পঞ্চান্ন বছর আগের ‘ঝিনুক’ ঈদসংখ্যা by হোসাইন মোহাম্মদ জাকি
১২ নভেম্বর ১৯৭০ সালে সংঘটিত হওয়া বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাইক্লোনের ক্ষত তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি ভোলার আপামর জনতা। তাইতো পত্রিকার শুরুতেই ‘আমাদের কথা’ শিরোনামে পুরো পৃষ্ঠা নিয়ে লেখা ছিল, ‘যার কেউ নেই, কিছু নেই, আপনি কি পারেন না তার কেউ হতে, তাকে কিছু দিতে? সর্বহারাদের সাহায্যে আপনার সাধ্যানুযায়ী দান আরো দানের অংকের সাথে যোগ হয়ে বিরাট আকার ধারণ করতে পারে। আপনার বাহুল্য ব্যয় সাময়িকভাবে পরিহার করলে কিছু আসবে যাবে না, কিন' ঐ অর্থ দ্বারা অন্তত একজন দুর্গত মানুষের অশেষ উপকার হবে। আপনার দৈনন্দিন ব্যয়-বরাদ্দ থেকে কিছু হলেও বাঁচিয়ে তা দুস' মানবতার সেবায় নিয়োজিত করুন। দক্ষিণ বঙ্গের উপকূলবর্তী সহায়-সম্বলহীন মানুষের জন্য মুক্তহস্তে দান করুন।’
ঈদ সংখ্যাটিতে মোট ৩১টি সাদাকালো ও রঙিন বিজ্ঞাপন স'ান পেয়েছে। পূর্ণ, অর্ধ ও সিকি পৃষ্ঠা জুড়ে ছিল এসব বিজ্ঞাপন। তন্মধ্যে ছিল ‘মায়ার বাঁধন’, ‘বাংলার বধূ’, ‘বড় বউ’, ‘চৌধুরী বাড়ি’, ‘প্রিয়তমেষু’, ‘সামনের পৃথিবী’, ‘পলাশের রং’, ‘জল ছবি’, ‘কাঁচ কাটা হীরে’ ও ‘দীপ নেভে নাই’ চলচ্চিত্র এবং বেঙ্গল মোশান পিকচার্স স্টুডিওজ লিঃ-এর বিজ্ঞাপন। এসব বিজ্ঞাপন দেখে সিনেমা শিল্পের জনপ্রিয়তা তখন কতোটা তুঙ্গে ছিল, তা বেশ অনুমান করা যায়। পাশাপাশি অনুধাবন করা যায়, কতোটা সুন্দর ও রুচিশীল নামের ছায়াছবি নির্মিত হয়েছিল সত্তর দশকে। তবে ষাটের দশকেই রচিত হয়েছিল সুন্দর সত্তরের ভিত্তি। আশির দশকেও তা বিরাজ করেছে। সত্তর দশকের ছবি শিখিয়েছে পারিবারিক মূল্যবোধ, শ্রেণিবৈষম্য ও রাষ্ট্রীয় বাস্তবতা এবং সাহিত্যভিত্তিক ছবির গুরুত্বসহ আরও নানা দিক। ‘মায়ার বাঁধন’ এবং ‘বাংলার বধূ’ চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন শাবানা-উজ্জ্বল। ‘চৌধুরী বাড়ি’ ও ‘প্রিয়তমেষু’ চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠাংশে ছিলেন শাবানা-রাজ্জাক। এ ছাড়া রাজ্জাক-কবরী, ফারুক-কবরী, সুচন্দা-আজিম ছিলেন সেসময়ের বেশ জনপ্রিয় জুটি।
ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত পশ্চিম পাকিস্তান সংশ্লিষ্ট দু’টি বিজ্ঞাপন ছিল চোখে পড়ার মতো। একটি সেন্ট্রাল ডাইরেক্টরেট অব ন্যাশনাল সেভিংস ইসলামাবাদ কর্তৃক প্রচারিত ‘প্রাইজ বন্ডস’ এবং অপরটি কেন্দ্রীয় জাতীয় সঞ্চয় দপ্তর ইসলামাবাদ কর্তৃক প্রচারিত ‘ডিফেন্স সেভিংস সার্টিফিকেটস’। এ ছাড়া লালবাগ কেমিক্যাল এন্ড পারফিউমারী ওয়ার্কস-এর লক্ষ্মীবিলাস ভেষজ কেশ তৈল, এলিট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের