টেনশন বাড়ছে by সাজেদুল হক
ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কীভাবে দায়িত্ব নিয়েছে তা সবারই জানা। ছয় মাসে সরকারকে নানা চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে হয়েছে। সমালোচনাও কম হয়নি। তবে আওয়ামী লীগ ছাড়া সব শক্তিরই একধরনের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে এসেছে সরকার। এ দৃশ্যপটে কি বড় কোনো পরিবর্তন হতে চলেছে?
খুব সম্ভবত নতুন একটি পর্বে প্রবেশ করতে যাচ্ছে রাজনীতি। ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রদের দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে চলছে। এ দলের প্রধান কে হবেন তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্ট এক ছাত্রনেতা জানিয়েছেন, মূলত চার ক্যাটাগরি থেকে সমন্বয় করে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নাগরিক কমিটি, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের সমন্বয়ে এ কমিটি গঠিত হবে। উপদেষ্টা পরিষদে থাকা ছাত্রনেতারা নবগঠিত দলে যোগ দেয়ার আগে সরকার থেকে পদত্যাগ করবেন। সবার আগে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম পদত্যাগ করতে পারেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। অন্য দুই উপদেষ্টা আরও কিছুটা সময় নিয়ে পদত্যাগ করবেন। ২০শে ফেব্রুয়ারি কিংবা তারপর এই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ ঘটতে পারে। ছাত্রদের নতুন দলের বিষয়টি এরইমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসও নিশ্চিত করেছেন। বৃটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দল গঠনের প্রক্রিয়ার মধ্যে হয়তো তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। এটাও একটা বিপদ। কারণ, রাজনীতি শুরু করলে সব ধরনের রাজনীতিবিদ তাদের সঙ্গে মিশে যাবে। তাই আমরা জানি না তারা আমাদের দেশে যে রাজনীতি, তা থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে কি-না। তবে ছাত্ররা প্রস্তুত। তারা প্রচারণা চালাচ্ছে। তারা দেশ জুড়ে লোকজনকে সংগঠিত করছে।’
ছাত্রদের নতুন দলের এই উদ্যোগ এরইমধ্যে বিএনপি’র সঙ্গে তাদের একধরনের দূরত্ব তৈরি করেছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি সাক্ষাৎকার নিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের তীব্র প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছি। এ বাহাস আগামীদিনে আরও বাড়তে পারে। এটিই রাজনীতির রীতি। কারণ লড়াইটা মূলত ক্ষমতার। বিএনপি’র পক্ষ থেকে এরইমধ্যে সম্ভাব্য নতুন দলের প্রতি রাষ্ট্রীয় কোনো ইন্ধন থাকে কি-না সে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। তবে নাহিদ ইসলাম ওয়ান-ইলেভেনের উল্লেখ করে যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন ঢাকার একজন পরিচিত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী তা নাকচ করেননি।
দৃশ্যত জামায়াত নতুন দলের বিরোধিতা করছে না। বলাবলি আছে, নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের প্রতি জামায়াত-শিবিরের সমর্থন রয়েছে। তবে যদি কখনো এমনটা ঘটে, নতুন দলের সঙ্গে বিএনপি’র নির্বাচনী ঐক্য হয়ে গেল সেক্ষেত্রে জামায়াত আরও একা হয়ে যাবে। রাজনীতিতে বিস্ময়কর কতো ঘটনাই তো ঘটে! উপদেষ্টা আসিফ নজরুল কিন্তু বিএনপি’র সঙ্গে ছাত্রদের বৃহত্তর নির্বাচনী সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করেন নি।
আওয়ামী লীগ এরইমধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে বেশ কিছু কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। এরমধ্যে হরতাল-অবরোধের মতো কঠোর কর্মসূচিও রয়েছে। যদিও দলটির নেতারা হয় পলাতক নয়তো বা কারাবন্দি। মূলত পলাতক নেতারাই কর্মসূচির পক্ষে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারণা চালাচ্ছেন। বিবিসি বাংলার রিপোর্ট বলছে, দেশে থাকা তৃণমূল নেতাকর্মীরা এসব কর্মসূচিতে উষ্মা প্রকাশ করেছেন। তাদের কারও কারও ধারণা এতে তৃণমূলের নেতাকর্মীদের বিপদ আরও বাড়বে। দেখার বিষয় আওয়ামী লীগ মাঠে নামতে পারে কি-না। যদিও সরকার যে, এ ব্যাপারে হার্ডলাইনে থাকবে তা সাফ জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পুলিশও কঠোর অবস্থান ব্যক্ত করেছে।
ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি’র আন্দোলনে নামার সম্ভাবনা পুরো বিষয়টিতে কৌতূহল তৈরি করেছে। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ইতিমধ্যে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদও এক বক্তব্যে আন্দোলনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে একাধিক সূত্র বলছে, বিএনপি পুরো বিষয়টি সতর্কভাবে হ্যান্ডেল করতে চায়। বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কোনো বিলম্ব চায় না। যদিও সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সূত্র বলছে, চলতি বছর ডিসেম্বর কিংবা পরের বছর জানুয়ারিতে নির্বাচন হতে পারে। বিএনপি কোনোভাবেই এরপর আর যেতে চায় না। দলটি সম্ভব হলে এর আগেই নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। ছাত্র নেতৃত্বাধীন দল নিয়েও বিএনপি’র মধ্যে একধরনের সংশয় রয়েছে। এ দল কতোটা রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখছেন বিএনপি’র নীতিনির্ধারকরা। বিএনপি নেতৃত্ব বিশ্বাস করে অবাধ নির্বাচন হলে তারা বড় জয় পাবেন। এক্ষেত্রে বিরোধী দল কারা হবে সেদিকেও তাদের দৃষ্টি রয়েছে।
জামায়াত ৫ই আগস্টের পর অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। কিন্তু দলটি ভোটের রাজনীতিতে কতোটা প্রভাব রাখতে পারবে তা আদৌ নিশ্চিত নয়। তাছাড়া, জামায়াতের সংশ্লিষ্ট অনেকেই মনে করেন, বিএনপি তাদের বিরোধী দল হিসেবে চায় না। একাত্তর প্রশ্নে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করা নিয়েও জামায়াতে আলোচনা চলছে। দু’টি আইনি ইস্যুর সুরাহার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজনৈতিক ভূমিকার জন্য জামায়াত দুঃখপ্রকাশ করতে পারে।
বাংলাদেশের রাজনীতির একধরনের চিত্র পাওয়া যায় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের মিয়ানমার ও বাংলাদেশ-বিষয়ক সিনিয়র কনসালট্যান্ট থমাস কিয়ান-এর মন্তব্যে। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মধুচন্দ্রিমা এখন পুরোপুরি শেষ। রাজনৈতিক দলগুলো এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দরকষাকষি করায় এবং নির্বাচনী সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় এই বছর রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো বাড়তে পারে। জিনিসপত্রের ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির কারণেও সরকার চাপের মধ্যে রয়েছে যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অব্যবস্থাপনার উত্তরাধিকার হিসেবে তারা পেয়েছে। আর অর্থনীতিকে আবার সঠিক পথে ফিরিয়ে আনার চলমান প্রচেষ্টার সুফল বাংলাদেশের জনগণের বাস্তবে পেতে আরও সময় লাগবে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্কে এখনো টানাপড়েন রয়েছে আর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারে ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা খুব কম। এরপরও আগামী বছর বাংলাদেশের সামনে দেশটির জাতীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থা পুনর্গঠন এবং এটিকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও জবাবদিহিমূলক করার একটি বিরল সুযোগ রয়েছে।’
শেষ কথা: সব মিলিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমশ জটিল হচ্ছে। হাসিনাবিরোধী শক্তিগুলোর মধ্যে দূরত্ব ও ফাটল বাড়ছে। চিরচেনা শত্রু-মিত্র’র সমীকরণও সম্ভবত পাল্টে যাচ্ছে। পাকিস্তানে কী হয়েছিল? ইমরানের বিরুদ্ধে পুরনো শত্রুরা কি এক হয়নি। বাংলাদেশের হিসাব অবশ্য আলাদা। একটি রক্তাক্ত অধ্যায় এখানে অতিক্রম করতে হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে শেষ কথা বলতে তো কিছু নেই।

No comments