোয়িস যুক্তি দেন, জারহানপুর তো সাধারণ জনগণের ওপর দমন-পীড়ন চালানো একটি স্বৈরশাসকের দেশ। সুতরাং সেখানে হস্তক্ষেপ বা অভিযান চালানো ন্যায্য হতে পারে।

কিন্তু সুপারম্যান সোজা বলে দেন, একটি দেশের ভেতরে নিপীড়ন বা স্বৈরতন্ত্র থাকলেই অন্য কোনো দেশের পক্ষে সেখানে আক্রমণ চালানোর যৌক্তিকতা হতে পারে না।

এই সংলাপে আসলে বর্তমান বিশ্বের বড় রাজনৈতিক বিতর্কের কথা বলা হচ্ছে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপমূলক পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এখানে ইঙ্গিত আছে। এই সংলাপে আমেরিকার হস্তক্ষেপ ও শাসন পরিবর্তনের যুদ্ধের বিরুদ্ধে সমকালীন রাজনৈতিক বিতর্ক ফুটে উঠেছে।

পরবর্তী সময়ে বোরাভিয়ার জারহানপুর আক্রমণের দৃশ্যে একটি ছোট ছেলেকে জাতীয় পতাকা ওড়াতে দেখা যায়। সেখানে ট্যাংক ও সশস্ত্র সেনারা এগিয়ে আসে এবং নিরস্ত্র বিক্ষোভকারীরা গুলির মধ্য দিয়ে পালাতে থাকে।

এ দৃশ্যটি ২০১৮-১৯ সালে গাজায় ইসরায়েলের বিভাজন প্রাচীরে ফিলিস্তিনিদের ‘গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন’ বিক্ষোভের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যেখানে ইসরায়েলি স্নাইপার গুলিতে ২০০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হন আট হাজারের বেশি।

সুপারম্যানকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে আমেরিকান শক্তির প্রতীক হিসেবে তৈরি করা হয়েছে। সুপারহিরোরা সবাই আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের প্রতীক না হলেও ‘সুপারপাওয়ার’ ধারণা (যা একজন চরিত্রকে লড়াইয়ের মাধ্যমে শত্রুদের পরাজিত করতে সাহায্য করে) আমেরিকান আদর্শের মূল। সুপারহিরোরা মানুষের রূপধারী এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান।

পরিচালক গানের আগের ‘গার্ডিয়ান্স অব দ্য গ্যালাক্সি’ মুভির হালকা কমেডির তুলনায় এই সুপারম্যান একজন সৎ আমেরিকান হিরো।

এখানে সুপারম্যান একটি গভীর সমস্যার মুখোমুখি হয়। সমস্যাটি হলো, কীভাবে সে বিশ্ব শান্তি বজায় রাখবে, যখন শান্তির শত্রু হলো আমেরিকা এবং তার আক্রমণাত্মক মিত্র?

একটি দরিদ্র গ্লোবাল সাউথ দেশকে আক্রমণ থেকে বাঁচানোর জন্য তার হস্তক্ষেপকে আমেরিকার শত্রুর বিরুদ্ধে অযৌক্তিক হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখা হয়।

সুপারম্যানকে বিপজ্জনক এলিয়েন হিসেবে ডেমোনাইজ করা হয় এবং বলা হয়, সে পৃথিবী দখল করতে চায় এবং মানুষকে দাস বানাতে চায়। এটি গ্রেট রিপ্লেসমেন্ট থিওরির ইঙ্গিতবাহী। এই গল্প প্রকাশিত হওয়ার পর মেট্রোপলিসের মানুষ তার বিরুদ্ধে চলে যায় এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

মুভিটি সামরিকশিল্প কমপ্লেক্স এবং ঔপনিবেশিকতার সমালোচনাও করে। লেক্স লুথর বোরাভিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করে জারহানপুরের একটি অংশ দখলের পরিকল্পনা করে, যা কিনা ট্রাম্পের গাজাকে ধ্বংস করে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়ারা’ (প্রমোদ কেন্দ্র) বানানোর স্বপ্নের মতো।

