ইনফান্তিনো-ট্রাম্প ‘ব্রোমান্স’–এর ভেতরে কী আছে

প্রায় সাত বছর আগের কথা। ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন প্রথম মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। জিয়ান্নি ইনফান্তিনো হোয়াইট হাউসে তাঁর ওভাল অফিসে গিয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে ফুটবলের লাল ও হলুদ কার্ডের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।

ইনফান্তিনো তত দিনে ফিফা সভাপতি হলেও বৈশ্বিকভাবে তেমন পরিচিতি পাননি। কয়েক সপ্তাহ আগে ২০১৮ বিশ্বকাপের আয়োজন শেষ করেছেন। ২০১৫ সালে ফিফায় সংকটের পরের বছর ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটির দায়িত্ব পান।

২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব যুক্তরাষ্ট্রের পাওয়ার পেছনে ইনফান্তিনোর প্রচেষ্টার জন্য তখন এই সুইস-ইতালিয়ানের ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন ট্রাম্প। তবে এই বলে অনুযোগও করেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে বিশ্বকাপ যখন আয়োজিত হবে, তখন তিনি প্রেসিডেন্ট অফিসে থাকবেন না। আর না থাকলে তাঁর ভাষায়, ‘সংবাদমাধ্যম হবে খুব বিরক্তিকর।’ তিনি না থাকলে ২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের লগ্নে হোয়াইট হাউসকেন্দ্রিক সংবাদমাধ্যম কেমন হবে, তা নিয়ে ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া ছিল, ‘খুব বিরক্তিকর হবে। ওদের হয়তো কোনো কাজই থাকবে না।’

ট্রাম্পের এ কথাগুলোর ফাঁকেই ইনফান্তিনো তাঁর কাজ সেরে নেওয়ার চেষ্টা করেন। যুক্তরাষ্ট্র প্রেসিডেন্টের জন্য উপহার হিসেবে নিয়ে আসা লাল ও হলুদ কার্ড দেখিয়ে ফিফা সভাপতি বলেন, ‘হলুদ কার্ড হলো সতর্ক করে দেওয়ার জন্য। আর যখন আপনি কাউকে বের করে দিতে চাইবেন...এভাবে’—বলে লাল কার্ড উঁচিয়ে ধরেন ইনফান্তিনো। ট্রাম্পকে দেখে বেশ উৎফুল্ল মনে হয়েছিল। ইনফান্তিনোর কাছ থেকে লাল কার্ডটি নিয়ে তিনি সেটা উপস্থিত সংবাদকর্মীদের দেখান।

সুইস আইনজীবী ইনফান্তিনোর বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বেসর্বা হিসেবে উত্থান অসাধারণ এক গল্প। ফিফা সভাপতির ভিত তৈরি হয়েছে ট্রাম্পের পৃষ্ঠপোষকতায় যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বিশ্বকাপ আয়োজন এবং সৌদি আরবকে ২০৩৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব দেওয়ার মাধ্যমে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমানের বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব পাওয়ার পথটা ট্রাম্পই সুগম করে দিয়েছেন বলে গুঞ্জন আছে।

২০১৮ সালে ট্রাম্পের সঙ্গে সেই বৈঠক থেকে একটি বিষয় শিখে নিয়েছিলেন ইনফান্তিনো—ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে এবং জনসমক্ষে কীভাবে সামলাতে হবে। সে বিদ্যাটা এখনো কাজে লাগাচ্ছেন ফিফা সভাপতি। চলতি সপ্তাহেই ট্রাম্পের সঙ্গে তিনি বসেছিলেন।

গত বৃহস্পতিবার জুভেন্টাসের খেলোয়াড় ও ম্যানেজমেন্টের সঙ্গে হোয়াইট হাউসে গিয়েছিলেন ইনফান্তিনো। ট্রাম্প জুভেন্টাসের দুই যুক্তরাষ্ট্রের খেলোয়াড় ওয়েস্টন ম্যাকেনি ও টিমোথি উইয়াহর সঙ্গে হাত মেলান। এরপর ট্রাম্পের চারপাশে দাঁড়ান জুভেন্টাসের খেলোয়াড়, ম্যানেজমেন্ট ও ইনফান্তিনো। ট্রাম্প তখন ক্লাব বিশ্বকাপের প্রসঙ্গে আর যাননি, এর চেয়ে ইরান-ইসরায়েল সংঘাত এবং সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভূমিকা নিয়ে কথা বলতেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি।

তবে কিছুক্ষণ পরপরই বিভিন্ন বিষয় জানতে মুখ ফিরিয়েছেন তাঁর বন্ধু ইনফান্তিনোর প্রতি। জুভেন্টাসের ম্যাচে টিকিট অপ্রতুলতা নিয়ে কথা বলেছেন। মজাও করেছেন। ট্রাম্প যতবার মজা করেছেন, ইনফান্তিনো ততবারই জানতেন কী করতে হবে। ফিফার দুটি টুর্নামেন্ট সেখানে আয়োজনের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার ওপর বারবার গুরুত্ব আরোপ করেছেন ইনফান্তিনো।

