পাক-ভারত পাল্টাপাল্টি
বিবিসি’র সাংবাদিক সৌতিক বিশ্বাস লিখেছেন, মঙ্গলবার পহেলগাঁওয়ে কমপক্ষে ২৬ পর্যটককে হত্যা করা হয়েছে। ২০১৯ সালের পর থেকে ভারতশাসিত কাশ্মীরে এটাই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী হামলা। ওই হত্যার পর দ্রুতই নয়াদিল্লি ৫টি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। এগুলো হলো- ১) সিন্ধুনদের পানি চুক্তি স্থগিত করেছে ভারত। ২) উপরন্তু কূটনৈতিক সম্পর্ককে অবনমন করেছে। কূটনৈতিক মিশনের সদস্য প্রায় অর্ধেক কমিয়ে ফেলার কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যদিয়ে পাকিস্তানকে কূটনৈতিকভাবে দমন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ৩) আটারিতে অবস্থিত সমন্বিত চেকপোস্ট বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ৪) সার্ক ভিসা ছাড়ের স্কিমের আওতায় পাকিস্তানি নাগরিকরা ভারত সফরের অনুমতি পাবেন না এবং ৫) পাকিস্তানি হাইকমিশনের প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। আগামী ১লা মে’র মধ্যে হাইকমিশনের শক্তি ৫৫ থেকে কমিয়ে ৩০-এ নামিয়ে আনতে বলা হয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং কড়া জবাব দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, ভারতের মাটিতে ন্যক্কারজনক ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তি এবং এর মূলহোতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এমন অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালাতে পারে ভারত। তবে তা কখন এবং কীভাবে, কী মাত্রার হবে তা কেউ জানেন না। সামরিক ইতিহাসবিদ শ্রীনাথ রাঘবন বলেন, আমরা সম্ভবত খুব দৃঢ় একটি প্রতিক্রিয়া দেখতে পাবো, যা পাকিস্তানের মানুষ এবং তাদের নেতাদের সবার প্রতিই দৃঢ় ইঙ্গিত দেয়। ২০১৬ সালের পর থেকে, বিশেষ করে ২০১৯ সালের পর সীমান্ত অতিক্রম করে প্রতিশোধ নেয়ার সীমানা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর চেয়ে কম করা সম্ভবত (ভারত) সরকারের জন্য কঠিন হবে। কিন্তু আগে যেমন ঘটেছে, পাকিস্তানও তার জবাব দিতে পারে। তবে সব সময়ই উভয়পক্ষে ভুল করার ঝুঁকি থেকে যায়। ২০১৬ সালে উরি’তে হামলায় নিহত হয় ভারতের ১৯ সেনাসদস্য। এরপরই ওই বছর সেপ্টেম্বর মাসে সীমান্ত অতিক্রম করে পাকিস্তানের ভেতরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ বা হামলা করে ভারত। তারা তখন বলে, পাকিস্তানশাসিত কাশ্মীরে জঙ্গিদের লঞ্চপ্যাড লক্ষ্য করে এই হামলা চালানো হয়েছে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামায় হামলায় ভারতের কমপক্ষে ৪০ জন আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য নিহত হয়। এর জবাবে বালাকোটা ‘জঙ্গিদের ক্যাম্প’ লক্ষ্য করে হামলা চালায় ভারত। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এটাই পাকিস্তানের অনেক ভেতরে প্রবেশ করে ভারতের হামলা। ওই হামলার জবাবে আকাশ পথে অভিযান চালায় পাকিস্তান। ফলে উভয় বাহিনীর মধ্যে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য যুদ্ধ হয়। তাতে ভারতের একজন পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান। এই স্বল্প সময়ের যুদ্ধে উভয় পক্ষ শক্তি প্রদর্শন করেছে। তবে তারা একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ এড়াতে সক্ষম হয়েছে। এর দুই বছর পরে ২০২১ সালে তারা নিয়ন্ত্রণরেখায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়। পররাষ্ট্রনীতির বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বিশ্বাস করেন, এর আগের হামলায় ভারতের যে উচ্চ পর্যায়ের প্রাণহানি হয়েছে এবং বেসামরিক লোকজনকে টার্গেট করা হয়েছে তার প্রেক্ষিতে বলা যায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের শক্তিশালী সামরিক ব্যবস্থা নেয়ার সম্ভাবনা আছে। অবশ্য, যদি (পহেলগাঁও) হামলায় পাকিস্তান কোনোভাবে জড়িত বলে যদি দিল্লি নিশ্চিত হয় বা ধরে নেয়, (তাহলেই এমন ঘটনা ঘটতে পারে)। ভারতের জন্য এই ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার প্রধান সুবিধা হবে রাজনৈতিক। কারণ, এমন জোরালো প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য সরকারের ওপর জনগণের প্রবল চাপ থাকবে। এর আরেকটি সুবিধা আছে। যদি ভারত সফলভাবে সন্ত্রাসীদের টার্গেট ধ্বংস করে তাহলে ভারতবিরোধী হুমকি কমে যাবে এবং প্রতিরোধ ক্ষমতা পুনরুদ্ধার হবে। তবে অসুবিধা হলো, এমন প্রতিশোধ নিতে গেলে তাতে গুরুতর সংকট সৃষ্টির ঝুঁকি থাকবে। এমনকি যুদ্ধও হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অ্যাট আলবেনি’র ক্রিস্টোফার ক্লেরি বলেন, প্রথমত ২০২১ সালের নিয়ন্ত্রণরেখার যুদ্ধবিরতি লংঘিত হচ্ছে এবং সীমান্ত অতিক্রম করে হামলায় সবুজসংকেত দিতে পারেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। দ্বিতীয়ত, ২০১৯ সালের মতো প্রচলিত বিমান হামলা অথবা প্রচলিত ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার বিষয় হাতে থাকতে পারে। তবে এর প্রতিটিতেই প্রতিশোধ নেয়ার ঝুঁকি থাকবে। ফলে ঝুঁকিমুক্ত কোনো পথই নেই। এতে যুক্তরাষ্ট্রও হতাশ হতে পারে। তারা সংকট সমাধানে সহায়তা করতে আগ্রহী নাও হতে পারে। তবে সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হলো ভারত-পাকিস্তান সংকটে উভয় দেশই পারমাণবিক অস্ত্রধারী। এই অস্ত্র বিপজ্জনক। উভয় পক্ষকে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকতে হবে। আক্রান্ত হলে পাকিস্তানও প্রতিশোধ নিতে পারে। রাঘবন আরও বলেন, এই ধারা আমরা অন্য যুদ্ধ বা উত্তেজনাগুলোতে দেখেছি। যেমন ইসরাইল-ইরানের মধ্যে হামলায়। মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, পুলওয়ামা সংকটের একটি শিক্ষা হতে পারে যে- প্রতিটি দেশকে পাল্টা প্রতিশোধ নেয়ার ক্ষেত্রে সীমিত শক্তি ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করা। যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত ছিলেন হুসেইন হাক্কানি। তিনি বিশ্বাস করেন, এবার উত্তেজনা বড় আকার ধারণ করতে পারে। ২০১৬ সালের মতো সীমিত ‘সার্জিক্যাল অপারেশনের’ কথা ভাবতে পারে ভারত। ভারত হয়তো ভাবতে পারে এমন হামলা চালালে পাকিস্তান জবাব দেবে না। তাতে ভারতের জনগণও খুশি হবে। বর্তমানে আনোয়ার গারগাশ ডিপ্লোম্যাটিক একাডেমি অ্যান্ড হাডসন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো হুসেইন হাক্কানি বলেন, কিন্তু এমন হামলা চালালে পাকিস্তানকেও প্রতিশোধ নিতে উদ্বুদ্ধ করা হবে। পাকিস্তান বলতে পারে, কোনো তদন্ত বা প্রমাণ ছাড়াই এই অভিযোগ দেয়া হচ্ছে তাদেরকে।

No comments