নেতানিয়াহুর সময় কি ফুরিয়ে আসছে --আল জাজিরা
গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধ নিয়ে নেতানিয়াহু সরকারের সমালোচনাও বেড়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক নেতাদের পাশাপাশি সাবেক ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীদের কাছ থেকেও তাঁর সরকারের বিরুদ্ধে গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের অভিযোগ আসছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ইসরায়েল ক্রমেই বেশি একঘরে হয়ে পড়ছে; কারণ, গাজায় দেশটির চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভিক্ষের ছবি বিশ্ব গণমাধ্যমে ছেয়ে গেছে।
দেশের ভেতরও নেতানিয়াহুকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়তে হচ্ছে। অনেকেই মনে করছেন, তিনি শুধু নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে এ যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করছেন।
আইনি দিক থেকে, দুর্নীতির মামলার বিচারে প্রসিকিউশন পক্ষ নেতানিয়াহুর জেরা শুরু করেছে। আর রাজনৈতিকভাবে, তাঁর জোট সরকার যেকোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে, এমন আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
নেতানিয়াহুকে দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এতটা চাপে আগে কখনো দেখা যায়নি। তবে এটি কি সত্যিই ইসরায়েলের সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি প্রধানমন্ত্রীর শেষ সময়? উঠেছে সেই প্রশ্ন। এর জবাব খুঁজে দেখা যাক—
নেতানিয়াহু এখন ইসরায়েলিদের মধ্যে অত্যন্ত অপ্রিয়, আর এই মোহভঙ্গ দিনে দিনে বাড়ছে।
নেতানিয়াহু ইসরায়েলিদের কাছে কতটা অজনপ্রিয়?
খুবই। এ অজনপ্রিয়তা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বহুদিন ধরেই অভিযোগ যে তিনি গাজায় যুদ্ধকে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছেন। গত মার্চে ইসরায়েল হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি ভেঙে দিলে ও গাজায় আটক জিম্মিদের আরও ঝুঁকিতে ফেললে এ অভিযোগ নতুন করে জোর পায়।
গত মাসের শেষ দিকে ‘চ্যানেল ১২’–এর এক জরিপে দেখা যায়, বেশির ভাগ ইসরায়েলি মনে করেন, নেতানিয়াহু জিম্মিদের ফেরত আনার চেয়ে ক্ষমতা ধরে রাখাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
ইসরায়েলের অধিকাংশ বিক্ষোভ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলায় আটক হওয়া জিম্মিদের মুক্তির দাবিকে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নেতানিয়াহুর যুদ্ধ দীর্ঘায়িত করার ফলে জিম্মিদের জীবনের ঝুঁকি যে বাড়ছে, সেটিও এ বিক্ষোভের আরেক কারণ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে একটি ছোট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সংখ্যক ইসরায়েলি গাজার মানুষের ওপর তাঁদের সরকারের চাপিয়ে দেওয়া দুর্ভোগের বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন।
দেশের একদল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গাজার ধ্বংসযজ্ঞের নিন্দা জানিয়ে একটি খোলা চিঠি প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি, প্রতি শনিবার রাতে তেল আবিবে যে বড় পরিসরে যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে, সেখানে অনেকেই ফিলিস্তিনি শিশুদের আরও বেশি ছবি তুলে ধরছেন।
এমনকি সেনাবাহিনীর ভেতরও গাজা যুদ্ধ নিয়ে অসন্তোষ বাড়ছে।
যুদ্ধ করতে রিজার্ভ সেনাদের অস্বীকৃতি জানানোর খবর প্রকাশিত হওয়ার পর, বিভিন্ন বিভাগের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে খোলা চিঠি লিখেছেন।
নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমালোচনা
সম্প্রতি ইসরায়েলের দুজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যে নেতানিয়াহুর সমালোচনা করেছেন।
১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী থাকা সাবেক জেনারেল এহুদ বারাক টাইম সাময়িকীকে বলেন, জিম্মিদের মুক্তি ও যুদ্ধ থামাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় করা একটি চুক্তি গ্রহণ কিংবা রাজনৈতিক স্বার্থে ‘প্রতারণার যুদ্ধ’ চালিয়ে যাওয়া—এর একটিকে এখন অবশ্যই বেছে নিতে হবে নেতানিয়াহুকে।
২০০৬ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা এহুদ ওলমার্ট হারেৎজ পত্রিকায় লিখেছেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটনের জন্য ইসরায়েল দায়ী এবং এখন এটি একটি ব্যক্তিগত রাজনৈতিক যুদ্ধ।
ডেমোক্র্যাটস পার্টির নেতা ও সাবেক জেনারেল ইয়াইর গোলান স্থানীয় রেডিও রেশেত বেত-এ বলেন, ‘একটি সুস্থ রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে না, শিশুদের হত্যা করে না আর জনগণকে জোর করে উচ্ছেদ করে না।’
ইয়াইর এসব কথা বলেন ইসরায়েলের কট্টর ডানপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গভিরের এক বিশেষ পরিকল্পনার পরিপ্রেক্ষিতে। এ পরিকল্পনায় গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের উচ্ছেদ করে সেখানে ইসরায়েলিদের বসতি গড়ার প্রস্তাব রয়েছে।
