গাজাবাসীও কি সুবর্ণরেখার মতো ঘরের স্বপ্ন দেখে by সুজন সুপান্থ
বাড়ির প্রতি, ঘরের প্রতি মানুষের যে টান, তা ‘সুবর্ণরেখা’ সিনেমা দেখলে স্পষ্ট হয়ে যায়। আরেকটি দৃশ্যে দেখা যায়, ছাতিমপুর স্টেশন থেকে নতুন বাড়ি যাওয়ার পথে সীতা মুখুজ্জেবাবুর কাছে জানতে চেয়েছিল, ‘কোথায় সেই নতুন বাড়ি?’ মুখুজ্জেবাবু নির্দিষ্ট করে কিছু বলতে পারেননি। দূরে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, ‘উই যে দূরে নীল নীল পাহাড় আকাশে পিঠটি মেলে দেইছে, তার পাশ দিয়ে নদীটি এঁকেবেঁকে চলে গেছে। ঠিক উইখানটিতে তোমাদের নতুন বাড়ি। কত ফুল, কত পাখি, কত প্রজাপতি, কত বড় বড় শূন্য ঘর, কত গান, কত বাজনা—সুবর্ণরেখা। সোনার রেখাটি, তার পাশেই তোমার বাড়িটি।’ এরপর সীতার হৃদয়ে এই বাড়ির দৃশ্য গাঁথা হতে থাকে। কল্পনায় সে এই বাড়িতে ঘোরাফেরা করে। ফুল-পাখি-প্রজাপতিদের সঙ্গে খেলা করে সীতা। কিন্তু বাস্তবে এই বাড়ি পৌঁছানোর দিশা খুঁজে পায়নি সে।
বাস্তবে বাড়ির দিশা খুঁজে না পেলেও সে সময় হৃদয়ে একটা বাড়ির ছবি আঁকা হয়ে গিয়েছিল সীতার। ওটাই মূলত তার বাড়ি। বাড়ি তাহলে কী? এ প্রশ্নের একটাই জবাব, হৃদয় যেখানে থাকে, সেটাই বাড়ি। হয়তো এ কারণে ১৯৬২ সালে কিংবদন্তি সংগীত তারকা কিং অব রক অ্যান্ড রোল এলভিস প্রিসলিও গেয়েছিলেন—‘হোম ইজ হয়্যার দ্য হার্ট ইজ’।
আমার মনে হয়, নিজের কাছে নিজে ফেরার নামই ঘর বা বাড়ি। কারণ, ঘর বাঁধতে বাঁধতে মানুষ আশ্চর্য আটনে নিজেকেই বেঁধে রাখে তার চারপাশে। এক অপরিমেয় মমতায় সেই ঘরে নিজেকে হারিয়ে ফেলে যাপন করে মানুষ। নইলে কাজ ফুরানো বিকেলে ঘরের দাওয়ায় বা আধভাঙা জলচৌকিতে কেন কথাহীন বসে থাকে মানুষ!
এই বহুদূর শহর থেকে দীর্ঘ অপেক্ষা পেরিয়ে বাড়ি ফিরে একটু দূর থেকে দেখি, সেই কবে বাড়িতে রেখে যাওয়া আরেকটি বয়সের আমি—হাফপ্যান্ট পরা আরেকটা আমি তাকিয়ে আছে এই আমির দিকে। এই চোখে দেখি তার টলটলে চোখ। দুজনের চোখের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একই পৃথিবীর রং। চোখ বুজে আলতো করে তার চুলে বিলি কেটে দেখি, হেসে উঠছে দুজনের বুকের জখম। তাহলে এবার বলুন, বাড়ি মানে কি নিজের কাছেই নিজের ফেরা নয়!
তাহলে ফিলিস্তিনের বাস্তুচ্যুত, ঘরহারা মানুষেরা কীভাবে, কোথায় ফিরছে? আল–জাজিরার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ হওয়ার পর গাজা থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয়শিবিরে থেকে নিজের বাড়ির কথা মনে হয়নি ১১ বছর বয়সী কারেম সামরার। তার বারবার শুধু মনে হয়েছে স্কুলের কথা। তার মন পড়ে ছিল শ্রেণিকক্ষের জানালার কাছে, যে জানালার শিক ধরে সে ক্লাসের ফাঁকে আকাশ দেখত। দেখত স্কুলের বাগানে ফুটে থাকা ফুল, ফুলে উড়ে বসা প্রজাপতি আর পাখিদের কিচিরমিচির। শ্রেণিকক্ষের এক কোনায় রাখা থাকত সব শিক্ষার্থীর বই-খাতা আর ক্রেয়ন। নিজেদের ঘরের বদলে কারেম সামরার ওই ক্রেয়নগুলোর কথা খুব মনে পড়ত। ভাবত, স্কুলে গিয়ে কি আর খুঁজে পাবে নিজের আঁকিবুঁকি করার ওই ক্রেয়নগুলো!
