ইরানের সঙ্গে সংঘাতের প্রকৃত খবর কি গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে দিচ্ছে ইসরায়েলি সরকার
গত বুধবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সেন্সরশিপ বিভাগের প্রধান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কোবি ম্যান্ডেলব্লিট এক বিজ্ঞপ্তিতে কিছু নিয়মনীতি ঘোষণা করেন। ইরানি হামলার প্রভাব নিয়ে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকেরা কী প্রকাশ করতে পারবেন এবং কী পারবেন না, তা এসব নিয়মনীতিতে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলে সংবাদমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপের (সেন্সরশিপ) আইনি ভিত্তি দেশটির জন্মের চেয়েও অনেক পুরোনো।
ফিলিস্তিনে ব্রিটিশ শাসনামলে ১৯৪৫ সালে প্রথম সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। পরে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর সেই বিধিনিষেধগুলোই ইসরায়েলি আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
তবে ইসরায়েলে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর বিধিনিষেধ আরোপের বিষয়টি কেবল নির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে সংবাদ প্রকাশে নিষিদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়।
আন্তর্জাতিক সাংবাদিক ফেডারেশনের (আইএফজে) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত গাজায় অন্তত ১৬৪ সাংবাদিককে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
এর বাইরে লেবানন, অধিকৃত পশ্চিম তীরে ও বর্তমানে ইরানেও অনেক সাংবাদিক নিহত হয়েছেন।
২০২৪ সালের মে থেকে ইসরায়েলি সরকার আল–জাজিরাকে সে দেশে নিষিদ্ধ করেছে। নভেম্বরে ইসরায়েলের উদারপন্থী দৈনিক হারেৎজ পত্রিকার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। কারণ, তাদের কিছু প্রতিবেদনে সরকারের কার্যকলাপের সমালোচনা করা হয়েছিল।
সাংবাদিকদের ওপর নতুন কী বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম কতটা স্বাধীন। জেনে নেওয়া যাক এ–সংক্রান্ত খুঁটিনাটি।
নতুন বিধিনিষেধে কী রয়েছে
চলমান ইরান সংঘাতকে কেন্দ্র করেই মূলত সংবাদমাধ্যমের ওপর নতুন বিধিনিষেধ আরোপ করেছে ইসরায়েল সরকার।
ইসরায়েলে ইরানের পাল্টা হামলার প্রভাব নিয়ে সাংবাদিক ও সম্পাদকেরা কীভাবে সংবাদ প্রকাশ করতে পারবেন, তার ওপর বিশেষ বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
‘অপারেশন রাইজিং লায়ন—ইসরায়েলি ফ্রন্টে হামলার সংবাদ সংগ্রহ বিষয়ে আইডিএফ সেন্সরের নির্দেশনা’ শিরোনামে বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ করা হয়। এতে সম্পাদকদের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার সংবাদ প্রকাশের সময় ‘কঠোর বিধিনিষেধ’ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলের সামরিক সেন্সরের দপ্তর।
ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর সেন্সরশিপ বিভাগ সতর্ক করে বলেছে, সাংবাদিকেরা এমন কিছু লিখতে বা দেখাতে পারবেন না, যা থেকে বোঝা যায় কোথা থেকে হামলা হয়েছে, কীভাবে আকাশ প্রতিরক্ষা কাজ করছে বা হামলায় কতটা ক্ষতি হয়েছে। কারণ, এসব তথ্য শত্রুর কাজে লাগতে পারে এবং দেশের নিরাপত্তার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
বিশেষ করে সাংবাদিক ও সম্পাদকদের নিচের কাজগুলো করতে নিষেধ করা হয়েছে।
হামলার জায়গা থেকে ছবি তোলা বা ভিডিও সম্প্রচার করা, বিশেষ করে সামরিক স্থাপনার আশপাশে। ড্রোন বা ওয়াইড অ্যাঙ্গেল ক্যামেরা ব্যবহার করে হামলায় বিধ্বস্ত এলাকা দেখানো। সেনা স্থাপনার কাছাকাছি ক্ষতিগ্রস্ত জায়গার নির্দিষ্ট অবস্থান জানানো। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণ বা ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধের দৃশ্য সম্প্রচার করা।
নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, সেন্সরশিপ বিভাগের অনুমোদন ছাড়া সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কোনো ভিডিও প্রকাশ করা যাবে না। এসব ভিডিও ‘শত্রুপক্ষের তৈরি ভুয়া খবর’ হতে পারে।
নতুন বিধিনিষেধগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হয়েছে।
মঙ্গলবার ভোরে ইসরায়েলের হাইফা বন্দরনগরে সম্ভাব্য হামলার ছবি তুলতে ক্যামেরা বসানোর সময় কয়েকজন আলোকচিত্রীকে গ্রেপ্তার করা হয়।
