আমলারা কি নিজেরাই একটা ‘পার্টি’ by নাহিদ হাসান

৪ মে থেকে ট্রেনে দূরত্বভিত্তিক রেয়াত বাতিলের বছর পূর্তি হলো। কুড়িগ্রাম থেকে ঢাকার ট্রেনের ভাড়া শোভন চেয়ারে আগে যেখানে ছিল ৫০৫ টাকা, তা হয় ৬৮৪ টাকা এবং স্নিগ্ধা ৮৮৪ টাকা থেকে বাড়ে ১ হাজার ২২৫ টাকা। একই অবস্থা ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটেও। মানে গাজীপুরের লোক যে ভাড়ায় রাজধানীতে আসবে, কুড়িগ্রাম ও কক্সবাজারের লোক সেই ভাড়ায় পারবে না।

সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থান বলতে কেবল বুঝেছে শিল্পকলা একাডেমিকে একটি সংগঠনের হাতে ছেড়ে দেওয়া। আর সারা দেশে বাউলসন্ধ্যা করা। এগুলো সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গেই হয়। তার জন্য অভ্যুত্থান লাগে না। অভ্যুত্থান লাগে উপজেলায়, হাটে ও বটতলায় জনগণকে যুক্ত করে সাংস্কৃতিক জাগরণে।

সাগর থেকে তেল-গ্যাস সংগ্রহের উদ্যোগ নেই। জ্বালানিতে হাসিনার নীতিই বহাল। রেল কারখানাও তথৈবচ।

হাট–ঘাটের ইজারা বাতিলের আলাপই নেই। ৬০-৭০ শতাংশ কৃষকের পণ্যের দাম কীভাবে নির্ধারিত হবে? ইলিশ ছাড়াও পৈরালি, বাগাড়, পাঙাশ যে মাছ, সেই মাছের বংশবৃদ্ধির জন্য নদ–নদী রক্ষার উদ্যোগ আর কবে হবে?

------ দুই.

বিসিএসে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকে ক্যাডার হিসেবে না রেখে এ দুই ক্যাডারকে আলাদা করার সুপারিশ করেছে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন। এ বিষয়ে সংস্কার কমিশনের প্রধান আবদুুল মুয়ীদ চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারটা অযৌক্তিক। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা আলাদা। আমরা সুপারিশ করছি, এটি ক্যাডার রাখা যাবে না। যেমন একজন চোখের চিকিৎসক, একজন দাঁতের চিকিৎসক, আরেকজন জেনারেল ফিজিশিয়ান—পদোন্নতি কি
তাঁরা একসঙ্গে পাচ্ছেন? পাচ্ছেন না। সে জন্য আমরা বলেছি, এটা ক্যাডারে রাখা যাবে না। এগুলোকে আলাদা করতে হবে। বেতন বাড়িয়ে দেওয়া হোক, এটা বিশেষায়িত বিভাগ। এই দুই বিভাগ ছাড়া বাকি সবই ক্যাডার থাকতে পারবে।’

এই সুপারিশ বাতিল চেয়ে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ক্যাডারের কর্তারা মাঠে নেমেছিলেন। গত ৪ জানুয়ারি ‘আন্তক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’–এর ব্যানারে ঢাকাতেও সমাবেশ হয়। এর আগে উপসচিব পদে পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডারের কোটা কমিয়ে ৫০ শতাংশ করায় তাঁরা কলমবিরতি দিলেন। এরপর বাকি ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা কর্মসূচি দিয়েছেন।

সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকার ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ জারি করেছে। অধ্যাদেশে বলা হয়েছে,  ‘এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন, অন্য যেকোনো কর্মচারীকে তাঁর কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তাঁর কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন এবং যেকোনো সরকারি কর্মচারীকে তাঁর কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।’ অধ্যাদেশে এসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে বলা হয়েছে, দোষী কর্মচারীকে নিম্ন পদ বা নিম্ন বেতন গ্রেডে নামিয়ে দেওয়া, চাকরি থেকে অপসারণ বা চাকরি থেকে বরখাস্ত করার দণ্ড দেওয়া যাবে।

সরকারি কর্মচারীরা এই অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। তাঁরা কি কোনো সংস্কারই মানবেন না? তাঁরা নিজেদের ‘পার্টি’ বলে মনে করছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে অভ্যুত্থানের আগের আর পরের পরিস্থিতি সমান? ১ হাজার ৪০০ শহীদ আর অর্ধলাখের পঙ্গুত্ববরণের অর্থ কী? আহমদ ছফা লিখেছিলেন, ‘আমলারা নিজেরাই একটা পার্টি। কারণ, সরকার যায় সরকার আসে, তারা থেকে যায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো। আমলারা কিছুই বদলায়নি।’

১৮৮৫ সালে একজন ব্রিটিশ আমলার নেতৃত্বে কংগ্রেস গড়ে উঠল। এরপর মুসলিম লীগ হলো। আমলারা ঠিক করলেন রাজনীতিবিদেরা কেমন হবেন। তার আগে বাংলা ও ভারতজুড়ে যে কৃষক বিদ্রোহ ও স্বাধীনতার লড়াই হয়েছে, সেগুলোর নেতারা ছিলেন এই ভূখণ্ডের উপযোগী। নেতারা ছিলেন মূলত কৃষকই।

আওয়ামী ১৬ বছরে আমলারা এমপি নির্বাচন করেছেন। ডিসিরা ১৮ সালের পর বলতেন, তাঁরা এমপিদের বানিয়েছেন। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর সংস্কার প্রস্তাবগুলো আমলারা মানতে পারছেন না।

এম আর আখতার মুকুল মুজিবের রক্ত লাল গ্রন্থে লিখেছেন, ‘ফিদেল কাস্ত্রো নাকি শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেছিলেন, “কেননা, আপনি বাংলাদেশে একটা পরাজিত প্রশাসনকে আইনসংগত করেছেন। এক্সেলেন্সি, আপনি কিন্তু নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন।”

আমলা নামের পার্টির সংস্কার ছাড়া বদলাবে না কিছুই। আমলারা হয়তো জানেন না, অভ্যুত্থান কোনো ভোজসভা নয়!

নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক। ই–মেইল: nahidknowledge1@gmail.com
(মতামত লেখকের নিজস্ব)

আমলারা কি নিজেরাই একটা ‘পার্টি’

No comments

Powered by Blogger.