এলিট পেইন্ট, ইস্টার্ন ফেডারেল ইউনিয়ন ইন্স্যুরেন্স কোং লিঃ, দি গ্রেট ইস্টার্ন ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং তিতাস গ্যাস-এর বিজ্ঞাপন ছিল উল্লেখযোগ্য। সাইক্লোন আক্রান্ত মানুষের জন্য পূর্ব পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন-এর বিজ্ঞাপনের ভাষা পূর্ণতা পায় এভাবে, ‘গগনবিদারী শোকের পাথার কাঁপায় নিখিল ধরা/ভাষাও আজিকে মৌন নীরব হৃদয় আকুল করা!’ এতো গেল বিজ্ঞাপনের আলাপ। এবার প্রচ্ছদ ও সূচিপত্র বিষয়ে পর্যালোচনা।
রূপ ও বাণীর প্রথম চিত্রার্ঘ্য ‘দীপ নেভে নাই’ ছবির নায়িকা কবরী ও নায়করাজ রাজ্জাককে নিয়ে ছিল ঈদসংখ্যার প্রচ্ছদ বিন্যাস। যা আমাদের অনেকের নিকট এখন অবিশ্বাস্য বলে মনে হবে। কারণ প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে আমাদের বিনোদনের ধারা বদলে গেছে। বিনোদন মাধ্যম বলতে আজ আমরা বুঝি ওটিটি, ইউটিউব, স্পটিফাইয়ের মতো স্ট্রিমিং প্ল্যাটফরম। টেলিভিশন চ্যানেলও বুঝি পুরনো হয়ে গেছে। অথচ বেশিদিন আগের কথা না, সিনেমা প্রচারের অন্যতম মাধ্যম ছিল রেডিও। ঘরে ঘরে তখনো টিভি এসে পৌঁছেনি। দুই ব্যান্ডের রেডিও ছিল কিছু মানুষের হাতে। কখনো বা সেথায় দুই বা ততোধিক শ্রোতাও থাকতো। সেই রেডিওর প্রধান আকর্ষণ ছিল মুক্তি আসন্ন সিনেমার প্রচারণা। শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে এই বিজ্ঞাপন শুনতো। বিজ্ঞাপনে কণ্ঠ দিয়ে নাজমুল হুসাইন এবং মাজহারুল ইসলাম নামের দু’জন তো একপ্রকার তারকা খ্যাতিই অর্জন করে ফেলেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের শিল্পী ছিলেন নাজমুল হুসাইন। হ্যাঁ ভাই, আসিতেছে... আসিতেছে... আগামী শুক্রবার ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে...। ঈদ মানেই ছিল তখন নতুন সিনেমা। টিকিট ব্ল্যাক হওয়া ছিল সাধারণ বিষয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরে ঈদ উপলক্ষে ‘দীপ নেভে নাই’ চলচ্চিত্রটি একযোগে শুভ মুক্তি পেয়েছিল ঢাকার বলাকা, মধুমিতা, স্টার, নিশাত, আনারকলি ও রাণীমহল, নারায়ণগঞ্জের গুলশান, চট্টগ্রামের আলমাস, খুলনার চিত্রালী ও পিকচার প্যালেস এবং বগুড়ার উত্তরায়। প্রযোজক ও পরিচালনায় ছিলেন ‘মিতা’ এবং সংগীতে ছিলেন ‘সত্য সাহা’। পরিণত বয়সীরা দল বেঁধে যেতেন সিনেমা হলগুলোতে। ঈদ উপলক্ষে রাতব্যাপী বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস'া হতো, যা খ্যাত ছিল ‘ফুল-সিরিয়াল’ হিসেবে।
