কেন্দ্রীয় ইস্যু এখন কাশ্মীর: কাশ্মীরিদের ছিল দুঃস্বপ্ন

যুদ্ধবিরতির ঘোষণার সঙ্গে কাশ্মীর বিরোধ সমাধানের পথ বের করতে ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে একত্রে কাজ করার প্রস্তাব দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তার এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে পাকিস্তান। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। কারণ, তারা বরাবরই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। এই কাশ্মীরকে কেন্দ্র করেই মূলত কয়েক দশক ধরে দেশ দুটির মধ্যে সংঘাত। কখনো তা যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। কাশ্মীরিরা এবং সচেতন মানুষ মাত্রই এই সমস্যার সমাধান চান। কারণ, এই একটি ইস্যুকে জিইয়ে রেখে আঞ্চলিক এক অস্থির পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে বার বার। এ কারণে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিলে তাকে স্বাগত জানিয়ে পাকিস্তান বলেছেন, অবশ্যই এই সমস্যার সমাধান হতে হবে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজ্যুলুশনের অধীনে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তার প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে বৃদ্ধি করতে আগ্রহী তারা। এ খবর দিয়ে অনলাইন ডন লিখেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতি এবং চাপের ফলে শনিবার সন্ধ্যার দিকে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে সহায়ক হয়েছে। এর কয়েক ঘন্টার মধ্যে উভয় পক্ষই একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগ করে। তবে রোববার ভোর থেকে গোলা বিনিময় বন্ধ রয়েছে। রোববার নিজের ট্রুথ সোশ্যালে এক বিবৃতিতে ট্রাম্প যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ায় নয়া দিল্লি ও ইসলামাবাদের নেতৃত্বের প্রশংসা করেছেন। বলেছেন, এই ঐতিহাসিক ও বীরোচিত সিদ্ধান্ত নিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা ছিল। তিনি বলেন, আমি আপনাদের উভয়ের সঙ্গেই কাজ করতে চাই। যদি হাজার বছর পরেও হতো তাহলেও উদ্বেগজনক কাশ্মীর সমস্যার একটা সমাধানে পৌঁছা সম্ভব।

ট্রাম্পের এমন মন্তব্যের তাৎক্ষণিক জবাব দিয়েছে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তারা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি সমর্থন করায় যুক্তরাষ্ট্র সহ বন্ধুপ্রতীম দেশগুলোর গঠনমূলক ভূমিকার প্রশংসা করে। এতে আরও বলা হয়, জম্মু ও কাশ্মীর বিরোধের সমাধান প্রচেষ্টায় প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন তার প্রশংসা করে ইসলামাবাদ। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের রেজ্যুলেশনের অধীনে জম্মু ও কাশ্মীর বিরোধের টেকসই একটি সমাধানে পৌঁছার আগ্রহ পাকিস্তান পুনর্ব্যক্ত করে। একই সঙ্গে কাশ্মীরি জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এতে নিশ্চিত করা হয় যে, আঞ্চলিক শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধিকে উৎসাহিত করতে যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে যোগাযোগে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ পাকিস্তান।

এতে বলা হয়, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা সহ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্নমুখী অংশীদারিত্ব গভীর করতে চায় পাকিস্তান। উল্লেখ্য, নিয়ন্ত্রণ রেখা ও আন্তর্জাতিক সীমান্তে পূর্ণাঙ্গ ও অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতিতে ভারত ও পাকিস্তান রাজি হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কাশ্মীর নিয়ে ওই মন্তব্য করেছেন। ট্রাম্প সবার আগে যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেয়ার পরপরই ভারত ও পাকিস্তান তাতে সম্মতির কথা জানান। 

