নিউইয়র্কের মেয়র প্রার্থী জোহরান আসলেই কি ‘কমিউনিস্ট’, কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা

যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক নগরের আসন্ন মেয়র নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী জোহরান মামদানি নিজেকে ‘গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী’ হিসেবে পরিচয় দেন। তবে অনেক রিপাবলিকান রাজনীতিক ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারী তাঁকে ভুলভাবে ‘কমিউনিস্ট’ বলে থাকেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২৫ জুন নিজের মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘জোহরান মামদানি ১০০ ভাগ পাগলাটে কমিউনিস্ট।’

রক্ষণশীল ঘরানার পডকাস্ট উপস্থাপক নিক সোরটর ২৩ জুন এক্সে (সাবেক টুইটার) লেখেন, ‘জোহরান মামদানি শুধু সমাজতন্ত্রী নন, তিনি একজন পুরোপুরি কমিউনিস্ট।’ তিনি একটি ভিডিও শেয়ার করেন, যেখানে জোহরান নগর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন মুদির দোকানের নেটওয়ার্ক তৈরির কথা বলছেন। সোরটরের ভাষায়, ‘(জোহরান) বার্নি স্যান্ডার্সের চেয়েও অনেক বেশি বামপন্থী। তিনি সরকার পরিচালিত মুদির দোকান চান।’

দ্য ডেইলি ওয়্যারের সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং পডকাস্টার বেন শ্যাপিরো বলেন, ‘আজকের সবচেয়ে বড় খবর: নিউইয়র্কের পরবর্তী মেয়র হতে যাচ্ছেন একজন কমিউনিস্ট।’ রিপাবলিকান কংগ্রেস সদস্য এলিস স্টেফানিকও এক্সে জোহরানকে ‘কমিউনিস্ট’ বলে উল্লেখ করেছেন।

জোহরানের নির্বাচনী মঞ্চের পক্ষ থেকে গণপরিবহন, বাসস্থান এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের জন্য সহনীয় করার কথা বলা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তিনি শিল্পকারখানা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তির ওপর সরকারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের মতো কমিউনিজমের মূল বৈশিষ্ট্যের পক্ষে অবস্থান নেননি।

স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিষয়ক অধ্যাপক আনা গ্রিজমালা-বুস যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ফ্যাক্ট-চেকিং ওয়েবসাইট পলিটি-ফ্যাক্টকে বলেছেন, ‘জোহরান কমিউনিস্ট নন। কমিউনিজম অর্থ হলো কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি, যেখানে বাজারের ভূমিকা নেই। এ ব্যবস্থায় সব দাম ও পরিমাণ ঠিক করে কেন্দ্রীয় সরকার। একদলীয় শাসন চলে, গণতান্ত্রিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকে না—জোহরান এসবের কিছুই চান না।’

মার্কিন রাজনীতিতে ডেমোক্র্যাটদের ‘কমিউনিস্ট’ বা কমিউনিস্টদের দোসর বলে দাগিয়ে দেওয়া বহু পুরোনো একটি বিভ্রান্তকর কৌশল, যা বার্নি স্যান্ডার্সের মতো কিছু গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীর জনপ্রিয়তার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে নতুনভাবে দেখা যাচ্ছে।

গত মঙ্গলবার (২৪ জুন) নিউইয়র্কের সাবেক গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমো ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রাথমিক বাছাইয়ে জোহরানের কাছে পরাজয় স্বীকার করে নেন। এর মধ্য দিয়ে জোহরানের নাম জাতীয় পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে।

আগামী নভেম্বরে নিউইয়র্ক নগরে মেয়র পদে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে জোহরানের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন রিপাবলিকান পার্টির কার্টিস স্লিওয়া। তিনি সিভিলিয়ান ক্রাইম ফাইটিং গ্রুপ গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেলসের প্রতিষ্ঠাতা। বর্তমান মেয়র এরিক অ্যাডামসও আগামী নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন। অন্যদিকে দলীয়ভাবে মনোনয়ন পেতে ব্যর্থ কুমো স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সম্ভাবনা এখনো নাকচ করে দেননি।

জোহরানের মঞ্চের প্রচার

জোহরান নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের আইনসভার সদস্য। তিনি নিউইয়র্ক নগরের কুইন্স বরোর একটি অঞ্চলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি নিজেকে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দেন। জোহরান নিউইয়র্ক নগরের ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিস্টস অব আমেরিকার একজন সদস্য। সংগঠনটি মেয়র পদে তাঁকে সমর্থন জানিয়েছে।