সিনেমা হলে ছবি দেখা নিয়ে কি উন্মাদনাই না ছিল সেকালে! হলগুলোতে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি পেলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা ফলাও করে জানান দেয়া হতো। ২৮ মার্চ ১৯৬৫ সালে দৈনিক আজাদ-এর শিরোনাম ছিল, ‘মহানগরের টিকিট ক্রয়ের জন্য নজিরবিহীন ভিড়, জনতার উপর পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ১৪১ জন আহত’। রাষ্ট্রপ্রধান একে ফজলুল হক বন্ধু-বান্ধব নিয়ে নিয়মিত সিনেমা হলে গিয়ে মুভি দেখতেন। শুধু তাই নয়, দাপ্তরিক প্যাডে সেই মুভি (পুকার) সম্পর্কে তাঁর স্বতঃস্ফূর্ত মতামত প্রকাশ এবং প্রশংসা (২৬.০১.১৯৪০) করেছেন অকুণ্ঠ চিত্তে। সেসময় নারীদের বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল এই সিনেমা হল। এ বিষয়ে প্রয়াত কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন একান্ত সাক্ষাৎকারে জানান, “সিনেমা হলে তখন মেনে চলা হতো কঠোর পর্দা প্রথা। সিনেমা হল থেকে রাস্তা পর্যন্ত দুইদিকে কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। সিনেমা শুরু হওয়ার পর হল অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়ার পরেই কেবল পর্দা সরিয়ে ফেলা হতো। নারীদের জন্য আসন ব্যবস'া ছিল পুরুষদের থেকে একেবারেই পৃথক। বিরতির সময় ঝি’রা (গৃহকর্মী) হাতে করে নিয়ে আসতো শাহী শরবতের গ্লাস, ফল বা বেকারী সামগ্রী। যারা এসব পাঠাতো তারা নাম বলে দিতেন। ঝি চড়া গলায় বলতো, কেঠা রহিমন নেছা আছো, কেঠা ভুবনেশ্বরী দাশ... দেখা যেতো রহিমন নেছা শরবত যখন খেয়ে সেরেছে, তখন দেখা গেল আরও একজন ছিল ঐ নামের। শরবতের মালিক ছিল সে।” তরুণ-তরুণীদের হাঁটাচলা এমনকি পোশাকেও ছিল চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাদের প্রতিচ্ছবি। নায়ক জাফর ইকবাল আর রাজ্জাক স্টাইলের ডিভাইডার প্যান্ট আর চুলগুলো আঁচড়ে এক পাশ করে রাখা, নায়িকা ববিতার মতো প্যাঁচিয়ে শাড়ি পরা আর সুচন্দার মতো গালে তিল আঁকা-এসবই ছিল সেকালের সিনে সংস্কৃতির সামাজিক বাস্তবতা।
প্রযোজক-পরিচালক মুস্তাফিজ-এর সাক্ষাৎকারের জবাবে ‘আলোচনা প্রসঙ্গে’ শিরোনামে জহির রায়হানের একটি অমূ্ল্য নিবন্ধ সংযুক্ত হয়েছে সূচিপত্রের প্রারম্ভেই। এই নিবন্ধ সেকালের চলচ্চিত্র পরিচালকদের সম্পর্কে অনেক মূল্যবান ও অজানা তথ্য জানার সুযোগ করে দিয়েছে। জহির রায়হান লিখেছেন, “এদেশে চলচ্চিত্র শিল্পের জনক আব্দুল জব্বার খান নিজে একজন নাট্যকার। এদেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে, বিশেষ করে মঞ্চের সঙ্গে দীর্ঘদিন তিনি জড়িত ছিলেন। পরিচালক ফতেহ লোহানী, মহীউদ্দিন, সালাহউদ্দীন এঁরা উচ্চশিক্ষিত-প্রত্যেকের সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে একটি বিশেষ অবদান আছে। ফতেহ লোহানী ছবি পরিচালনার আগে সাহিত্যিক ও সাংবাদিক হিসেবে যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। পরিচালক মহীউদ্দিন দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা করেছেন এবং চলচ্চিত্রে যোগদানের আগে রেডিও পাকিস্তানের প্রোগ্রাম প্রোডিউসার হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরিচালক সালাহউদ্দীন বামপনি' রাজনৈতিক আন্দোলনে বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন এবং এদেশের নাট্যশিল্পের সঙ্গে তাঁর সক্রিয় যোগাযোগ ছিল। এদেশের চলচ্চিত্র-শিল্পের সূচনাতে উপরোল্লিখিত ব্যক্তিরা ছাড়া আরও দু’জন ব্যক্তি জড়িত ছিলেন। একজন খান আতাউর রহমান। দ্বিতীয়জন আমি। খান আতাউর রহমান চলচ্চিত্রে প্রবেশের আগে কবি, সমালোচক ও সংগীতজ্ঞ হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন। নিজের কথা বলবো না। শিক্ষিত রুচিবান সংস্কৃতিসেবীদের হাতে এদেশের চলচ্চিত্র-শিল্পের যখন সূচনা হয়, তখন দু’জন ঠিকাদার এসে এই শিল্পের অঙ্গনে প্রবেশ করেন। একজন মুস্তাফিজ, আর একজন তাঁর ভ্রাতা এহতেশাম। এঁদের শিক্ষা-দীক্ষা কিংবা ঐতিহ্য বলতে কিছুই ছিল না। এদেশে চলচ্চিত্র-শিল্পের যাত্রা শুরু হয়েছিল বুদ্ধিজীবীদের হাতে। তাঁদের চিন্তা ছিল ভালো ছবি তৈরি করা।...বুদ্ধিজীবী পরিচালকেরা যখন ভালো ছবি তৈরির প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন, তখন উল্লিখিত ভ্রাতৃদ্বয় সস্তা চটকদার ছবি বানিয়ে অর্থ উপার্জনের বাজার মাত করার চেষ্টা করেছিলেন এবং তাঁদের এই সস্তা চটকদার ছবিগুলোর সঙ্গে ভালো ছবিগুলোর ব্যবসায়িক পাল্লা দেয়া স্বাভাবিক কারণেই সম্ভবপর হলো না। পরিবেশকরা চটকদার ছবির নির্মাতাদের নিজের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি চরিতার্থের প্রয়োজনে দু’হাতে আলিঙ্গন করে কাছে টেনে নিলেন এবং ভালো ছবির নির্মাতাদের অবহেলার সঙ্গে দূরে ঠেলে দিলেন। এই দুই চটকদার ছবি নির্মাতার দাপটে ‘আসিয়া’র মতো ভালো ছবি বানিয়েও ফতেহ লোহানী বেকার হয়ে গেল। পরিচালক মহীউদ্দিন আর সালাহউদ্দীন জীবন সংগ্রামের কঠিন ধাক্কায় জর্জরিত হলেন। চলচ্চিত্র-শিল্পের সূচনাতে যদি এঁদের আবির্ভাব না হতো, তাহলে এদেশের চলচ্চিত্র-শিল্পের গতি অন্যরকম হতো। তাহলে ‘আসিয়া’র পরিচালক ফতেহ লোহানীকে ‘সাতরং’ ছবি বানাতে হতো না। ‘মাটির পাহাড়’ আর ‘শীত বিকেলের’ পরিচালক মহীউদ্দিনকে ‘গাজী কালু চম্পাবতী’ বানাতে হতো না। ‘যে নদী মরুপথে’, ‘সূর্যস্নান’ আর ‘ধারাপাত’-এর পরিচালক সালাহউদ্দীনকে ‘রূপবান’ বানাতে হতো না। ‘সুতরাং’ আর ‘আয়না অবশিষ্ট’-এর পরিচালক সুভাষ দত্তকে ‘পালাবদল’ বানাতে হতো না। ‘অনেক দিনের চেনা’ আর ‘নবাব সিরাজদ্দৌলা’র পরিচালক খান আতাউর রহমানকে ‘সাত ভাই চম্পা’ বানাতে হতো না। ‘কখনো আসেনি’ আর ‘কাঁচের দেয়ালে’র পরিচালককেও ‘বেহুলা’ বানাতে হতো না। পরিচালক মুস্তাফিজ ও এহতেশাম ভ্রাতৃদ্বয় শুধু যে এদেশে ভালো ছবি তৈরির পথ রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছিলেন, তাই নয়, একটার পর একটা চটকদার উর্দু ছবি নির্মাণ করে এদেশে বাংলা ছবির ভবিষ্যৎ ও অন্ধকারাচ্ছন্ন করে তুলেছিলেন...”।
