ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করল যুক্তরাজ্য, বসতি স্থাপনকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা
৫ মে থেকে গাজায় নতুন করে অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। গতকাল সোমবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘পুরো গাজার নিয়ন্ত্রণ’ নেওয়ার পরিকল্পনা করছে তাঁর সরকার। দীর্ঘ ১১ সপ্তাহ অবরোধের পর এদিনই উপত্যকাটিতে পাঁচ ট্রাক ত্রাণ ঢুকতে দিয়েছে ইসরায়েল। তবে গাজা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রতিদিন সেখানে ৫০০ ট্রাক ত্রাণ প্রয়োজন।
আজ মঙ্গলবার যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামাসের হামলার পর দেশটির আত্মরক্ষার অধিকারকে সমর্থন দিয়েছে যুক্তরাজ্য। তবে এই সংঘাত এখন এক ‘কালো অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে’। ১১ সপ্তাহ ধরে গাজা অবরোধ করে রেখেছে ইসরায়েলি বাহিনী। এতে উপত্যকাটিতে কাজ করা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) হাতে খাবারের মজুত শেষ হয়ে গেছে।
যুক্তরাজ্যের আইনপ্রণেতাদের ডেভিড ল্যামি আরও বলেন, আজ পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে তিনজন ব্যক্তি ও চারটি প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাজ্য। যারা নৃশংসভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়ে যাবে ব্রিটিশ সরকার।
এর মধ্যে আজ যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গাজায় ইসরায়েলের হামলা, পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি বসতি স্থাপন বৃদ্ধি এবং বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতার ঘটনার জেরে যুক্তরাজ্যে ইসায়েলের দূত জিপুরা হোতোভেলিকে তলব করেছে ব্রিটিশ সরকার।
বসতি স্থাপনকারীদের ওপর যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞাকে ‘বিভ্রান্তিকর, অযৌক্তিক ও দুঃখজনক’ বলেছে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলেছে, নিজেদের অস্তিত্ব ও নিরাপত্তার জন্য ইসরায়েলের ধ্বংস চাওয়া শত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে দেশটি। বাইরের চাপের কারণে এই সংগ্রাম থেকে সরে যাবে না ইসরায়েল।
আর বাণিজ্য আলোচনা স্থগিত করা নিয়ে ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘ইসরায়েলবিরোধী আবেগ ও অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের কারণে যুক্তরাজ্য যদি নিজেদের অর্থনীতির ক্ষতি করতে চায়, তাহলে সেটি তাদের সিদ্ধান্ত।’
ইসরায়েলকে নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্সের
গাজায় নতুন করে শুরু করা সামরিক অভিযান বন্ধ না করলে এবং ফিলিস্তিনিদের ভূখণ্ডটিতে ত্রাণ প্রবেশে বাধা সরিয়ে না নিলে ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি দিয়েছে যুক্তরাজ্য, কানাডা ও ফ্রান্স।
গাজা যুদ্ধ বন্ধ করতে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। গতকাল সোমবার এই তিন দেশের নেতাদের নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি সেই চাপ আরও বাড়াবে।
যদিও সব ধরনের চাপ উপেক্ষা করে গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ। গত শুক্রবার আইডিএফ গাজায় নতুন করে স্থলাভিযান শুরু করার ঘোষণা দিয়েছে।
তিন দেশের নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকি আসার আগে সোমবার নেতানিয়াহু বলেছিলেন, ইসরায়েল পুরো গাজার নিয়ন্ত্রণ নেবে। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই গাজায় আসন্ন দুর্ভিক্ষের বিষয়ে সতর্ক করেছেন।
ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইসরায়েল সরকার (গাজার) বেসামরিক জনগণের জন্য অত্যাবশ্যক মানবিক সহায়তা দিতে অস্বীকার করছে, এটি অগ্রহণযোগ্য এবং এতে আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি রয়েছে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা পশ্চিম তীরে (ইহুদি) বসতি সম্প্রসারণের যেকোনো প্রচেষ্টারও বিরোধিতা করছি... প্রয়োজনে আমরা পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে পিছপা হব না, যার মধ্যে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সত্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপও অন্তর্ভুক্ত।’
এর জবাবে নেতানিয়াহু বলেছেন, ‘লন্ডন, অটোয়া ও প্যারিসের নেতারা ৭ অক্টোবর ইসরায়েলের ওপর চালানো জাতিগত নিধনমূলক হামলার জন্য বিশাল পুরস্কারের প্রস্তাব দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে তাঁরা ভবিষ্যতে এমন আরও নৃশংসতাকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।’
নেতানিয়াহু আরও বলেন, ইসরায়েল ন্যায়সংগত উপায়ে আত্মরক্ষা করবে, যতক্ষণ না পূর্ণ বিজয় অর্জিত হয়। তিনি যুদ্ধ শেষ করার জন্য ইসরায়েলের শর্তগুলোর কথা পুনরায় উল্লেখ করেন, যার মধ্যে বাকি জিম্মিদের মুক্তি এবং গাজা উপত্যকার নিরস্ত্রীকরণ রয়েছে।
হামাসকে চাপে ফেলে বাকি জিম্মিদের মুক্ত করার কৌশল হিসেবে মার্চের শুরু থেকে ইসরায়েল গাজায় চিকিৎসা, খাদ্য, জ্বালানিসহ সব ধরনের ত্রাণ প্রবেশ বন্ধ করে দেয়।
এক যৌথ বিবৃতিতে তিন পশ্চিমা দেশের নেতারা বলেছেন, ‘সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে নাগরিকদের সুরক্ষায় ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারকে আমরা সব সময় সমর্থন করেছি। কিন্তু বর্তমান সহিংসতা সম্পূর্ণরূপে অসংগত।’
নেতারা আরও বলেন, নেতানিয়াহু সরকারের ‘এই জঘন্য কর্মকাণ্ড’ চালিয়ে যাওয়া তাঁরা চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে দেখে যেতে পারেন না।
ওই তিন দেশের নেতারা গাজায় এখনই একটি যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কাতার ও মিসরের নেতৃত্বে চলমান উদ্যোগগুলোর প্রতিও তাঁদের সমর্থন প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি তাঁরা বলেছেন, ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের দ্বিরাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের অংশ হিসেবে একটি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
হামাস তিন পশ্চিমা দেশের যৌথ বিবৃতিকে স্বাগত জানিয়ে একে ‘সঠিক পথের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে।
হামাস পরিচালিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই সাধারণ ফিলিস্তিনি।
ইসরায়েলি পণ্য বর্জন করতে যাচ্ছে যুক্তরাজ্যের বৃহৎ খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠান কো-অপ
যুক্তরাজ্যের অন্যতম বৃহৎ সুপারমার্কেট ব্র্যান্ড কো-অপ শিগগিরই ইসরায়েলের সব পণ্য বর্জন করে একটি নজির গড়তে পারে। যদি এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়, তবে কো-অপ প্রথম কোনো ব্রিটিশ খুচরা পণ্য বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান হবে, যারা ইসরায়েলি পণ্য সম্পূর্ণভাবে বর্জন করবে। এ সিদ্ধান্তের পেছনে রয়েছে গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যার অভিযোগ।
গত শনিবার অনুষ্ঠিত কো-অপের বার্ষিক সাধারণ সভায় প্রস্তাবটি বিপুল সমর্থন পেয়ে গৃহীত হয়। ৭৩ শতাংশ ভোটার প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেন। এতে বোর্ডকে ইসরায়েলের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করে দেওয়ার মাধ্যমে ‘নৈতিক সাহস ও নেতৃত্ব’ প্রদর্শনের আহ্বান জানানো হয়। সদস্যদের ভাষায়, এটি গাজার ওপর ইসরায়েলের ‘ধ্বংসযজ্ঞ’-এর বিরুদ্ধে একটি জবাবদিহিমূলক পদক্ষেপ।