এই সংগঠনের লক্ষ্য হলো ‘জ্বালানি উৎপাদন ও পরিবহনের মতো আমাদের জীবনকে প্রভাবিত করা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক খাতগুলো যৌথ মালিকানায় আনা’ এবং ‘এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা, যেখানে সাধারণ মানুষের কর্মক্ষেত্র, পাড়া ও বৃহত্তর সমাজে বাস্তব ও কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়’।

জোহরানের নির্বাচনী ইশতেহারের কয়েকটি ঘোষণা হলো যেসব ভবনে আগে থেকেই ভাড়া বৃদ্ধির সীমা নির্ধারিত আছে, সেসব স্থানে ভাড়া বৃদ্ধি পুরোপুরি স্থগিত রাখা। প্রতিটি বরোতে সিটি করপোরেশন পরিচালিত একটি মুদিদোকান চালু করা। চলতি মাসে স্পেকট্রাম নিউজ এনওয়াইওয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জোহরান মামদানি বলেন, এসব দোকান যুক্তরাষ্ট্রের কানসাস অঙ্গরাজ্যের পৌর মালিকানাধীন মুদিদোকানের আদলে গড়ে তোলা হবে।

জোহরানের অন্যান্য প্রস্তাবের মধ্যে বিনা ভাড়ায় গণপরিবহন ও শিশুদের দেখাশোনার সুবিধা দেওয়া; করপোরেট কর বৃদ্ধি এবং ন্যূনতম মজুরি বাড়ানোর ঘোষণা অন্যতম।

জোহরান ব্যক্তিগত মালিকানা বিলুপ্ত করার কোনো দাবি তোলেননি। তাঁর ওয়েবসাইটে উল্লেখিত লক্ষ্যগুলোর একটি হলো, ‘ব্যবসা শুরু ও পরিচালনা করা আরও দ্রুত, সহজ এবং সাশ্রয়ী করা।’ অর্থাৎ সাধারণ মানুষ যেন সহজেই ব্যবসা শুরু ও পরিচালনা করতে পারেন, সেটাই তাঁর অন্যতম উদ্দেশ্য।

জোহরান নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, আবাসন নির্মাণে ব্যক্তিগত বাজারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে, যা এখন তিনি পরিষ্কারভাবে স্বীকার করেন। তাঁর পরিকল্পনায় সরকার সাশ্রয়ী আবাসন নির্মাণ করবে, তবে পুরো আবাসন খাত নিয়ন্ত্রণ করবে না।

এই মেয়র প্রার্থী নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, আবাসন নির্মাণে বেসরকারি বাজারের ভূমিকা সম্পর্কে তাঁর আগের মত বদলে গেছে। তাঁর কথায়, ‘আমি এখন স্পষ্টভাবে বুঝতে পারছি, এখানে আমাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।’

জোহরানের ওয়েবসাইটের সঙ্গে এ বক্তব্য মিলে যায়, যেখানে বলা হয়েছে, সরকারি উদ্যোগে সাশ্রয়ী আবাসন নির্মাণ করা উচিত। তবে সম্পূর্ণ আবাসন খাতের নিয়ন্ত্রণ সরকারের নেওয়া ঠিক হবে না।

কমিউনিস্ট ও গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীর মূল পার্থক্য

জোহরান মামদানির নীতি-আদর্শ নিয়ে সাতজন বিশেষজ্ঞের মতামত নিয়েছে আল–জাজিরা। তাঁদের কেউই তাঁকে কমিউনিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করেননি।

নিউইয়র্ক সিটি ইউনিভার্সিটির বরো অব ম্যানহাটান কমিউনিটি কলেজের রাজনীতিবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক জেফ্রি কার্টজ বলেন, ‘জোহরানকে কমিউনিস্ট বলা একেবারে মানহানিকর একটি বিষয়।’

যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা যখন ‘ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম’ বা গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্র শব্দটি ব্যবহার করেন, তখন তাঁরা সাধারণত ইউরোপীয় দেশগুলোতে বিদ্যমান উদার সামাজিক বিমা কর্মসূচিগুলোকে বোঝান। এর মধ্য দিয়ে তাঁরা শিশুসেবায় উচ্চ ভর্তুকি, পাশাপাশি ধনীদের ওপর উচ্চ করারোপকে বোঝান, যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হয়।

