ভেঙে পড়েছে আইনশৃংখলা, গাজায় অকল্পনীয় দৃশ্য: ‘সংকট নিরসনে পদক্ষেপ না নিলে ইসরাইলিদের নিষেধাজ্ঞা দেবে ফ্রান্স’

অকল্পনীয় দৃশ্য গাজায়। মানুষ খাদ্যের জন্য পাগলপ্রায়। ছিটেফোঁটা যা ত্রাণ সেখানে যাচ্ছে, তা পেতে তাদেরকে আরেক যুদ্ধ করতে হচ্ছে। এর ফলে ভয়াবহ এক বিশৃংখল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ভেঙে পড়েছে নিরাপত্তা। গাজার উত্তরাঞ্চলে মূল শহরে লুটপাট চলছে। খাদ্যের জন্য মানুষের এমন লড়াইয়ের মধ্যেও সেখানে হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। এ খবর দিয়েছে অনলাইন বিবিসি। হামাস পরিচালিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, বৃহস্পতিবার আইনশৃংখলা নিয়ন্ত্রণ এবং লুটপাট বন্ধে মোতায়েন করা হয়েছিল পুলিশ কর্মকর্তাদের। তাদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে কমপক্ষে ৭ পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন।  এ বিষয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী কোনো মন্তব্য করেনি। তবে তারা বলেছে, বৃহস্পতিবার গাজাজুড়ে তারা ‘কয়েক ডজন সন্ত্রাসী আস্তানা’ লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে।

ওদিকে স্থানীয় চিকিৎসা সংশ্লিষ্টরা ও উদ্ধারকর্মীরা বলেছেন বৃহস্পতিবার গাজাজুড়ে হামলায় কমপক্ষে ৪৪ জন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে শুধু বুরেইজ শরণার্থী শিবিরেই মারা গেছেন ২৩ জন। এর একদিন আগে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি জানায়, বুভুক্ষু মানুষ দিয়ের আল বালাহতে তাদের একটি গুদামে জোর করে ঢুকে পড়েন। তারা লুটেপুটে নিয়ে যান সেখানে জমা করা ত্রাণ সামগ্রী। এ সময় গুলিতে কমপক্ষে দু’জন নিহত হয়েছেন। তবে কে তাদেরকে গুলি করেছে তা পরিষ্কার নয়।  

যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল সমর্থিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ)-এর একটি নতুন ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে হাজার হাজার মানুষ হামলে পড়ার পর তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। এতে কমপক্ষে ৫০ জনকে গুলি করা হয়। তাতে কতজন নিহত ও আহত হয়েছেন তা স্পষ্ট নয়। মঙ্গলবারের ওই ঘটনা সম্পর্কে ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা সতর্কতামূলকভাবে ফাঁকা গুলি ছুড়েছে।

ওদিকে বৃহস্পতিবার গাজার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা পুলিশকে আল সারায়া সংযোগস্থলে একটি মার্কেটের কাছে সশস্ত্র অবস্থায় দেখা গেছে। সেখানে অল্প কিছু দোকানে খাদ্য ও শাকসবজি বিক্রি করে। ওদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভয়াবহ কিছু ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায় ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত এবং তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়, ইসরাইলের হামলায় এমন ঘটনা ঘটেছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ইসরাইলি দখলদাররা বেশ কিছু পুলিশ কর্মকর্তাকে টার্গেট করে বিমান থেকে হামলা চালায়। এ সময় ওই পুলিশ কর্মকর্তারা লুটপাট বন্ধে দায়িত্ব পালন করছিলেন। হামলায় তাদের বেশ কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। সঙ্গে বেসামরিক লোকজনও আছেন। এ বিষয়ে ইসরাইলি সেনাবাহিনী সরাসরি কোনো উত্তর দেয়নি।

গত বছর থেকে গাজায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে হামলা শুরু করে ইসরাইল। তখন থেকেই গাজায় ক্রমশ আইনশৃংখলার অবনতি ঘটতে থাকে। জানুয়ারিতে এক হামলায় ওই  অঞ্চলের পুলিশ প্রধান ও তার ডেপুটি নিহত হন। ইসরাইলের এমন আচরণে বৃহস্পতিবার গাজার সব জায়গা আইন শৃংখলা ভেঙে পড়ে। মানুষ খাদ্যের জন্য পাগলের মতো আচরণ করতে থাকেন। রাফার কাছে জিএইচএফের ত্রাণ বিতরণ কেন্দ্রে গিয়েছিলেন এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন, ভোর থেকেই সেখানে ত্রাণের আশায় জমায়েত হন হাজার হাজার মানুষ। তারা ত্রাণ পাওয়ার জন্য ওই কেন্দ্রের গেট দিয়ে প্রবেশ করার চেষ্টা করেন। এতে গেট ভেঙে যায়। স্থানীয় সময় সকাল আটটায় ইসরাইলি সেনারা ড্রোন ব্যবহার করে এসব মানুষকে সতর্ক করে। ঠিক ১০ মিনিটে সব ঠিক হয়ে আসে। কিন্তু আবারও মানুষের ঢল নামে গেটে। তারা ভিতরে প্রবেশ করে ত্রাণভর্তি বাক্স, আটার বস্তা নিয়ে যেতে থাকে।