ওলমার্ট গত মঙ্গলবার আরও বলেন, ‘ট্রাম্পের উচিত নেতানিয়াহুকে স্পষ্ট করে বলা, “এবার যথেষ্ট হয়েছে।”’
নেতানিয়াহু জোটের জন্য হুমকি
বহু বছর ধরে ইসরায়েল একটি বিষয় নিয়ে বিভক্ত। তা হলো, আলট্রা-অর্থোডক্স (চরম রক্ষণশীল ধর্মীয়) ইহুদি তরুণদের সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করা। পূর্ণকালীন ধর্মীয় শিক্ষার্থী হলে সামরিক বাহিনীতে যোগ দেওয়া থেকে তাঁদের ছাড় দেওয়া হতো।
২০২৪ সালের জুনে ইসরায়েলের সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, আর এ ছাড় প্রযোজ্য হবে না। ধর্মনিরপেক্ষ ইসরায়েলিদের দীর্ঘদিনের দাবির ভিত্তিতে আদালত এ রায় দেন। এই ইসরায়েলিরা বৈষম্যমূলক নিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে আসছিলেন।
তবে নেতানিয়াহুর জোট সরকারের অংশীদার আলট্রা-অর্থোডক্স দুই দল—শ্যাস ও ইউনাইটেড তোরাহ জুদায়িজম (ইউটিজে) সুপ্রিম কোর্টের রায় উল্টে দিতে আইন পাস করা না হলে সরকার ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।
নতুন নির্বাচন হলে আইনসভায় আলট্রা-অর্থোডক্সদের প্রতি আরও সহানুভূতিশীল প্রতিনিধিত্ব আসবে কি না, সেটি স্পষ্ট নয়। তবে সাম্প্রতিক কিছু পদক্ষেপ, যেমন তাঁদের মধ্য থেকে আরও বেশিসংখ্যক শিক্ষার্থীকে সামরিক বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করার চিঠি পাঠানোর পরিকল্পনা এ বিতর্ককে সামনে নিয়ে এসেছে।
ইসরায়েল কীভাবে আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হলো
আরব ও ইউরোপীয় নেতারা এখন নেতানিয়াহু এবং গাজা যুদ্ধ নিয়ে ক্রমেই বেশি সমালোচনামুখর হয়ে উঠছেন। তবে এখন পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমর্থক হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্র ও প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
গত মাসের শুরুতে নেতানিয়াহু বলেন, গাজা থেকে উৎখাত হওয়া ফিলিস্তিনিরা সৌদি আরবে গিয়ে বসতি স্থাপন করতে পারে। তাঁর এ বক্তব্যে কড়া প্রতিক্রিয়া জানায় সৌদি আরব ও আরব লিগ।
একই মাসে কানাডা, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য এক যৌথ বিবৃতিতে গাজায় মানবিক দুর্দশাকে অসহনীয় বলে আখ্যায়িত করে। এই দেশগুলোর সবকটি আগে ইসরায়েলের গাজা যুদ্ধকে সমর্থন দিয়েছিল।
নরওয়ের সঙ্গে ২০২৪ সালের মে মাসে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া স্পেন ও আয়ারল্যান্ডও নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।
ইতিমধ্যে মঙ্গলবার যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড ও নরওয়ে একসঙ্গে ঘোষণা করেছে যে তারা স্মোট্রিচ ও বেন-গভিরের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করবে।
তবে নেতানিয়াহু কতদিন ট্রাম্পের সমর্থন ধরে রাখতে পারবেন, তা পরিষ্কার নয়। অনেকেই ধারণা করছেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প নেতানিয়াহুতে বিরক্ত হয়ে উঠছেন।
আইনি ঝামেলায় নেতানিয়াহু
২০১৯ সাল থেকে নেতানিয়াহু একাধিক দুর্নীতির মামলায় জড়িয়ে আছেন। দোষী প্রমাণিত হলে তাঁর ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।
২০২০ সালে শুরু হওয়া এ বিচারকার্য করোনা মহামারি ও সাম্প্রতিক গাজা যুদ্ধের কারণে বারবার বিলম্বিত হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নিজের বিচার এড়াতে ইচ্ছাকৃতভাবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত এবং এখন তা আরও জোরাল করছেন তিনি।
সমালোচকরা এ–ও বলছেন, ৭ অক্টোবরের হামলার সময় সরকারের ব্যর্থতার জবাবদিহি এড়াতে যুদ্ধ টেনে নিচ্ছেন নেতানিয়াহু।
তাহলে নেতানিয়াহুর সময় কি ফুরিয়ে এল
নেতানিয়াহুর পুরো রাজনৈতিক জীবনে বিতর্ক আর কেলেঙ্কারি লেগেই ছিল। এখন তাঁর বিরোধিতা ইসরায়েল ও পশ্চিমা দেশগুলোতেও বাড়ছে। তবু তিনি টিকে যেতে পারেন—এমনটাই বলছেন পর্যবেক্ষকেরা।
তবে টিকে থাকতে হলে নেতানিয়াহুর জন্য জরুরি হলো যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ধরে রাখা; সেই সঙ্গে এমন একটি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া, যা ট্রাম্প নিজেই শেষ করতে চাইছেন।
নেতানিয়াহুর একজন সাবেক সহযোগী মিচেল বারাক গত মাসে আল–জাজিরাকে বলেছেন, ‘আমি জানি না, উনি (ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী) এ পরিস্থিতি থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন কি না।’
‘অনেকেই বলছেন, নেতানিয়াহুর সময় শেষ…এ কথা বহু বছর ধরে শোনা যাচ্ছে। আর উনি এখনো টিকে আছেন…কিন্তু আমি আর কোনো জাদু কৌশল দেখতে পাচ্ছি না, যা তাঁকে টিকিয়ে রাখবে’, বলেন মিচেল বারাক।
![]() |
| বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে অংশ নিচ্ছেন আন্দোলনকারীরা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের মুক্তির দাবিও জানান তাঁরা। তেল আবিব, ইসরায়েল, ২৪ মে ২০২৫ ছবি: রয়টার্স |

No comments