বারুচ কলেজের অধ্যাপক টেড হেনকেন বলেন, জোহরান ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা শেষ করে দেওয়ার বা কোনো শিল্প সরকার কর্তৃক দখল করার পক্ষে নন; বরং তিনি নিউইয়র্ক নগরের জীবনযাত্রার উচ্চ ব্যয় মোকাবিলায় লক্ষ্যভিত্তিক পদক্ষেপের পক্ষে।

এই অধ্যাপক বলেন, ‘জোহরানকে যাঁরা সমর্থন করছেন, তাঁরা কমিউনিস্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী নন। তাঁরা তাঁকে সমর্থন করছেন; কারণ, তিনি জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির সংকট মোকাবিলার সমাধান প্রস্তাব করেছেন।’

এই ডেমোক্র্যাট মেয়র প্রার্থীর একটি নির্বাচনী টিকটক ভিডিওতে বলেছেন, ‘করপোরেট সুপারমার্কেটগুলোর জন্য যেসব সরকারি অর্থ বা ভর্তুকি বরাদ্দ থাকে, সেগুলো সরিয়ে এনে শহর কর্তৃপক্ষের মালিকানাধীন মুদিদোকানগুলোর পেছনে খরচ করা হবে। নগর কর্তৃপক্ষ পরিচালিত দোকানগুলো ব্যক্তিগত মালিকানাধীন ছোট ব্যবসা ও খামারিদের সঙ্গে কাজ করবে।’

রাজনৈতিক তত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের মতে, জোহরানের অধিকাংশ প্রস্তাবই পশ্চিমা গণতন্ত্রে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান।

ম্যাসাচুসেটস অঙ্গরাজ্যের টাফটস বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক রাজনীতির সহযোগী অধ্যাপক অক্সানা শেভেল বলেন, ‘ফ্রান্স থেকে কানাডা পর্যন্ত বহু পশ্চিমা গণতন্ত্রে বিনা মূল্যে বা ব্যাপক ভর্তুকির শিশুসেবা এবং গণপরিবহনের মতো নীতিমালা রয়েছে।’

অন্যদিকে কমিউনিস্ট সরকার শুধু ভাড়া বা কিছু সুপারমার্কেট নয়; বরং বাজারব্যবস্থাসহ সবকিছুর পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। সবচেয়ে বড় কথা, কমিউনিজমে কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল থাকে না।

অক্সানা বলেন, ‘তিনি এমন কিছু প্রচার করছেন না। তাই তিনি কমিউনিস্ট নন।’

আমোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমেরিকান কমিউনিজমের ইতিহাস বিশেষজ্ঞ হার্ভে ক্লেহার বলেন, ডেমোক্রেটিক সোশ্যালিজম কমিউনিজমের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

ক্লেয়ার বলেন, ‘অন্তত তত্ত্বগতভাবে গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রীরা কমিউনিজমের কিছু ধারণা প্রত্যাখ্যান করে থাকে। যেমন শ্রমিকশ্রেণির অগ্রদূত বা নেতৃত্বদানকারী দল (ভ্যানগার্ড অব দ্য প্রলেতারিয়েত), প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রের প্রতি বিরূপ মনোভাব এবং উৎপাদনের উপকরণের ওপর রাষ্ট্রীয় মালিকানার মতো ধারণাগুলোকে তাঁরা স্বীকার করেন না। তবে পুঁজিবাদের প্রতি বিরূপ মনোভাবের মতো কিছু বিষয়ে তাঁদের মধ্যে মিল আছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, জোহরানের ইশতেহারের যুক্তিযুক্ত সমালোচনা থাকতে পারে। কিন্তু তিনি যেসব প্রস্তাব দিয়েছেন, সেগুলোর কারণে তাঁকে কমিউনিস্ট বলা যাবে না।

বিশেষজ্ঞ মতামত -আল জাজিরা

নিউইয়র্ক নগরের মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক সিটিতে, ২৫ জুন ২০২৫
নিউইয়র্ক নগরের মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পেয়েছেন জোহরান মামদানি। নিউইয়র্ক সিটিতে, ২৫ জুন ২০২৫ ছবি: রয়টার্স

No comments

Powered by Blogger.