২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনে ট্রাম্পের কাছ থেকে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক সাহায্য পেয়েছেন ইনফান্তিনো। এমনকি তাঁর ব্যক্তিগত প্রজেক্টেও—৩২ দলের ফিফা ক্লাব বিশ্বকাপ—যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন তিনি পেয়েছেন। এই ক্লাব বিশ্বকাপ আসলে উয়েফা ও ইউরোপিয়ান লিগগুলোর সূচির বিরুদ্ধাচরণ করে আয়োজিত টুর্নামেন্ট। এটা বলাই যায়, ফিফা সভাপতির আদেশে এটা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বিঘ্ন সৃষ্টিকারী টুর্নামেন্ট।

এই টুর্নামেন্ট কতজন দেখছেন, কতজন স্ট্রিম করছেন, সেসব অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। ইনফান্তিনো বিশ্বের অন্যতম ক্ষমতাধর দুজন মানুষের সঙ্গে নিজের ক্ষমতা একীভূত করতে পেরেছেন, তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বকাপ নিয়ে সংবাদমাধ্যমের সামনে বসেছেন। টিফানি অ্যান্ড কোম্পানির ডিজাইন করা ক্লাব বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে পোজ দিয়েছেন। ইনফান্তিনোর ভূয়সী প্রশংসা করেছেন আর ক্রাউন প্রিন্স বিন সালমান করেছেন আরও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তিনি পুরো আয়োজনের খরচ মিটিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইনফান্তিনো এ পর্যন্ত আসতে পারলেন কীভাবে? মানে ট্রাম্পের কাছাকাছি।

ফিফায় দুর্নীতির পর ইনফান্তিনোর উত্থান

১০ বছর আগে ফিফা সভাপতি সেপ ব্লাটারের দুর্নীতির জঞ্জাল থেকে উত্থান ইনফান্তিনোর। উয়েফার সাবেক সভাপতি মিশেল প্লাতিনিও তাঁর সাবেক ‘বস’। তিনি ফিফার সর্বময় ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হন বিখ্যাত ‘ফিফা ২.০’ টিকিট দিয়ে—ফিফাকে অতীতের সব দুর্নীতিমুক্ত করার প্রতিশ্রুতি দেন।

২০১৮ ও ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব নিশ্চিত হয়েছিল ২০১০ সালের ভোটাভুটিতে। তখন যুক্তরাষ্ট্র ২০২২ বিশ্বকাপ আয়োজনের প্রার্থী হলেও তাদের স্বপ্নপূরণ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন এ নিয়ে আগ্রহী ছিলেন এবং জুরিখের সেই ভোটাভুটিতে তিনিও ছিলেন, যেখানে প্রথম রাউন্ডে ফিফার নির্বাহী কমিটির মাত্র তিনটি ভোট পেয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। পাঁচ বছর পর কি দেখা গেল?

২০১৫ সালের ২৭ মে জুরিখের এক হোটেল থেকে ফিফার নির্বাহীদের গ্রেপ্তার করে সুইস পুলিশ। এফবিআইয়ের ফিফা বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযানের অংশ ছিল সে গ্রেপ্তার কার্যক্রম। এর মাধ্যমে ফিফায় ব্লাটারের প্রশাসনিক কার্যক্রমও ভেঙে পড়ে।
২০১৫ সালের মে মাসের সেই ঘটনার পর ফিফা ক্লিনটনের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয় এবং ‘ফিফা ২.০’ কার্যক্রম শুরু করে। এর অংশ ছিলেন ক্লিনটনের কয়েকজন সাবেক উপদেষ্টা যাঁরা তাঁর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ২০২২ বিশ্বকাপের প্রার্থিতায় কাজ করেছেন।

সে বছরই পরবর্তী সময়ে ভোটের মাধ্যমে ফিফার সংস্কার কমিটিতে জায়গা পান ইনফান্তিনো এবং পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে ফিফার সভাপতি হন। আট মাস পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনকে হারিয়ে ক্ষমতাসীন হন ডোনাল্ড ট্রাম্প।

ট্রাম্পের ইচ্ছাপূরণ করেন ইনফান্তিনো

২০২৬ বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশকে দেওয়ার প্রয়োজন ছিল ইনফান্তিনোর। তিনি প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর প্রথম যে বিশ্বকাপ আয়োজনের স্বত্ব দেওয়া হয়, সেটাও ২০২৬ বিশ্বকাপ। বড় বড় বাণিজ্যিক চুক্তি ও আন্তর্জাতিক বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোকে ফিফায় ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন ছিল ইনফান্তিনোর। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনেরও প্রয়োজন ছিল ফিফার। ট্রাম্প নিজেও এটা পছন্দ করেছেন, যেমনটা তিনি পছন্দ করেন ইনফান্তিনোকে। এর পেছনে আরেকটি কারণ হতে পারে ট্রাম্পের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ১৯ বছর বয়সী ব্যারন ফুটবলভক্ত। সে হয়তো বাবাকে বলেছে ইনফান্তিনো ফুটবলে কত বড় মানুষ!

