মুরাদনগরে অপরাধের সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন মোহাম্মদ আলী

আওয়ামী লীগের ১৫ বছর সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজি, সংখ্যালঘুসহ অসহায় পরিবারের জমি দখল, স্কুল-মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রণ, হত্যা, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন গডফাদার মোহাম্মদ আলী।

আওয়ামী লীগের কোনো দলীয় পদ না থাকলেও আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক অর্থবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের শেল্টারে এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরতেন। অসংখ্য মানুষকে মামলা দিয়ে হয়রানি-নির্যাতন করেছেন। এলাকায় গড়ে তোলেন ক্যাডার বাহিনী। ১৫ বছর তার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে না পারলেও এখন বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন এলাকাবাসী। সাবেক সংসদ সদস্য ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত উপজেলা ২নং আকাবপুর ইউনিয়নের গ্রামের মোহাম্মদ আলী। তিনি পেশায় একজন বিতর্কিত কেমিক্যাল ব্যবসায়ী। চট্টগ্রামের পাহাড়তলীর ঝর্ণাপাড়া এলাকায় ব্যবসা করতেন। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর নিজ এলাকা মুরাদনগরের বাঙ্গরায় আস্তানা গাড়েন। নানা অপকর্ম করে একপর্যায়ে ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ঘনিষ্ঠজন হয়ে ওঠেন। উত্তর মুরাদনগরে গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। এতে আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয় গোটা উত্তর মুরাদনগর। ভয়ঙ্কর অপরাধে জড়িয়ে পড়েন মোহাম্মদ আলী তথা তার ক্যাডার বাহিনী। তার অত্যাচারের বর্ণনা দিতে গিয়ে এলাকার অনেক ভুক্তভোগী কান্নায় বুক ভাসান। কেউ কেউ আল্লাহ্‌র দরবারে বিচার চান। এমপি’র ক্ষমতাবলে আকাবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি এবং আকাবপুর ইয়াকুব আলী ভূঁইয়া দাখিল মাদ্রাসার সভাপতির পদ বাগিয়ে নেন।

মুখ খুললেই মামলা দিয়ে হয়রানি:
মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করা ছিল তার প্রধান হাতিয়ার। তার অপকর্ম নিয়ে কেউ মুখ খুললেই দেয়া হতো মিথ্যা মামলা। এলাকার নিরীহ মানুষের বিরুদ্ধে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম এবং ঢাকায় ২২টি মামলা দিয়েছেন তিনি। পুলিশ জানায়, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র হত্যা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, নাশকতা, ভূমিদখল, চেক জালিয়াতিসহ বহু মামলার আসামি মোহাম্মদ আলী। সমপ্রতি তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।

নির্যাতন-জমিদখল ছিল নেশা: উপজেলার আকাবপুর এলাকার বাসিন্দা সুধীর চন্দ্র বণিক বলেন, প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি, জোর করে জমিদখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হামলা-নির্যাতন করা ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক কাজ। সে জোরপূর্বক আমার ৬ শতাংশ জমি দখল করে নিয়েছে। আমাকে ও আমার পরিবারকে অনেক নির্যাতন করেছে।

একই এলাকার দেবু মালাকার বলেন, আমি স্বপন মালাকারের কাছে ৩৯ শতাংশ জায়গা বিক্রি করেছি। কিন্তু আমার স্বাক্ষর জাল-জালিয়াতি করে মোহাম্মদ আলী ওই জায়গা দখল করে নিয়েছে। ক্ষমতার বলে তার নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করেছে। পাঁচ বছর ধরে জায়গাটি তার দখলে আছে। তার অত্যাচারে ১৫ বছর আমাদের এলাকার সংখ্যালঘুরা ছিল অতিষ্ঠ।

একই এলাকার প্রদীপ কুমার সূত্রধর বলেন, মোহাম্মদ আলী তার সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে আমার বাড়ি দখল করেছে। আমার স্ত্রী-মাসহ পরিবারের সবাইকে একাধিকবার মারধর-নির্যাতন করে আমাকে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করেছে।

ত্রাসের রাজত্ব কায়েম:
এলাকার দেলোয়ার হোসেন বলেন, মোহাম্মদ আলী সাবেক এমপি ইউসুফ আব্দুল্লাহ হারুনের ঘনিষ্ঠজন ছিল। ওই এমপি’র ছত্রছায়ায় সে এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে রেখেছিল। আমাকে এবং আমার ভাইকে মামলা দিয়ে হয়রানি ও নির্যাতন করেছে। এলাকার মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম ও মাসুদুল ইসলাম বলেন, মামলার ভয় দেখিয়ে আমাদের দুই ভাইয়ের কাছ থেকে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা চাঁদা নিয়েছে। শুধু আমরা নই, এলাকার অসংখ্য মানুষ জিম্মি হয়ে তাকে চাঁদা দিয়েছে। কিন্তু ভয়ে কেউ মুখ খুলছে না। আমাদের বাজারের ৫ শতাংশ জায়গা এবং ৪টি দোকান দখল করে নিয়েছে। আমার মা, বোন এবং স্ত্রীকে মারধর করেছে। ১৫ বছর ধরে আমাদের এসব সম্পদ এই সন্ত্রাসী দখল করে রেখেছে। চাঁদা নেয়ার পরও ১০টি মামলা দিয়ে আমাদের হয়রানি করেছে। আমরা তার সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি। বাঙ্গরা বাজার থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, সন্ত্রাসী মোহাম্মদ আলী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে একাধিক ছাত্র হত্যায় জড়িত। একটি মামলায় বর্তমানে সে দুইদিনের রিমান্ডে আছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আরও কোন কোন ঘটনায় জড়িত রয়েছে সে বিষয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার বিরুদ্ধে বাঙ্গরা বাজার থানাসহ বিভিন্ন থানায় ৮-৯টি মামলা রয়েছে। তার বিরুদ্ধে এলাকায় বহু অপকর্মের অভিযোগ শোনা যাচ্ছে। ভুক্তভোগীরা মামলা কিংবা অভিযোগ দিলে তার প্রতিটি অপরাধ খতিয়ে দেখা হবে এবং যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।

mzamin

No comments

Powered by Blogger.