কাশ্মীরিদের ছিল দুঃস্বপ্ন

কয়েকদিনের ভয়াবহ যুদ্ধ। ড্রোনের শব্দ। যুদ্ধবিমান উড়ছে আকাশে। সীমান্তে গোলাগুলি। প্রাণহানি হচ্ছে। এসব দেশে দেখে ভীত, আতঙ্কিত ছিলেন কাশ্মীরের মানুষ। নিয়ন্ত্রণরেখার দুই পাশেই আতঙ্ক। একদিকে ভারতের আক্রমণ। অন্যদিকে পাকিস্তানের পাল্টা আক্রমণ। এর মাঝে ভয়াবহ এক ঝুঁকির মধ্যে এসব অঞ্চলে বসবাস করেছে মানুষ। বিশেষ করে উরি এলাকায় গোলাগুলি হয়েছে বেশি। অনেক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে গিয়েছিলেন। কিন্তু যাদের সেই সক্ষমতা নেই, যাওয়ার জায়গা নেই- তারা থেকে গিয়েছিলেন সেখানেই। তাদেরই একজন ৬২ বছর বয়সী বৃদ্ধা হাজেরা। ঝেলম নদীর ধারে ঘনবসতিপূর্ণ ফাতে কদাল এলাকায় শনিবার সকালে একটি বাদামি সুতির ওড়না গায়ে জড়িয়ে সরকারি খাদ্যগুদামের মেঝেতে বসেছিলেন। মুখে দুশ্চিন্তার রেখা, ঠোঁটের ওপর ঘাম। তার চোখে-মুখে শুধুই আতঙ্ক তখন।

তিনি খাদ্যগুদামের কর্মচারীর দিকে তাকিয়ে দ্রুত করার তাগিদ দিলেন। প্রতিমাসেই তাঁকে এই কেন্দ্রে যেয়ে আঙুলের ছাপ দিয়ে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করতে হয়। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ছিল একেবারে ভিন্ন। তিনি বলেন, আমাকে লাইনেই দাঁড় করিয়ে রাখল। পায়ের ব্যথা সহ্য করতে পারছি না। আমি শুধু চালটা চাই, যাতে দ্রুত বাড়ি ফিরে যেতে পারি। যুদ্ধ চলছে। ৮ই মে উরির এক গ্রামে গাড়িতে করে পালাতে গিয়ে শত্রুপক্ষের শেলের আঘাতে মারা যান নারগিস বশির নামের এক নারী। আহত হন তার পরিবারের আরও তিনজন। একই দিন গভীর রাতে উরির মোহরা গ্রামে ভারতীয় সেনাবাহিনীর বোফর্স কামান গর্জে উঠলে ২৮ বছর বয়সী সুলেমান শেখের বাড়ি কেঁপে ওঠে।

সুলেমান বলেন, দাদু বলতেন, এই কামান ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের সময় শেষবার গর্জেছিল। এবারও সেই আওয়াজ শুনে বুঝলাম, পরিস্থিতি ভয়াবহ। এর কয়েক ঘণ্টা পর শত্রুপক্ষের একটি শেল তার বাড়িতে আঘাত হানে এবং পুরো ঘর ভেঙে পড়ে। শ্রীনগরে ব্যবসায়ী হাসনাইন শাবির বলেন, যুদ্ধ যদি এমন হয়, তাহলে আসল যুদ্ধ কেমন হবে ভাবতেই গা শিউরে ওঠে।

অনেক বাসিন্দা যুদ্ধবিরতির পরও নিজেদের বাড়িতে ফিরতে রাজি নন। তাদের একজন সাবেক সেনা সদস্য মুহাম্মদ নাসির খান। তিনি বলেন,  আমার মেয়েরা ফিরতে চাইছে না। ছাত্র মুনীব মেহরাজ বলেন, আমরা ক্লান্ত, এই অনিশ্চয়তা আর সহ্য হয় না। আমাদের দরকার স্থায়ী সমাধান, সাময়িক যুদ্ধবিরতি নয়। সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ফুরকান ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা তো কেবল দুই দেশের যুদ্ধের ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’।

দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশ যুদ্ধ করল, প্রাণ গেল আমাদের, ঘর ভাঙল আমাদের, তবুও কারও কাছে আমাদের কথা গুরুত্ব পায় না। যদিও সাময়িক যুদ্ধবিরতি কিছুটা স্বস্তি এনেছে, কিন্তু কাশ্মীরের মানুষ জানে- এটা দীর্ঘস্থায়ী নয়। কাশ্মীর সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান ছাড়া এই দুঃস্বপ্নের পুনরাবৃত্তি অবশ্যম্ভাবী। একজন তরুণ বলেন, প্রতিবারই কাশ্মীরই বেশি ভোগে। এই মুহূর্তে কাশ্মীরিদের একটাই প্রশ্ন: আর কতদিন চলবে এই ধারা?

mzamin

No comments

Powered by Blogger.