সে আমলের প্রখ্যাত শিল্পী এবং চিত্র নায়ক-নায়িকাদের দুর্দান্ত সব ছবি স'ান করে নিয়েছে আলোচ্য সংখ্যাটিতে। ২৮৮ পৃষ্ঠার এই ঈদ সংখ্যায় চলচ্চিত্র গবেষক ও সাংবাদিকদের নানামুখী চিন্তার খোরাক রয়েছে। প্রতি সংখ্যাতেই ছিল ঝিনুক শব্দ প্রতিযোগিতার আয়োজন। সমাধান পাঠানোর শেষ তারিখ ধার্য করা থাকতো। শব্দ প্রতিযোগিতার জন্য সুনির্দিষ্ট নিয়ম ও শর্তের উল্লেখ করা হতো। সঠিক উত্তর প্রদানের জন্য আর্থিক পুরস্কারেরও ব্যবস'া ছিল। ‘সচিত্র চিত্র-কাহিনী’ শিরোনামে ‘দীপ নেভে নাই’ চলচ্চিত্রের কাহিনী সংক্ষেপ বর্ণনা করা হয়েছে। পাশাপাশি স'ান পেয়েছে কবরী, রাজ্জাক, রোজী, আনোয়ার হোসেন, মাস্টার ববি ও হাসমত-এর রঙিন ছবি। ববিতা, শাবানা, কবিতা ও শাহানা এই চারজনকে নিয়ে ‘আপন ভুবনে চার-কুমারী’ শিরোনামে একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। পঞ্চান্ন বছর আগের এই ছবিগুলো পাঠক-পাঠিকাদের নিঃসন্দেহে স্মৃতিকাতর করে তুলবে। এ ছাড়া সূচিপত্রের প্রথম অংশে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে- মেসবাহুল হকের একটি সম্পূর্ণ উপন্যাস ‘নটীর মৃত্যু’, সা’দত হাসান মান্টোর বড় গল্প ‘পুস্তকের সারমর্ম’ (অনুবাদ: আখতার-উন-নবী), বুলবুল আজাদের ছোটগল্প ‘অন্ধকার ঘরে’, কুমার শচীন দেববর্মণের ধারাবাহিক আত্মকথা: ‘আমার জীবনে আমি’, মিয়া মতীনের ব্যক্তিগত আলেখ্য (ধারাবাহিক): ‘ফেলে-আসা দিনগুলো’, চিত্র সমালোচনা, পশ্চিম পাকিস্তানের চিত্র সংবাদ।
সূচিপত্রের প্রথম অংশে শিল্পী পরিচিতি শিরোনামে জাফর ইকবাল ও লায়লা আর্জুমান্দ বানু সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু তথ্য রয়েছে। জাফর ইকবাল সম্পর্কে শিল্পী পরিচিতিতে ক্যাপশন হিসেবে লেখা হয়েছে, ‘নায়ক সমস্যার যুগে জাফর ইকবালের আগমন একটি চ্যালেঞ্জস্বরূপ। পর পর দুটো ছবি মুক্তি পাবার পর আজ তার হাতে অনেক ছবি। একে নিয়ে বিভিন্ন নায়িকার সঙ্গে জুটি বাঁধবার পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন পরিচালক-প্রযোজকরা।’ অসামান্য ও বিরল প্রতিভার অধিকারী সংগীতশিল্পী লায়লা আর্জুমান্দ বানু। ঝিনুক ঈদসংখ্যায় প্রকাশিত তাঁর ছবিটি বর্তমানে বেশ দুষ্প্রাপ্য। তাঁকে নিয়ে নানা তথ্যে সমৃদ্ধ এই নিবন্ধটি। পাঠক-পাঠিকাদের স্মৃতিরোমন'ন ও ভাবনার জাগরণে এর বিশেষ-বিশেষ অংশ হুবহু তুলে ধরা হলো:
