গাজায় দুর্ভিক্ষে শুরু হচ্ছে মৃত্যুর ঢেউ: কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, ইসরাইলের উন্মাদ পরিকল্পনা
সাম্প্রতিক দিনগুলোতে প্রচণ্ড তাপদাহ এই সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে বলে মনে করছেন চিকিৎসকরা। এ খবর দিয়েছে ইসরাইলের প্রভাবশালী পত্রিকা অনলাইন হারেৎজ। গাজার আল-শিফা হাসপাতালে শুক্রবার কর্মকর্তারা জানান, শত শত রোগী মারাত্মক অনাহারের উপসর্গ নিয়ে আসছেন। তার মধ্যে বহু শিশু ও নবজাতকের অবস্থা সংকটাপন্ন। মুয়াসি মানবিক অঞ্চলের ফিল্ড হাসপাতালের পরিচালক ডা. সুহাইব আল-হামস সতর্ক করে বলেন, পুষ্টির অভাবে অঙ্গ বিকল হয়ে শিগগিরই মৃত্যুর ঢেউ শুরু হতে পারে। রাস্তায় পড়ে থাকা বহু মানুষকে আমরা এখানে আনছি, যাদের ওষুধের আগেই খাবারের প্রয়োজন।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, উপত্যকায় প্রায় ১৭০০০ শিশু ভয়াবহ অপুষ্টিতে ভুগছে। দুর্ভিক্ষে এ পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬২০ জনে। এর মধ্যে কমপক্ষে ৬৯টি শিশু। শুক্রবার দেইর আল-বালাহ এলাকায় ১৮ মাস বয়সী এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে সরাসরি পুষ্টি ঘাটতির কারণে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও গাজায় কার্যরত আন্তর্জাতিক মানবিক সংস্থাগুলো সতর্ক করেছে যে হাসপাতালগুলোতে আর কোনো খালি বেড, পর্যাপ্ত চিকিৎসা সরঞ্জাম বা ওষুধ নেই- ক্রমবর্ধমান রোগীর স্রোত সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে। মানবিক সংস্থার প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, চলমান অবরোধ ও পর্যাপ্ত সাহায্যের অভাবই এই ক্ষুধা সংকটকে ভয়াবহ রূপ দিয়েছে। অনেকেই গাজার পরিস্থিতিকে দারফুর ও সোমালিয়ার ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সঙ্গে তুলনা করেছেন।
হামাস শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছে, গাজায় এই দুর্ভিক্ষ ও অবরোধ হলো মানবতার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত অপরাধ। তারা ইসরাইলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে যে, সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে খাদ্য ও পানি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিবৃতিতে বলা হয়, সামরিক ব্যর্থতার পর এখন একমাত্র সমাধান হলো একটি চুক্তি। হামাসের গণমাধ্যম শাখা ইউরোপীয় ইউনিয়নকেও তীব্র সমালোচনা করে বলেছে, তারা গণহত্যার নৈতিক ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা করছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়- ইসরাইলি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং আন্তর্জাতিক বিচারের আওতায় আনার জন্য। >> হারেৎজের রিপোর্ট
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, অবৈধ নির্দেশ ও যুদ্ধাপরাধ: ইসরাইলের উন্মাদ পরিকল্পনা
গাজার দক্ষিণে মিশর সীমান্তসংলগ্ন এলাকায় প্রায় ৬ লাখ ফিলিস্তিনিকে জোরপূর্বক একটি বিশেষ শিবিরে (যা তারা ‘মানবিক শহর’ বলছে) আটকে রাখার পরিকল্পনা নিয়ে প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজের ঘোষণার পর বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি কেবল গণউচ্ছেদ ও জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতি নয়, বরং যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। কাটজ প্রকাশ্যে জানান, গাজার রাফাহ এলাকায় ৬ লাখ মানুষের জন্য একটি ঘনবসতিপূর্ণ ‘মানবিক শহর’ গড়ে তোলা হবে। সেখানে যেসব মানুষকে পাঠানো হবে, তাদেরকে হয় সেখান থেকে বিদেশে পাঠানো হবে অথবা খাবার ও পানির অভাবে থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ইতিমধ্যেই সেনাবাহিনীকে এই পরিকল্পনার বাস্তবায়ন পরিকল্পনা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন হারেৎজ।
ইসরাইলি সরকার পরিকল্পনাটিকে ‘মানবিক বলে প্রচার করলেও বাস্তবে এটি কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদলে তৈরি হবে বলে সমালোচকরা মনে করছেন। সেখানে কোনো পর্যাপ্ত পানি, বিদ্যুৎ বা অবকাঠামো থাকবে না। মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে তাঁবুতে থাকতে হবে এবং এলাকা ছাড়ার অনুমতি থাকবে না। তবে শুধু বিদেশে চলে যাওয়ার শর্তে তাদেরকে সেখান থেকে ছাড়া হবে। ইসরাইলের ১৬ জন শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ এক যৌথ চিঠিতে বলেছেন, এটি সুস্পষ্টভাবে অবৈধ আদেশ, যা ইসরাইলি সেনাদের কালো পতাকা নীতি অনুযায়ী অমান্য করার অধিকার আছে। তারা সতর্ক করেছেন, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে ‘যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ, এমনকি নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে গণহত্যার পর্যায়ে’ পড়তে পারে।
সামরিক সাবেক গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিখায়েল মিলস্টেইন বলেছেন, রাফাহ থেকে সমুদ্র পর্যন্ত যে ফিলিস্তিনি করিডোর, সেখানে ৬ থেকে ৭ লাখ মানুষকে রাখা একেবারেই অসম্ভব। কোনো ঘরবাড়ি নেই, পানি বা বিদ্যুতের নেটওয়ার্ক নেই- ফলস্বরূপ মানবিক বিপর্যয় আরও তীব্র হবে। এই পরিকল্পনা মিশরের জন্যও হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। কায়রো ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, সীমান্তে এই ধরনের শিবির মিশরের নিরাপত্তার জন্য সরাসরি ঝুঁকি তৈরি করছে, যা দুই দেশের সম্পর্ককে আরও খারাপ করছে। ইসরাইলের ভেতরেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী এহুদ ওলমার্টসহ বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি- একে জাতিগত নিধন এবং কনসেনট্রেশন ক্যাম্প হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। মূলধারার মিডিয়াও ‘জনসংখ্যা পাতলা করা’ বা ‘কনসেন্ট্রেশন’ শব্দ ব্যবহার না করে পরিকল্পনাটি ব্যাখ্যা করতে পারছে না।
এ অবস্থায় প্রশ্ন থেকে যায় ১. এই পরিকল্পনা কি আদৌ বাস্তবায়িত হবে, নাকি সেনাবাহিনীর অনীহার কারণে থেমে যাবে? ২. যদি এগিয়ে যায়, তবে কি এটি গাজায় নতুন করে সামরিক শাসন কায়েমের পথ প্রশস্ত করবে, যেটি ধর্মীয় জায়নিস্ট মন্ত্রীরা দীর্ঘদিন ধরে দাবি করছেন? ৩. আন্তর্জাতিক আদালত ও মানবাধিকার সংস্থাগুলো কি এই পরিকল্পনার বিরুদ্ধে জরুরি পদক্ষেপ নেবে, নাকি বিশ্ব আবারও নীরব থাকবে?

No comments