২০২৬ বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়ার ব্যাপারটি ট্রাম্প খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। এ কারণে পারিবারিক সদস্যকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করেন। হোয়াইট হাউসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সকার ফেডারেশন এর যোগাযোগের মাঝে সেতুবন্ধ ছিলেন ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনার। এই বিশ্বকাপ আয়োজনে ট্রাম্প বাকি দুটি সহ–আয়োজক দেশের নাম সংবাদমাধ্যমের সামনে খুব কমই উল্লেখ করেছেন। কিন্তু গত মাসে হোয়াইট হাউসে সংবাদ সম্মেলনে ইনফান্তিনো সুযোগটি নিয়ে দুটি সহ–আয়োজক দেশের নামও উল্লেখ করেন, পরে যার প্রশংসাও করেন ট্রাম্প।

২০১৯ সালে দাভোস সম্মেলনে ট্রাম্পকে অতিথি করেছিলেন ইনফান্তিনো। সে বছর যুক্তরাষ্ট্র নারী ফুটবল দলের একাংশ হোয়াইট হাউসে যেতে অস্বীকৃতি জানানোর পর সেটাও সামাল দেয় ইনফান্তিনো প্রশাসন। ফিফা কংগ্রেসে ২০২৬ বিশ্বকাপের আয়োজক হিসেবে মরক্কোর দ্বিগুণ ভোট পায় যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ ট্রাম্পের ইচ্ছাপূরণ করেন ইনফান্তিনো।

ইনফান্তিনোর ঝুঁকিও আছে

২০১৮ সালে ট্রাম্প অনুযোগ করেছিলেন, ফিফা বিশ্বকাপ আসতে আসতে তিনি হয়তো হোয়াইট হাউসে থাকবেন না। কিন্তু গত বছর ডিসেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন জিতে তিনি ক্ষমতায় আসার পর ফের চাঙা হয় দুজনের সম্পর্ক। ট্রাম্পের আরও কাছে যাওয়া এবং তাঁর ব্যক্তিগত বলয়ে ঢোকার কোনো সুযোগ নষ্ট করেননি ইনফান্তিনো। এমনকি ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য সফরে বেশি সময় কাটানোর কারণে গত মে মাসে প্যারাগুয়েতে তিনি নিজের অনুষ্ঠান ফিফা কংগ্রেসেও সময়মতো উপস্থিত হতে পারেননি।

ইনফান্তিনো হয়তো বলতে পারেন, তাঁকে ট্রাম্পের নিয়মনীতি মেনে চলতে হয়েছে। আগামী ১৩ মাসের জন্য ফিফা আসলে যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ‘বিবাহবন্ধনে’ আবদ্ধ। ২০২৬ বিশ্বকাপের বাণিজ্যিক সাফল্য ইনফান্তিনোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ফিফা সভাপতির ক্ষমতা ধরে রাখতে ২১১টি সদস্যদেশকে রাজস্ব এনে দেওয়া ইনফান্তিনোর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। ট্রাম্প তাঁর শক্তিশালী মিত্র। তবে প্রয়োজনে ট্রাম্প যে ইনফান্তিনোর পাশ থেকে সরে যেতে কার্পণ্য করবেন না, সেটাও সত্যি। ইনফান্তিনোর তাই ঝুঁকিও আছে।

তবে ইনফান্তিনোও ট্রাম্পকে খুব ভালোভাবে জানেন। পর্দার আড়ালে ট্রাম্প প্রশাসনের ভিসা নীতি শিথিল ও কর মওকুফ করতে হবে ফিফাকে। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা ব্যক্তির সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ার বিকল্প নেই ইনফান্তিনোর। এই ব্যবসায়িক সম্পর্ক তাঁর বিন সালমানের সঙ্গেও আছে।

২০২৬ বিশ্বকাপে কোনো স্থানীয় আয়োজক কমিটি নেই, যেটা ’৯৪ বিশ্বকাপে ছিল যুক্তরাষ্ট্রে। বিশ্বকাপ আয়োজনে ফিফা মায়ামিতে অফিস নিয়ে নিজেরাই পরিকল্পনা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের সকার ফেডারেশনও এই পরিকল্পনায় খুব একটা নেই। গত মাসে ট্রাম্পের ঘোষিত টাস্কফোর্সের প্রধান অ্যান্ড্রু জিউলিয়ানির—তিনি আবার ট্রাম্পের বন্ধুর ছেলে—সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ফিফার। সব মিলিয়ে আগামী ১৩ মাসে ফিফা কোন পথে এগোবে যুক্তরাষ্ট্রে, সেটা আসলে ট্রাম্প ও ইনফান্তিনোর সম্পর্কের ওপর নির্ভর করছে—যেটা এরই মধ্যে অনেকের কাছে ‘ব্রোমান্স’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।

ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। তাঁদের সম্পর্কের শুরু অবশ্য আরও আগে
ক্লাব বিশ্বকাপের শিরোপা নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। তাঁদের সম্পর্কের শুরু অবশ্য আরও আগে। রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.