“প্রায় একশ’ বছর আগেকার কথা। সৈয়দ গোলাম মুস্তাফা ছিলেন তাঁর দাদার বাবা অর্থাৎ পরদাদা। টপ্পা গানের প্রতি তাঁর সাংঘাতিক ঝোঁক ছিল। তখনকার যুগে গান-বাজনার যে খুব একটা প্রচলন ছিল, তা নয়। তবে বড় বড় জমিদারদের বাড়ীতে শুধু গানের জলসা বসতো। অবসর সময়ে গ্রামের মানুষ পল্লীগীতি গাইতো। সেইসব গানের কোনো ধরাবাঁধা সুর ছিল না। তখন থেকেই তাঁদের বাড়ীতে সঙ্গীতের প্রবেশ। তারপর ধীরে ধীরে এলো বাবার যুগ। সৈয়দ তৈফুর তাঁর বাবা। তিনি ছিলেন সাব-রেজিষ্ট্রার। এই সৈয়দ বংশেই জন্মগ্রহণ করেন লায়লা আর্জুমান্দ বানু। তাঁরা তিন বোন। বড় বোন লুলু বিলকিস বানু বর্তমানে লণ্ডনে রয়েছেন। তিনি কিছুদিন ভিকারুননেসা নূন স্কুলের প্রিন্সিপাল ছিলেন। ছোট বোন মালেকা পারভিন বানুও ভালো গায়িকা। আর তিনি মেঝো। বাবা সৈয়দ তৈফুর সাহেব চেয়েছিলেন তাঁর বড় মেয়ে লুলু বিলকিস বানু ভালো গায়িকা হোক। কিন' গানের দিকে ঝোঁক ছিল না তাঁর। ঝোঁক ছিল লায়লা আর্জুমান্দ বানুর প্রবল। তখন তাঁর বয়স মাত্র চার। রমণীমোহন ভট্টাচার্যের কাছে বড় বোন গান শেখেন। আর বসে বসে তন্ময় হয়ে শুনতেন তিনি।...শেষ পর্যন্ত রমণীমোহন বাবু তাঁকেই গান শেখাতে শুরু করলেন।
...তেইশ বছর একনাগাড়ে শিখেছেন ওস্তাদ গোলাম মুহম্মদের কাছে।...১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সনের এক সন্ধ্যায় তাঁর গান প্রথম এ দেশবাসী বেতারে শুনতে পায়। সে দিনটি ছিল ঢাকা বেতারের ‘খেলাঘর’-এর উদ্বোধনী দিবস।...নজরুলের আর একটি গানও সেদিন তিনি গেয়েছিলেন-‘নহে নহে প্রিয় এ নয় আঁখিজল।’...‘খেলাঘর’-এ যতদিন গেয়েছেন, ততদিন বেতার কর্তৃপক্ষ তাকে কোনো পারিশ্রমিক দেননি। তবে ১৯৪১ সনে বড়দের সাথে গান গাইবার সুযোগ যখন এলো, তখন তাঁকে পাঁচ টাকা করে পারিশ্রমিক দেয়া হতো।...তখন গানের প্রোডাকশনে জড়িত ছিলেন প্রভাত মুখার্জী ও নির্মল ভট্টাচার্যের মতো মানুষ। উৎপলা সেন, কল্যাণী মজুমদারের মতো মেয়েও তখন রেডিওতে গাইতেন। ১৯৪০ সালের কথা। ...নজরুল ইসলাম আর শচীন দেববর্মণ মিলে করলেন ‘পূর্বাণী’ বলে এক ‘মিউজিক্যাল স্কেচ’। সেই ‘পূর্বাণী’তে তিনি অংশগ্রহণ করেছিলেন।
...বাংলাদেশে তখন বিত্তশালী পরিবারে গ্রামোফোন ছিল চিত্তবিনোদনের প্রধান সহায়ক। কলের গানের চোঙার চারপাশে শহর-গ্রামের লোক ভিড় জমাতো। সে যুগ ছিল ‘আবু হোসেন আলীবাবার’ রেকর্ড নাটকের যুগ। সে যুগ ছিল আশ্চর্যময়ী, বিনোদিনী দাসী, আঙ্গুরবালা ও ইন্দুবালা এবং কে. মল্লিকের যুগ। সে যুগে যে-সমস্ত মেয়ে গান রেকর্ড করতেন, তাঁরা ছিলেন সমাজের বাইরে। সমাজ তাঁদের গান শুনতো, আনন্দ উপভোগ করতো। কিন' সমাজে কখনও তাঁরা আসন পাননি। মুসলমানরা তখনও এগিয়ে আসেনি রেকর্ড করতে। কে. মল্লিক কাসেম মল্লিক বলে কোনও রেকর্ড প্রথম দিকে করেননি বলে মুসলমান সমাজ তাঁকে মুসলমান বলে