ছবির নায়কেরা হলো সুপারম্যান, করপোরেট-সমর্থিত জাস্টিস গ্যাংয়ের তিন সুপারহিরো এবং ডেইলি প্ল্যানেটের সাহসী সম্পাদকীয় টিম। তবে হলিউডের ভূরাজনৈতিক সমালোচনার একটি সীমা আছে। এখানে সামরিক প্রযুক্তি কমপ্লেক্সকে বৃহত্তর সাম্রাজ্যবাদী-রাজনৈতিক-মিডিয়া কমপ্লেক্সের অংশ হিসেবে দেখানো হয়নি, বরং কিছু খারাপ লোকের কাজ হিসেবে দেখানো হয়েছে।

গানের স্ক্রিপ্টে একটি দক্ষিণ এশীয় ব্যক্তিকে দেখানো হয়, যে কিনা সুপারম্যানকে সাহায্য করে কিন্তু পরে লুথরের হাতে ধরা পড়ে। তার ভাগ্য হলো সেসব সাধারণ মানুষের, যারা নিষ্ঠুর সাম্রাজ্যবাদী যন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করে প্রাণ দেয়। এটি মুভির সবচেয়ে বাস্তবতাঘনিষ্ঠ মুহূর্ত।

ইসরায়েল ও তার সমর্থকেরা এই মুভিটি পছন্দ করেনি। ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডিস্ট বেন শাপিরো শুধু লিখেছেন, ‘ভালো না।’

যদি ছবিটি শুধু এক্সপ্লোশন, মনস্টার ফাইট এবং আকাশে ঘুষাঘুষির পেছনের থিমগুলোকে আরও গভীরভাবে তুলে ধরত, তাহলে এটি আরও শক্তিশালী হতো। নিউইয়র্ক টাইমস ঘরানার মিডিয়া বা মেইনস্ট্রিম টিভি চ্যানেল যদি কোনো আমেরিকা-সমর্থিত রাষ্ট্রের আক্রমণ ও ভূখণ্ড দখলের পরিকল্পনা উন্মোচন করে, সেটি অবিশ্বাস্য।

বাস্তবে তারা সত্যি গোপন করে ভিকটিমদের সন্ত্রাসী এবং আক্রমণকারীকে ‘আত্মরক্ষাকারী’ হিসেবে উপস্থাপন করে।

মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার মিত্র সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে আদিবাসীদের বাঁচানোর যে ধারণা দেখানো হয়েছে, তা অবাস্তব। তাই এটি নাটকীয়ভাবে দর্শকমনে প্রভাব ফেলতে পারেনি।

বাস্তবতা হলো, ফিলিস্তিনিরা কোনো পশ্চিমা সুপারহিরোর জন্য অপেক্ষা করছে না। তাদের মিত্র হলো বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষ, যারা তাদের মুক্তি এবং গণহত্যার অবসান চায়। আসল সুপারহিরোরা হলো সেই সাহসী মানুষেরা, যারা সাহায্যের কনভয়ে জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং ফিলিস্তিনি মেডিকেল ও সহায়তাকর্মীরা, যারা ইসরায়েলের অবরোধের মধ্যে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করে।

একদিন হয়তো হলিউডে এই বাস্তব নায়কদের দেখানো হবে। তবে সেই দিন কবে আসবে, তা বলা কঠিন।

* জো গিল, লন্ডন ভেনেজুয়েলা ও ওমানে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, মর্নিং স্টার ও মিডল ইস্ট আই-এর মতো সংবাদপত্রে কাজ করেছেন
- মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সদ্য মুক্তি পাওয়া সুপারম্যান সিনেমার একটি দৃশ্য।
সদ্য মুক্তি পাওয়া সুপারম্যান সিনেমার একটি দৃশ্য। ছবি: ডিসি স্টুডিওস

No comments

Powered by Blogger.