ইসরায়েলি সেনারাই কি যুদ্ধ থামাতে চাইছে? by পাপলু রহমান
ইসরায়েলি সেনাদের মনস্তাত্ত্বিক ভাঙন
দীর্ঘদিনের যুদ্ধ একের পর এক সামরিক অভিযান ও সহিংসতার মধ্যে পড়ে ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে একটি বিশাল মনস্তাত্ত্বিক চাপ তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর তথ্য মতে, যারা গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন, তাদের মধ্যে প্রায় ১০ শতাংশ এখনো সক্রিয় রিজার্ভ সদস্য, আর বাকিরা অবসরপ্রাপ্ত।
তবে এসব সাবেক সেনারাও জানাচ্ছেন, তারা এই যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারছেন না। এমনকি অনেকে সেনাবাহিনী থেকে সরে যাওয়ার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে আহত হওয়ার পথও বেছে নিচ্ছেন। একটি জরিপে দেখা গেছে, ৬০ শতাংশ ইসরায়েলি নাগরিক বর্তমানে যুদ্ধের বিপক্ষে। এটা শুধু শারীরিক ক্লান্তি নয়, নৈতিক দ্বন্দ্বও বড় কারণ। দীর্ঘমেয়াদী দখলদারত্ব ও নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা, বিশেষ করে শিশু ও বেসামরিক জনগণের হতাহতের চিত্র, অনেক ইসরায়েলি সৈন্যের বিবেককে নাড়া দিয়েছে।
গাজার বিভীষিকা ও বিশ্ব জনমত
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি অবরোধ, অবৈধ বসতি সম্প্রসারণ ও হামলা বহুদিন ধরেই চলেছে। তবে ২০২৪ সালের সাম্প্রতিক অভিযানগুলোকে ইতিহাসের অন্যতম নৃশংস গণহত্যা বলছেন অনেক বিশ্লেষক। গাজায় একের পর এক বিমান হামলা, হাসপাতাল, স্কুল এমনকি শরণার্থী শিবিরেও হামলা হয়েছে। জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো একের পর এক বিবৃতি দিয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের নিন্দা জানিয়েছে। তবে এই চাপ সত্ত্বেও নেতানিয়াহুর সরকার বারবার যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন অভিযান শুরু করেছে।
ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ
একদিকে যখন ইসরায়েলি সেনারা ক্লান্ত ও বিভ্রান্ত, অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ এখন আরও সংঘবদ্ধ। গাজা ছাড়িয়ে এখন পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলি সেনাদের লক্ষ্যবস্তু করা হচ্ছে। জেনিন ব্রিগেড, আল কুদস ব্রিগেড ও নাবলুস ব্যাটেলিয়নের মতো গোষ্ঠীগুলো সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধে জড়িত। সাম্প্রতিক এক হামলায় জেনিন ব্রিগেড আইইডি ব্যবহার করে ইসরায়েলি সাঁজোয়া যান ধ্বংস করেছে। এসব হামলা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ফিলিস্তিনিরা এখন অনেক বেশি সংগঠিত, কৌশলী ও প্রস্তুত।
সেনা অভ্যুত্থানের শঙ্কা
সেনারা যখন যুদ্ধবিরতি ও শান্তির পক্ষে গণস্বাক্ষর দিচ্ছে, তখন নেতানিয়াহু প্রশাসন এদের উগ্রপন্থী বা দেশদ্রোহী আখ্যা দিচ্ছে। সরকার সেনাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার চেষ্টা করছে, কিন্তু এর ফলে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিভাজন আরও প্রকট হচ্ছে। অনেক বিশ্লেষক মনে করছেন, ইসরায়েলের সেনা ও প্রশাসনের এ বিভাজন একটি সম্ভাব্য গৃহযুদ্ধ বা সামরিক অভ্যুত্থানের সূচনা হতে পারে। নেতানিয়াহু সরকার যুদ্ধ চালিয়ে যেতে মরিয়া হলেও, বাস্তবতা হচ্ছে— পর্যাপ্ত সেনা যোগাড় হচ্ছে না। যারা রিজার্ভ বাহিনীতে যোগ দিচ্ছেন, তারাও নানা অজুহাতে বাহিনী ছাড়ার চেষ্টা করছেন।
ইসরায়েলের বিচ্ছিন্নতা
ইসরায়েলের এই যুদ্ধনীতির বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক মঞ্চেও বিরোধিতা বাড়ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অবস্থান কিছুটা নরম হয়ে এসেছে। তুরস্ক, ইরান, কাতার, মালয়েশিয়াসহ অনেক মুসলিম দেশ প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বারবার বলেছেন, ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা ছাড়া শান্তি সম্ভব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে হামাস ও ইসলামিক জিহাদকে সমর্থন দিয়ে গাজায় প্রতিরোধ আরও জোরালো হয়েছে। ইয়েমেন থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ইসরায়েলের অভ্যন্তরে আঘাত হানছে। সিরিয়ার সঙ্গে সীমান্ত উত্তপ্ত, লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘর্ষ নিয়মিত হয়ে উঠছে। এ সবগুলো ফ্রন্ট একসাথে খুলে গেলে ইসরায়েলের পক্ষে এককভাবে সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। ইসরায়েলের অভ্যন্তরেও রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা প্রকট আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিনই দেশজুড়ে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মারাত্মক অবনতি ঘটেছে। বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও যুদ্ধের অবসাদ জনজীবনে হতাশা সৃষ্টি করেছে। ফলে জনমত এখন আর নেতানিয়াহুর পাশে নেই।
এ পরিস্থিতিতে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, যদি দ্রুত একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ও শান্তি আলোচনা শুরু না হয়, তাহলে ইসরায়েল শুধু তার সামরিক শক্তি নয়, রাষ্ট্রীয় কাঠামোতেও ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ এইবার শুধু প্রতিরক্ষা নয়, এটি তাদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। আর ইসরায়েলি সেনাদের যুদ্ধবিরতি চাওয়াও কেবল শান্তির পক্ষে নয়, এটি এক মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ।
![]() |
| ইসরায়েলি সেনাদের একাংশ গাজা যুদ্ধকে সমর্থন করতে পারছে না। ছবি: সংগৃহীত |

No comments