জানতেই পারেনি। যেমন তালাত মাহমুদকে তপন কুমার নাম নিয়ে রেকর্ড করতে হয়েছিল। কারণ, মুসলমান সমাজ তাদেরকে সমাজচ্যুত করতো। কিন' ১৯৩৪ সালের দিকে বাংলাদেশের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের মুসলমান মেয়ে কণ্ঠ দিয়েছিলেন গ্রামোফোন রেকর্ডে। মানিকগঞ্জ মহকুমার পারিল নওয়াধার মরহুম আলী আহমদ হামিদুল্লাহ সাহেবের কন্যা আশরাফী খানম। আমাদের অতি পরিচিত ও প্রখ্যাত সঙ্গীত-শিল্পী আফসারী খানমের বড় বোন। তারপর সুদীর্ঘ ৮ বছর আর কোনও বাঙালী মুসলমান মেয়ের রেকর্ড বের হয়নি। তাঁর নিজের কতোটি রেকর্ড আছে, এ প্রশ্নের জবাবে বললেন, খুব বেশি হলে ১৫ থেকে ২০টি রেকর্ড হবে। আজকের বায়তুল মোকাররমের পাশে যে ইসলামিক একাডেমী অবসি'ত, সেই ইসলামিক একাডেমী ছিল বিধবা আশ্রম। সেই বিধবা আশ্রমে একবার ‘এইচ. এম. ভি কোম্পানী’ উঠেছিলো। ১৯৪৬ সনের কথা। তখন চিন্ময় লাহিড়ীর পরিচালনায় তাঁর কয়েকটি গান রেকর্ড করা হয়েছিল। তারপর ১৯৪৮ সনে আবার যখন ‘এইচ. এম. ভি কোম্পানী’ এসেছিল, তখন কয়েকটি গান রেকর্ড করিয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৫ সনে লাহোরের ‘কিসমৎ’ ছবির প্লে-ব্যাক করেছিলেন তিনি। এটিই হচ্ছে তাঁর জীবনের প্রথম নেপথ্যে কণ্ঠদান। ...১৯৪৯ সনে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি. এ. পাস করেছেন আর ১৯৬০ সনে বিয়ে করেছেন তৎকালীন বেতারের আঞ্চলিক পরিচালক শামসুল হুদা চৌধুরীকে। ...১৯৫২ সনে তুরস্কে, ১৯৫৪ সনে আশুতোষ কলেজে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মেলনে, ১৯৫৫ সনে ম্যানিলায় অনুষ্ঠিত সাউথ-ইষ্ট এশিয়া রিজিওনাল কনফারেন্সে, এরপর ১৯৬০ সনে ইরানে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কো কনফারেন্সে, ১৯৬৩ সনে সোভিয়েট রাশিয়া, ১৯৬৬ সনে কাবুল, ইংল্যান্ড, ১৯৬৮ সনে ইরান প্রভৃতি দেশে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। ...তিনি বাংলা, উর্দু, পার্শি ও রাশিয়ান ভাষায় গান গাইতে পারেন।...”
সূচীপত্রের দ্বিতীয় অংশে বিশেষ রচনায় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে-‘আমার চোখে ফিল্ম-ইন্ডাস্ট্রি:এবার বলেছেন মশিহুর রহমান’, ‘অন্তরঙ্গ আলোকে:ফতেহ লোহানী’, ‘আমার প্রতিবিম্বে আমি: রেশমা’, ‘আমার কথা: সুচন্দা’ এবং ‘মুস্তাফার প্রেম’। নিয়মিত বিভাগ ছাড়াও ‘ইতিহাস কথা কও’ এবং ‘বিশ্ব বিচিত্রা’ শিরোনামে দুটি অধ্যায় সংযুক্ত হয়েছে আলোচ্য ঈদসংখ্যায়। পঞ্চান্ন বছর পর আসিরুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত ‘ঝিনুক’ ঈদসংখ্যাটি আপামর পাঠকের দৃষ্টিতে কিরূপে ধরা দিলো তার বিচার পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

No comments