যুক্তরাষ্ট্র নেই, ইউরোপ কি একা পুতিনকে রুখতে পারবে by সের্হেই মাইডুকোভ
কিছুদিন আগেও ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় মিত্র ছিল যুক্তরাষ্ট্র। তারা অস্ত্র, অর্থ ও কূটনৈতিক সহায়তা দিয়ে ইউক্রেনকে সাহায্য করত। কিন্তু এখন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধ ট্রাম্পকে আর তেমন ভাবায় না। তিনি রাশিয়ার কথাই বারবার বলছেন। ন্যাটোকে তুচ্ছ করেছেন। ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা নিয়ে রসিকতা করেছেন। যদিও পুতিন সম্প্রতি বলেছেন ‘পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে’।
ট্রাম্প আর ইউক্রেনের সমর্থক নন। তিনি কোনো গ্রহণযোগ্য শান্তি-উদ্যোক্তা হয়ে ওঠেননি। সব মিলিয়ে ইউক্রেন বিষয়ে তাঁর কথার এখন তেমন মূল্য নেই। তবে এসবের খেসারত দিচ্ছে ইউক্রেন। দুই সপ্তাহ আগে ইউক্রেন শুরু করেছে ‘অপারেশন স্পাইডারওয়েব’। রাশিয়ার ভেতরে ড্রোন হামলার মাধ্যমে ডজনখানেক বিমানঘাঁটি ও সামরিক স্থাপনা ধ্বংস করা হয়েছে। হোয়াইট হাউস দ্রুতই জানায় যে এতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ট্রাম্প আবার বললেন, তিনি যুদ্ধ থেকে ‘সরে যাবেন’।
এই ঘটনার পর ইস্তাম্বুলে দ্বিতীয় দফা শান্তি আলোচনা ভেঙে পড়ে। একমাত্র চুক্তি হয়, ছয় হাজার মৃত সেনার মরদেহ বিনিময়। এর মধ্যেই ট্রাম্পের তরফে হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র জানালেন, তিনি চান জেলেনস্কি ও পুতিন সরাসরি কথা বলুন। তবে তখন সময় পেরিয়ে গেছে।
২০২২ সালে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরও বহুবার দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে চাপ দিয়েছে, রাশিয়াকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেছে। ইউরোপীয় নেতারা কিছুটা প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু ইউরোপের নিরাপত্তার পুরো দায় কাঁধে তোলেননি। এখন যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তা কমছে। ট্রাম্প নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন। ইউরোপ পড়েছে ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে। ইউরোপ এখন একা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তৈরি হওয়া ন্যাটো জোটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। রুশ আগ্রাসন ঠেকাতে ইউক্রেনের সবচেয়ে বড় ভিত্তি ইউরোপের প্রতিশ্রুতি।
প্রশ্ন হলো, এই সময়ের দাবি কি ইউরোপ পূরণ করতে পারবে? ইউরোপের দেশগুলো কি যুক্তরাষ্ট্র ছাড়াই একটি কার্যকর নিরাপত্তা জোট গড়তে পারবে? তা কি সম্ভব?
