ধানমন্ডি ৩২ নম্বর: বই, রড, লোহা যে যা পাচ্ছেন নিয়ে যাচ্ছেন
আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১০টার দিকে এমন চিত্র দেখা গেছে। এ সময় ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভাঙা হচ্ছিল। বেলা ১১টা পর্যন্ত বাড়িটির অনেক অংশই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, পেছনের ওই ছয়তলা ভবনে শত শত মানুষ ঢুকছেন। কেউ কেউ ভেতর থেকে জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে আসছেন। আর ভবনটির ভেতর থেকে হাতুড়ির আঘাতে নানা কিছু ভাঙার শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ওই ভবন থেকে যেসব জিনিস নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এর মধ্যে বেশির ভাগই শেখ মুজিব ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নিয়ে লেখা কিংবা পরিবারের সদস্যদের লেখা বই রয়েছে। কেউ এসব বইয়ের কার্টন নিয়ে বের হচ্ছিলেন, কারও কারও হাতে ছিল কয়েকটি করে বই।
এসব বইয়ের মধ্যে রয়েছে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইন্টেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভলিউম-৩’, ‘জনসমুদ্রে এক মহামানব’, ‘জাতির জনক ও শেখ রাসেল’ ইত্যাদি।
ভেতর থেকে ভাঙারি পণ্য হিসেবে বিক্রয় করা যাবে—এমন স্টিল, লোহা ও কাঠের নানা কাঠামো ভেঙে যে যাঁর মতো নিয়ে যাচ্ছেন অনেকে। স্টিল ও লোহার কাঠামো ভবন থেকে ভেঙে ভেঙে কয়েকজনকে নিচে ফেলতে দেখা যায়। নিচে থাকা কয়েকজন এগুলো রিকশায় করে অন্যত্র সরিয়ে নেন। যাঁরা এসব লোহালক্কড় নিচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিম্ন আয়ের মানুষ।
আল আমিন নামের এক ব্যক্তি লোহার কিছু কাঠামো নিচ্ছিলেন। এসব নিয়ে কী করবেন, তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ভাই, বিক্রি করে দিমু। সেই টাকায় ভালোমন্দ খামু। মুরগি পাইলে মুরগি, গরু মাংস পাইলে গরু মাংস কিনে খামু। এই ছাড়া আর কিছুই না।’
ভাঙা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে এক ব্যক্তি বলেন, ‘এই মহিলা নিজের জিদ দিয়ে দলটাকে একেবারে শেষ কইরা দিয়া গেল।’
সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটির সামনে মানুষের ভিড় দেখা গেছে। শত শত মানুষ ওই বাড়ির সামনে আসছিলেন। ভিডিও করছিলেন। ছবি তুলছিলেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকেও একটি এক্সকাভেটর দিয়ে বাড়িটি ভাঙার কাজ হচ্ছিল। তবে মাঝে ঘণ্টাখানেক সময় ভাঙার কাজ সাময়িক বন্ধ ছিল।
ভারতে পালিয়ে যাওয়া স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচারের ঘোষণাকে কেন্দ্র করে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা গতকাল বুধবার রাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ব্যাপক বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।
৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙা ছাড়াও গতকাল রাতে ধানমন্ডির ৫/এ-তে অবস্থিত শেখ হাসিনার বাড়ি সুধা সদনেও আগুন দেওয়া হয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট স্বৈরতান্ত্রিক আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। অভ্যুত্থানের ছয় মাস ছিল গতকাল। এদিন রাত ৯টায় নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ফেসবুক পেজে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রচার করা হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। এ ঘোষণাকে কেন্দ্র করে গতকাল দিনভরই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উত্তেজনা চলে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেক ছাত্র-জনতা ও অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট ফেসবুকে ধানমন্ডি ৩২ অভিমুখে ‘বুলডোজার মিছিল’ এবং ‘মার্চ টু ধানমন্ডি ৩২’ কর্মসূচির ডাক দেন।
গতকাল রাত আটটার দিকে বিক্ষোভকারীরা শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ির ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেন। তাঁরা বাড়ির সামনে শেখ মুজিবুর রহমানের ম্যুরালও ভাঙচুর করেন। এর পর থেকেই সেখানে ভাঙচুর চলছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত ৫ আগস্ট ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছিলেন বিক্ষুব্ধ জনতা। এর পর থেকে বাড়িটি অনেকটা পরিত্যক্ত অবস্থায় ছিল।
সুধা সদনে আগুন জ্বলছে, ‘নিরাপত্তার কারণে’ নেভাতে যায়নি ফায়ার সার্ভিস
ধানমন্ডি–৫ এর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন সুধা সদনে আজ বৃহস্পতিবার সকালেও আগুন জ্বলছে। ‘নিরাপত্তা না থাকায়’ সেই আগুন নেভাতে যায়নি ফায়ার সার্ভিস। আজ সকালে ভবনটি থেকে যে যেভাবে পারছেন, সেখানে থাকা জিনিসপত্র নিয়ে যাচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো সদস্যও সেখানে নেই।