এর আগে কোন ধরনের নিষেধাজ্ঞা ছিল
যেকোনো সংবাদে ইসরায়েলের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে কোনো তথ্য থাকলে, তা ছাপার আগে সাংবাদিক ও সম্পাদকেদের সেন্সরশিপ বিভাগের অনুমতি নিতে হয়।
বিদ্যমান নিয়ম অনুযায়ী, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য নিশ্চিতভাবে ক্ষতিকর হতে পারে, এমন যেকোনো সংবাদ প্রকাশ রুখে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে সেন্সরশিপ বিভাগ।
তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বা দেশের রাজনীতিবিদদের খ্যাতি নষ্ট করবে, এমন কোনো প্রতিবেদন প্রকাশে হয়তো বাধা দিতে পারবে না সেন্সর।
সন্ত্রাসবিরোধী আইন সংশোধনের মাধ্যমে ২০২৩ সালে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমের ওপর কঠোর বিধিনিষেধ আরও তীব্র করা হয়। এতে বলা হয়, যাঁরা ‘সুশৃঙ্খলভাবে ও ধারাবাহিকভাবে সন্ত্রাসবাদী প্রকাশনা পড়েন’ বা ‘সন্ত্রাসী কাজের সরাসরি আহ্বান প্রচার করেন’, তাঁরা শাস্তিযোগ্য অপরাধে অভিযুক্ত হবেন।
‘ইনডেক্স অন সেন্সরশিপ’-এর মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতাবিষয়ক সংগঠনগুলোর মতে, ইরান সংঘাতকে কেন্দ্র করে নতুন বিধিনিষেধ আসার আগেই সেন্সরশিপ বিভাগের ‘নিরাপত্তাসংক্রান্ত বিষয়বস্তুর’ সংজ্ঞা ছিল খুব বিস্তৃত। এর মধ্যে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা, অস্ত্র চুক্তি, প্রশাসনিক বন্দী, ইসরায়েলের বৈদেশিক নীতিসহ অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল।
কোনো সাংবাদিক, প্রকাশনা বা সংবাদমাধ্যম সেন্সরশিপ বিভাগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করতে পারে। আদালত চাইলে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে পারবেন।
সেন্সরশিপ বিভাগ কত ঘন ঘন সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে
প্রায়ই হস্তক্ষেপ করে। গত মে মাসে ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সাময়িকী +৯৭২ জানিয়েছিল, গাজা যুদ্ধ শুরুর পর থেকে সংবাদমাধ্যমে বিধিনিষেধ আরোপের ঘটনা নজিরবিহীনভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
সাময়িকীটির মতে, ২০২৪ সালে ইসরায়েলের সামরিক সেন্সরশিপ বিভাগ সম্পূর্ণভাবে ১ হাজার ৬৩৫টি সংবাদ প্রকাশে বাধা দিয়েছে এবং আরও ৬ হাজার ২৬৫টি সংবাদ প্রতিবেদনের ওপর আংশিক বিধিনিষেধ আরোপ করেছে।
সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় গড়ে ২১টি প্রতিবেদনের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিবেদনের কোনো অংশের ওপর বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে, তা প্রকাশ করাও নিষেধ। ফলে কোন তথ্য বাদ দেওয়া হয়েছে এবং কোনটি রাখা হয়েছে, তা পাঠকের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়।
‘পশ্চিমা ধাঁচের’ অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের তুলনায় ইসরায়েলের গণমাধ্যম কতটা স্বাধীন?
যেসব দেশের সঙ্গে ইসরায়েলি নেতারা নিজেদের তুলনা করেন, সেসব দেশে ইসরায়েলের মতো কোনো সামরিক সেন্সরশিপ বিভাগ নেই।
রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) বিশ্ব সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে ইসরায়েলের অবস্থান ১১২তম। দেশটি হাইতি, গিনি-বিসাউ, দক্ষিণ সুদান ও চাদের চেয়েও পিছিয়ে আছে।
আরএসএফের মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় ইসরায়েল নৃশংস হামলা শুরু করার পর থেকে দেশটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বহুমাত্রিকতা ও সম্পাদকীয় স্বাধীনতা ক্রমাগত কমছে।
আরএসএফ আরও জানিয়েছে, ইসরায়েলের সম্প্রচার নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর নেতৃত্ব নির্বাচনে রাজনৈতিক সম্পর্ককে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়। কেবল সরকারপন্থী চ্যানেলকে সাধারণত শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়।
![]() |
| ইরানের ক্ষেপণাস্ত্রে বিধ্বস্ত ইসরায়েলি বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েইজমান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স ক্যাম্পাসে সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন অধ্যাপক রোয়ে ওজেরি। রোহেবোট, ইসরায়েল। ছবি: রয়টার্স |

No comments