২০২৫ সালের শুরুতে ইউক্রেন নিজে প্রায় ৪০ শতাংশ সামরিক চাহিদা পূরণ করছিল। বাকি ৩০ শতাংশ দিচ্ছিল ইউরোপ, ৩০ শতাংশ আসছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আগে ইউক্রেনের প্রয়োজনীয় গোলাবারুদ যুক্তরাষ্ট্র জোগাত। ইউরোপ মরিয়া হয়ে ঘাটতি পূরণের চেষ্টা করছে। কিন্তু ইউরোপের অস্ত্রশিল্প অনেক দিন ধরে পিছিয়ে আছে। ২০২৫ সালের শেষ নাগাদ ২০ লাখ কামান গোলা তৈরি করবে ইউরোপ; যা ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রের সর্বনিম্ন চাহিদা মাত্র। রাশিয়া যদি ইউক্রেন দখল করে, তবে কেবল জার্মানিরই খরচ হবে বর্তমান সহায়তার ১০ থেকে ২০ গুণ বেশি। কারণ হবে শরণার্থী স্রোত, জ্বালানিসংকট, অর্থনৈতিক অস্থিরতা ও নিরাপত্তা হুমকি। একটি বড় উদ্যোগ নিচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্র।
২০২৬ সালের শেষ নাগাদ তারা ইউক্রেনকে ১৮ লাখ কামান গোলা সরবরাহ করবে। এই প্রকল্পে কানাডা, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, ডেনমার্কসহ বেশ কিছু দেশ অংশ নিচ্ছে। এটি সময়মতো পৌঁছালে যুদ্ধের গতিপথে প্রকৃত পরিবর্তন আনতে পারে। মে মাসের শেষ দিকে জার্মানি আর ইউক্রেন এক চুক্তি করেছে। এর মাধ্যমে ইউক্রেনেই দীর্ঘ পাল্লার অস্ত্র তৈরি করা হবে স্থানীয় শিল্প ও প্রকৌশল দক্ষতা কাজে লাগিয়ে। ইউক্রেনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মিত্র ব্রিটেন ঘোষণা করেছে ৩৫০ মিলিয়ন পাউন্ডের নতুন ড্রোন প্যাকেজ। এই প্যাকেজ ২০২৬ সালের মধ্যে ১ লাখ ড্রোন সরবরাহ করবে।
সম্প্রতি ট্রাম্প ফক্স নিউজে বলেন, ইউক্রেনে আমেরিকানদের করের টাকা ‘অপচয়’ হচ্ছে। মন্তব্যটা বিভ্রান্তিকর। যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ সাল থেকে ইউক্রেনকে প্রায় ১২৮ বিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েছে। এর মধ্যে ৬৬.৫ বিলিয়ন সামরিক সহায়তা। ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সদস্যদেশগুলো ১৩৫ বিলিয়ন ইউরো দিয়েছে—৫০ বিলিয়ন সামরিক, ৬৭ বিলিয়ন আর্থিক ও মানবিক, ১৭ বিলিয়ন ইউরো শরণার্থী সহায়তা। যুক্তরাজ্য দিয়েছে আরও ১২.৮ বিলিয়ন পাউন্ড। এসব কোনো দান নয়। এগুলো কৌশলগত বিনিয়োগ। রাশিয়া যুদ্ধে জিতলে এই দেশগুলোর লোকসান হবে আরও বেশি।
ইউরোপ নেতৃত্ব দিচ্ছে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্রেও। ২০১৪ সাল থেকে, বিশেষ করে ২০২২-এর পর রাশিয়ার অর্থনীতিকে লক্ষ্য করে ১৭ দফা নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এতে যুদ্ধ না থামলেও রাশিয়ার ওপর চাপ বেড়েছে। ২০ মে ট্রাম্প ও পুতিনের ফোনালাপের পরদিনই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাজ্য সবচেয়ে বিস্তৃত নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ ঘোষণা করে।
বিশ্লেষণ বলছে, এই নিষেধাজ্ঞা যদি কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা যায়, তবে রাশিয়ার বার্ষিক ক্ষতি হবে ১০ থেকে ২০ বিলিয়ন ডলার। এমনকি এর আংশিক প্রয়োগেও যুদ্ধের অর্থনীতিতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।
ইইউর পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কাইজা কাল্লাস বলেছেন, ‘যত দিন রাশিয়া যুদ্ধ চালাবে, তত কঠিন হবে আমাদের জবাব।’ এখন ইউরোপকে শুধু কথায় নয়, কাজে তা প্রমাণ করতে হবে। ড্রোন থেকে কামান, নিষেধাজ্ঞা থেকে অস্ত্র উৎপাদন—ইউরোপ এখন ধীরে ধীরে বক্তব্য থেকে কৌশলে রূপ নিচ্ছে। কিন্তু এই গতি থামা চলবে না। এটি আর শুধু ইউক্রেনের যুদ্ধ নয়।
যুক্তরাষ্ট্র সরে গেছে। ইউরোপ আর যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নয়। সেই এখন শেষ প্রতিরক্ষা। যদি ইউরোপ ব্যর্থ হয়, ইউক্রেনও ব্যর্থ হবে। আর সেই সঙ্গে ধূলিসাৎ হবে স্বাধীন ও নিরাপদ ইউরোপের স্বপ্ন।
● সের্হেই মাইডুকোভ, ইউক্রেনীয় লেখক
- আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ
![]() |
| রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফাইল ছবি: রয়টার্স |

No comments