গতকাল বুধবার রাত সাড়ে ১০টার পর সেখানে আগুন দেওয়া হয় বলে কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন। ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের পর এ আগুন দেওয়া হয়।
ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক (ঢাকা) মো. ছালেহ উদ্দিন আজ সকালে প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওখানে (সুধা সদন) যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। তাই ওখানে যাওয়া হয়নি।’
আজ সকালে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা কন্ট্রোল রুমের মবিলাইজিং অফিসার খালেদা ইয়াসমিন বলেন, ‘রাত সাড়ে ১১টার দিকে সুধা সদনে আগুনের খবর পাই আমরা। আমাদের নিরাপত্তা ছিল না। তাই সুধা সদনে আগুন নেভাতে যাওয়া সম্ভব হয়নি।’
আজ সকাল পৌনে ১১টার দিকে সুধা সদনে গিয়ে এই প্রতিবেদক দেখেন, ভবনের দোতলায় আগুন জ্বলছে। বাড়িটির সামনে পড়ে আছে ফ্রিজ, খাট, ওয়ার্ডরোব, সোফাসহ নানা সামগ্রী। নিচতলা থেকে চারতলার বিভিন্ন কক্ষে গিয়ে আগুন ও ভাঙচুরের চিহ্ন দেখা গেছে। কোথাও কোথাও টাইলস খুলে ফেলা হয়েছে। পোড়া গন্ধ চারদিকে।
সুধা সদনের নিচতলার কক্ষের সব পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তোশক, লেপ এসব আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কাচের টুকরা পড়ে আছে অনেক স্থানে। বিভিন্ন তলার জানালার কাচগুলো পড়ে যাচ্ছে। বাড়িটির বিভিন্ন স্থানে বই পড়ে আছে। অনেক বই পুড়ে গেছে।
বাড়িটির সামনে এখন উৎসুক কয়েক শ মানুষের ভিড়।
তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ যেসব অক্ষত জিনিসপত্র আছে, সেগুলো নিয়ে যাচ্ছেন।
বেলা ১১টার পরও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাউকে দেখা যায়নি।
ওই এলাকায় দায়িত্বরত ধানমন্ডি সোসাইটির নিরাপত্তারক্ষীরা জানান, ‘রাত সাড়ে ১০টার পর ১০ থেকে ১২টি ছেলে এসে সুধা সদনে আগুন দেয়। আগুন ভবনটিতে ছড়িয়ে পড়লে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের লোকেরা এসে এসব সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেন। পরে আশপাশের ভবনের বাসিন্দারা এসে পানি দিয়ে নিচতলার আগুন কিছুটা কমিয়েছেন।’
দিবাগত রাত ১২টার সময় ভবনের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ তলার বিভিন্ন কক্ষে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পালিয়ে ভারতে অবস্থান নেওয়া শেখ হাসিনা গতকাল রাতে নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ভাষণ দেন। একে কেন্দ্র করে বিকেলে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িটি গুঁড়িয়ে দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে ফেসবুকে একাধিক পোস্ট দেন ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য শরিফ ওসমান হাদি। পরে সন্ধ্যায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ এক ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘আজ রাতে বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদের তীর্থভূমিমুক্ত হবে।’
এরপর রাত ৮টার দিকে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। একপর্যায়ে তাঁরা বাড়িটির ফটক ভেঙে ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর শুরু করেন। পরে ওই ভবনে আগুন দেওয়া হয়। রাত ১২টার দিকে এক্সকাভেটর ও ক্রেন দিয়ে ভবনটি ভাঙা শুরু হয়।
![]() |
| গতকাল রাত ১১টার দিকে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে একটি ক্রেন নিয়ে আসেন বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা। পরে আনা হয় একটি এক্সকাভেটর। মধ্যরাতে এই ভারী যন্ত্র দিয়ে ভবন ভাঙা শুরু হয়। রাত দুইটা নাগাদ বাড়িটির বড় অংশ ভাঙা শেষ হয়। ভবন ভাঙার কাজ চলার মধ্যে বিপুলসংখ্যক বিক্ষোভকারী স্বৈরাচার, ফ্যাসিবাদ, মুজিববাদ ও আওয়ামী লীগবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছিলেন। রাতভর ভবন ভাঙার কাজ চলে। আজ ফজরের নামাজের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে যান। ভবনের বড় অংশ ভাঙা হয়ে গেছে দেখে মানুষ উল্লাস করেন। সকাল থেকে দেখা যায়, ভারী যন্ত্র দিয়ে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর ভবনটি ভাঙা হচ্ছে। তখনো বাড়ির সামনে মানুষের ভিড় দেখা যায়। আজ বেলা ১১টার দিকে দেখা যায়, বাড়িটির অনেক অংশই গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। |

No comments