জিএইচএফের ওই কেন্দ্র থেকে ধারণ করা ফুটেজে দেখা গেছে বৃহস্পতিবার ভোর থেকেই হাজার হাজার ফিলিস্তিনি ছুটে যাচ্ছেন সেখানে। কেউ ঘোড়ায় চালিত গাড়ি নিয়ে ছুটেছেন। কেউ বাইসাইকেলে। তাদেরকে আটা, ময়দা, ত্রাণ নিয়ে ছুটে যেতে দেখা যায়। কেউ বা মাথায় নিয়ে ছুটছিলেন।

‘গাজার সংকট নিরসনে পদক্ষেপ না নিলে ইসরাইলিদের নিষেধাজ্ঞা দেবে ফ্রান্স’

গাজার মানবিক সংকট নিরসনে ইসরাইল পদক্ষেপ না নিলে দেশটির নগারিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রন। শুক্রবার সিঙ্গাপুর সফরকালে এমন হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, তেল আবিবের সরকার গাজার মানবিক সংকট নিরসনে সাড়া না দিলে ইসরাইলিদের বিরুদ্ধে ‘নিষেধাজ্ঞা’ আসতে পারে। এমন এক সময় ফরাসি প্রেসিডেন্টের হুঁশিয়ারি আসলো যখন ইসরাইলের তিন মাসব্যাপী অবরোধে প্রবল ক্ষুধার সম্মুখীন হচ্ছে গাজাবাসী। দুর্ভিক্ষের সতর্কবার্তা দিয়েছে মানবাধিকার সংস্থাগুলো। এ খবর দিয়ে অনলাইন আল জাজিরা বলছে, ফরাসি প্রেসিডেন্টের এমন মন্তব্যে ইসরাইলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়িয়েছে। ম্যাক্রন বলেছেন, ক্রমবর্ধমান ক্ষুধায় দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে গাজাবাসী। এমন পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না।

সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লরেন্স ওংয়ের সঙ্গে এক যৌথ সেমিনারে এসব মন্তব্য করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট। বলেছেন, মানবিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে গাজাবাসীর যে পরিণতি করা হয়েছে তা অসহনীয়। তিনি আরও বলেন, মানবিক পরিস্থিতির সঙ্গে সামাঞ্জস্য রেখে আগামী দিনগুলোতে যদি কোনো প্রতিক্রিয়া না পাওয়া যায় তাহলে আমাদের সম্মিলিত অবস্থান আরও কঠোর হবে। ফ্রান্সে ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা বিবেচনা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করছে ইসরাইল। সম্প্রতি তারা এ বিষয়টি স্বীকার করে গাজায় ন্যূনতম খাদ্য ও ওষুধ সরবারের অনুমতি দিয়েছে। তবে এরমধ্যেও তাদের হামলা অব্যাহত রয়েছে। 

গাজায় ইসরাইল সমর্থিত মার্কিন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে হামাস

গাজায় নতুন যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি চুক্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বশেষ প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছে হামাস। স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির এক জৈষ্ঠ কর্মকর্তা বিবিসিকে এ তথ্য জানান। বৃহস্পতিবার হোয়াইট হাউসের তরফে জানানো হয়, মার্কিন বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফের পরিকল্পনায় স্বাক্ষর করেছে ইসরাইল এবং এ বিষয়ে হামাসের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রয়েছে তারা। এদিকে ইসরাইলি গণমাধ্যম জানিয়েছে, ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি ও ইসরাইলি কারাগারে আটক ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তির বিনিময়ে দুটি পর্যায়ে ১০ জন জীবিত ও ১৮ জিম্মির লাশ হস্তান্তর করবে হামাস। তবে হামাস কর্মকর্তা জানান, প্রস্তাবটি যুদ্ধের অবসানসহ মূল দাবিগুলো পূরণ করেনি। ইসরাইল সরকার অবশ্য হামাসের বক্তব্য নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।

বৃহস্পতিবার ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জিম্মিদের পরিবারকে জানান, তিনি উইটকফের পরিকল্পনা মেনে নিয়েছেন। বৃহস্পতিবার ওয়াশিংটন ডিসিতে এক সংবাদ সম্মেলনে হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি ক্যারোলিন লিভিটকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, বিশেষ দূত স্টিভ উইটকফ ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হামাসের কাছে একটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব জমা দিয়েছেন। যা ইসরাইল সমর্থন করেছে। হামাসের কাছে পাঠানোর আগে ইসরাইল ওই প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছে। আমি নিশ্চিত, এই আলোচনা অব্যাহত আছে এবং আমরা আশা করি গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি হবে। যাতে আমরা সব জিম্মিকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে পারি।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.