যুদ্ধবিরতি চুক্তি হওয়ার পর কারেম সামরা পরিবারের সঙ্গে ফিরে নিজের ঘর ও ক্রেয়নগুলো খুঁজে পেয়েছিল কি না, জানা যায়নি। ভেঙে চুরমার হয়ে যাওয়া গাজায় তা খুঁজে পাওয়ার কথাও নয়। তার হৃদয় যেখানে পড়ে ছিল, বিধ্বস্ত হয়ে গেছে সেই স্কুলঘর। অথচ কারেম সামরার কাছে এই স্কুলঘরই ছিল ঘরের বাইরে আরেক আপন ঘর।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি ভূখণ্ডে হামাস হামলা চালায়। ওই দিন থেকে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। আল–জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৮ মাস ধরে চলা যুদ্ধে গাজা উপত্যকায় নারী ও শিশু মিলিয়ে ৫১ হাজার ২৫ জন নিহত হয়েছেন। আহতের সংখ্যা ১ লাখ ১৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে বাড়ি ফেরা অবরুদ্ধ গাজার ফিলিস্তিনিদের ভেতরে–ভেতরে যেন বেজে উঠেছিল পুরোনো শুশ্রূষার সুর। খান ইউনিস, গাজাছবি: রয়টার্স
জাতিসংঘ বলছে, গত ১৮ মার্চ হামাসের সঙ্গে সই হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভেঙে দেয় ইসরায়েল। এর পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় পাঁচ লাখ গাজাবাসী নতুন করে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। এর আগে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন আরও লাখো মানুষ।
সিএনএনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে হামাসের সঙ্গে সই হওয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তির পর আশপাশে আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা হোক ভাঙা, তবু ঘরের টানে ফিরতে শুরু করে। বোমার আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়া আস্ত এক উপত্যকায় ফিরলেও আদতে ঘরে ফেরা হয়নি তাঁদের। কারণ, বাড়িতে যে কিছুই নেই। ইসরায়েলি হামলায় সবই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে।
দেইর আল বালা এলাকার এমনই এক বাসিন্দা আবদুল ফাত্তাহ। তিনি বলেন, ‘আমরা বাড়ি ফিরে দেখি, কিছুই নেই। ঘর নেই, বিদ্যুৎ নেই, গ্যাস নেই। এমন ঘরে ফিরলাম, পোশাকও বদলাতে পারি না। জন্মের সময়ের মতো নিঃস্ব আমি। আমার আর কিছুই নেই। ঘরের খোঁজ নিতে বাড়ি ফিরে দেখছি ধ্বংসস্তূপ। কোথায় আমার ঘর?’
দীর্ঘ অপেক্ষা শেষে বাড়ি ফেরা অবরুদ্ধ গাজার ফিলিস্তিনিদের ভেতরে–ভেতরে যেন বেজে উঠেছে পুরোনো শুশ্রূষার সুর। এই সুরে মানুষের ভিড় ঠেলে একজন মানুষ কি একা হয়ে নিজের ঘরের দরজার চিহ্ন খুঁজে তার পাশে বসতে চেয়েছে কিছুক্ষণ? জিরেন চেয়েছে কিছুটা? আর পর মুহূর্তে যেন ভীষণ জ্বরের শেষে নিজেদের ভেতর জেগে উঠেছে সূর্যধোয়া ঘর।
জানালার শিক গলে আকাশ, ফুল, প্রজাপতি, পাখি দেখবে বলে ঘরহীন শিশুটির ছিল সেই কত দিনের পিত্যেশ! অথচ সেই হা-পিত্যেশের ওপারে দাঁড়িয়ে আছে বিধ্বস্ত শহর। কল্পনায় অসহায় ওই শিশুটির ভাষাহীন চোখের দিকে তাকালে মনে হয়, নিজের বুকের ভেতর এঁকে দিই তার চৌকো জানালার আলো।
![]() |
| ইসরায়েলি হামলায় বিধ্বস্ত হয়ে হয়ে গেছে বাড়ি। ধ্বংসস্তূপের ভেতর যতটুকু পেয়েছেন, তা–ই নিয়ে বের হয়েছেন এই ব্যক্তি। খান ইউনিস, গাজা। ছবি: রয়টার্স |

No comments