নাকবা দিবসে আরও বেপরোয়া ইসরায়েল, নিহত ১৪৩ ফিলিস্তিনি

১৫ মে ছিল নাকবা বা মহাবিপর্যয় দিবস। ৭৭ বছর আগে ফিলিস্তিনিদের ওপর নেমে আসে মহাবিপর্যয় এবং এদিন তারা ঘর হারিয়েছিল। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছে ফিলিস্তিনিরা। সেই নির্যাতন-দখলদারত্ব আজও তাড়া করছে তাদের। তাই বিশ্বজুড়ে ফিলিস্তিনিরা এ দিবস পালন করে।

১৯৪৮ সালের ১৪ মে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ইসরায়েল রাষ্ট্রের ঘোষণা করা হয়। ফিলিস্তিনিদের ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে নেমে আসে মহাবিপর্যয়। এ কারণে ফিলিস্তিনিরা প্রতিবছর ১৫ মে পালন করে ‘আল-নাকবা’ (মহাবিপর্যয়) দিবস।

নাকবা দিবসের ৭৭তম বর্ষপূর্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাজুড়ে নির্বিচারে নৃশংস হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১৪৩ জন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগ নারী-শিশু।

স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকায় গতকাল ভোরের দিকে চালানো হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬১ জন। উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়ায় আত-তাওবাহ চিকিৎসাকেন্দ্রে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ গেছে আরও অন্তত ১৫ জনের। হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।

ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার জেরে গাজাজুড়ে অন্তত তিনটি হাসপাতালের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো জাবালিয়ার আল-আওদা হাসপাতাল, খান ইউনিসের ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল এবং ইউরোপীয়ান হাসপাতাল।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, এদিন গাজার জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের একটি চিকিৎসাকেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলায় আত-তাওবাহ ক্লিনিকের ওপরতলায় রোগীরা ছিন্নভিন্ন হয়ে যান। সেখানে নিহত ১৩ জনের মধ্যে কয়েকটি শিশুও রয়েছে।

আল-জাজিরার সংবাদদাতা তারেক আল আজৌম গাজার দেইর আল বালাহ এলাকা থেকে বলেন, গাজাবাসীর জন্য এটা আরেকটি রক্তাক্ত দিন। ইসরায়েলি বাহিনী আবাসিক এলাকাতেও নির্বিচারে বিমান হামলা চালিয়েছে। খান ইউনিসের অন্তত ৯টি বাড়িতে পূর্বসতর্কতা ছাড়াই হামলা চালানো হয়েছে।

এক বিবৃতিতে হামাস বলেছে, দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি এবং কাতার ও মিসরের মধ্যস্থতায় হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে পরোক্ষ যুদ্ধবিরতি নিয়ে আলোচনা চলছে। এর মধ্যেই ইসরায়েলি বাহিনী মরিয়া আচরণ করছে।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলের মাটিতে হামলা চালায়। এতে আনুমানিক ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

হামাস–নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, উপত্যকাটিতে ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৩ হাজার ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহত ব্যক্তিদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জন।

তবে গাজার সরকারি গণমাধ্যম কার্যালয়ের তথ্য বলছে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০ ছাড়িয়ে গেছে। তারা বলেছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে নিখোঁজ থাকা হাজারো মানুষকে মৃত বলে ধরে নেওয়া হয়েছে।

ইসরায়েলের নৃশংসতা: গাজায় নিহত ৫৩ হাজার ছাড়াল

* গত ২ মার্চ থেকে গাজায় কোনো ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল।
* গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত মানবিক কার্যক্রমে জাতিসংঘ অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে।

গাজা ‘জয়ের’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নেমেছে ইসরায়েল। উপত্যকাটিতে চরম নৃশংসতা চালাচ্ছে দেশটির সামরিক বাহিনী। গতকাল শুক্রবারও সেখানে অন্তত ১০০ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এতে সংঘাতের ১৮ মাসের বেশি সময় গাজায় ৫৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। তাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, গতকাল ও আগের দিন উপত্যকাটিতে ২৫০ জনের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এ সময় উত্তর গাজার বাসিন্দাদের ওপর ব্যাপক গোলাবর্ষণ করা হয়েছে। চলেছে আকাশপথে হামলা। গতকাল ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, শুক্রবার গাজায় দেড় শর বেশি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে তারা।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এতে প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। দেশটি থেকে জিম্মি করা হয় প্রায় আড়াই শ জনকে। সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ইসরায়েলের হামলায় এ পর্যন্ত ৫৩ হাজার ১১৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জন।

হামলার পাশাপাশি গত ২ মার্চ থেকে গাজায় কোনো ত্রাণসহায়তা প্রবেশ করতে দিচ্ছে না ইসরায়েল। এতে সেখানে খাবার–পানিসহ জরুরি পণ্যের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে গাজার মানুষের সহায়তার পক্ষে মত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, গাজার মানুষ অনাহারে ভুগছে। আগামী এক মাসে অনেক ভালো কিছু হবে বলে তিনি আশা করছেন।

কাতারের রাজধানী দোহায় একটি অনুষ্ঠানে গাজা নিয়ে এ কথা বলেন ট্রাম্প। গাজায় যুদ্ধ সম্প্রসারণে ইসরায়েলের পরিকল্পনাকে তিনি সমর্থন করেন কি না—সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমি মনে করি, আগামী এক মাসে অনেক ভালো কিছু হতে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের ফিলিস্তিনিদেরও সাহায্য করতে হবে।’

এর আগেই অবশ্য গাজা উপত্যকা দখল করার কথা বলেছিলেন ট্রাম্প। তাঁর ভাষ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্র গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারলে ভালো হবে। এরপর সেখানে ‘ফ্রিডম জোন’ (মুক্ত অঞ্চল) তৈরি করা হবে। এতে সেখানে সব মানুষ নিরাপদে বসবাস করতে পারবেন। ট্রাম্প বলেন, ‘এখানে যুক্তরাষ্ট্রকে যুক্ত হতে দিন। আমি খুবই গর্বিত হব, যদি গাজার নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্র নেয়।’

এ সময় ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে চালানো হামাসের হামলা নিয়েও কথা বলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ট্রাম্পের ভাষ্যমতে, এটি মানব ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস ঘটনা ছিল। তিনি বলেন, হামাসকে মোকাবিলা করতে হবে। গাজার নিয়ন্ত্রণ নিতে হলে আগে হামাসকে মোকাবিলা করা দরকার।

এদিকে গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থিত মানবিক কার্যক্রমে জাতিসংঘ অংশ নেবে না বলে জানিয়েছে। এই কার্যক্রম নিরপেক্ষ ও স্বাধীন নয় বলে মনে করছে তারা। বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের মুখপাত্র সাংবাদিকদের বলেন, মানবিক সহায়তা বিতরণের এ পরিকল্পনাটি জাতিসংঘের মূল নীতিমালার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাই এতে জাতিসংঘ অংশ নেবে না।

পরিস্থিতি যখন দিন দিন আরও সংকটপূর্ণ হচ্ছে, তখন যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তি নিয়ে ইসরায়েল ও হামাসের আলোচনায় কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না বলে জানিয়েছে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম হারেৎজ। কাতারে চলমান এই আলোচনার বিষয়ে একটি সূত্র সংবাদমাধ্যমটিকে জানায়, ইসরায়েলের অবস্থান অনড়, হামাস এখনো নতি স্বীকার করেনি, আর মার্কিনরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। 

No comments

Powered by Blogger.