প্রস্তাবটি বাধ্যতামূলক না হলেও কো-অপের একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সরবরাহ নীতিমালা পর্যালোচনা করছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা নিয়মিত সরবরাহ নীতিগুলো পর্যালোচনা করি, যাতে আমাদের মূল্যবোধ, নীতিমালা এবং সদস্যদের ইতিমধ্যে স্পষ্ট করা মতামত সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়।’
গ্রীষ্মের শেষ নাগাদ এ পর্যালোচনা শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। তখনই কো-অপ তাদের দোকান থেকে ইসরায়েলি পণ্য সরিয়ে ফেলতে পারে।
এ প্রস্তাবের পক্ষে কাজ করেছে প্যালেস্টাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেইন (পিএসসি) নামের একটি সংগঠন। ভোটের ফলাফলকে তারা ফিলিস্তিনের প্রতি যুক্তরাজ্যের ব্যাপক জনসমর্থনের প্রতিফলন হিসেবে স্বাগত জানিয়েছে। সংগঠনটির মুখপাত্র লুইস ব্যাকন বলেন, ‘এই ভোট দেখিয়েছে, যুক্তরাজ্যের সাধারণ মানুষ ফিলিস্তিনের ন্যায়বিচার ও স্বাধীনতার পক্ষে আছেন এবং তাঁরা ইসরায়েলের বর্ণবৈষম্যমূলক অর্থনীতিকে সমর্থন করতে চান না। কো-অপকে এখন তাদের সদস্যদের কথা শুনতে হবে এবং সব ইসরায়েলি পণ্য তুলে নিতে হবে।’
কো-অপ সব সময় নৈতিক অবস্থানের কারণে যুক্তরাজ্যের অন্যান্য সুপারমার্কেট থেকে আলাদা। ২০০৭ সালে তারা প্রথম ব্রিটিশ খুচরা বিক্রেতা হিসেবে দখল করা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে অবৈধ ইসরায়েলি বসতিতে তৈরি পণ্য বর্জন করে। নতুন প্রস্তাবের পক্ষে থাকা সদস্যরা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ২০২২ সালে ইউক্রেনে হামলার পর কো-অপ রুশ পণ্য বিক্রিও বন্ধ করেছিল। তাই ইসরায়েল ইস্যুতেও একই ‘নৈতিকতা ও মূল্যবোধ’ অনুসরণের দাবি জানিয়েছেন তাঁরা।
এমন এক সময়ে এ ভোট অনুষ্ঠিত হলো, যখন গাজায় ইসরায়েলের হামলায় করপোরেট সহযোগিতা থাকার বিষয়টি নিয়ে বিশ্বজুড়ে ব্যাপক প্রশ্ন উঠছে। অক্টোবর ২০২৩ থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি আগ্রাসনে ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাঁদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু। কো-অপ সদস্যরা যুক্তি দিয়েছেন, এমন পরিস্থিতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া প্রতিষ্ঠানটির মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়ের প্রতিশ্রতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।
উল্লেখ্য, প্রস্তাবটি পাস হয়েছে এমন এক সময়ে, যখন ইউকে লইয়ার্স ফর ইসরায়েল নামের একটি বিতর্কিত আইনি সংগঠন এটিকে প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিচ্ছিল। তারা কো-অপের বিরুদ্ধে ‘জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো’ এবং ‘মিথ্যা ও মানহানিকর’ বক্তব্য প্রচারের অভিযোগ তোলে। তবে কো-অপ তাদের সদস্যদের এ প্রস্তাবের ওপর ভোট দেওয়ার সুযোগ দিয়েছিল, যা তাদের অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রমাণ।
যদিও এ ভোটের ফলে কো-অপের পরিচালনা পর্ষদ কোনো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য নয়, তবু বহু সদস্য ও অধিকারকর্মীদের মতে, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর না করলে কো-অপের মূল্যবোধভিত্তিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি মারাত্মকভাবে প্রশ্নের মুখে পড়বে।
| যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি। ছবি: রয়টার্স |
No comments