পুনরায় হৃদয়ং by রাজর্ষি দাশ ভৌমিক
দ্বিতীয়বার
বিবাহ করে সুদেব ভাবলো এইবার সংসারী হবে। প্রথম বউয়ের সবকিছু একদম ভুলে
গেছে সে। আসলে যতদিন না ভুলতে পারছে ততদিন দ্বিতীয় বিয়ে করবে না বলেই ঠিক
করেছিল। ততদিন যথেচ্ছ মদ খাবে, রোববার বেলা অবধি ঘুমোবে, এক জামাকাপড় পরে
দিনের পর দিন অফিস করবে, বন্ধুদের সোম-শুক্র যেদিন খুশি নেমন্তন্ন করে
খাওয়াবে আর মধ্যরাতে ইংরেজি টিভি চ্যানেল তারস্বরে চালিয়ে তারিয়ে তারিয়ে
দেখবে। এই জীবন সুদেব কয়েকবছর যাপন করার পর পেটে আলসার ধরা পড়লো। মধ্যরাতে
প্রবল পেট ব্যথা। জল গড়িয়ে দেওয়ার কেউ নেই। মায়ের ফটোর দিকে তাকাতে গিয়ে
চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। বউকে ডিভোর্স দেওয়াটা কি বেজায় ভুল হয়েছে ভাবতে গিয়ে
প্রথম বউয়ের নাম আর মনে পড়লো না। সুদেব এইভাবে ভুলে গেল প্রথম বউয়ের কথা।
আলসারের অপারেশনের ধাক্কাটা সামলে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে প্রথম বিয়ে নিয়ে
ভাবলো। মনে হল, সে একা ছাদনাতলায় যাচ্ছে, একা হনিমুনে, একা খেলা করে উঠে
একঢোক জল খেয়ে একা ঘুমিয়ে পড়ছে। বিয়ে, প্রেম, ঝগড়া, ইস্যু এবং ডিভোর্স আর
সর্বোপরি জ্বলজ্যান্ত একটা মেয়ে ঝাপসা হয়ে গেছে।
বিয়েটা কেনো টিকলো না ভাবার চেষ্টা করলে সুদেব আর মেয়েটির কোনো দোষ দেখতে পায় না। মেয়েটিই যেখানে ঝাপসা হয়ে গেছে, সেখানে মেয়েটির আর কী দোষই বা স্পষ্ট থাকবে। সুদেব বরং নিজের দোষ দেখতে পায়। প্রচুর দোষ, অসংখ্য দোষ। গুছিয়ে সংসার করার বয়সে সে সংসারে প্রবেশ করেনি। অল্পবয়সে বিয়েটা করেছিল। কলেজের লাস্ট ইয়ারে। আর গুছিয়ে সংসার করার বয়সে পৌঁছে অগোছালোভাবটা তার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়েছে। সুদেব তাই এবার সাতটায় উঠে বাজারে যাবে, দরকারি কোনো জিনিস কিনতে ভুল করবে না, সংসারের মানুষদের প্রয়োজন মেটাবে, বছরে একবার পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়াও যেতে পারে। আলসারের অপারেশনের পর এমনিতেই মদ খাওয়া কমে গেছে, সপ্তাহে দু’একদিন, এক-দু পেগ, তাও পুরনো বন্ধুদের চাপে। সুদেবের স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে—এনুয়াল পরীক্ষায় মাঝারি ফল করার পর প্রতিবার প্রতিজ্ঞা করতো নতুন ক্লাসে ভালোভাবে পড়াশুনা করবে। মধ্যমেধার ছাত্র সে, মধ্যমেধাকে অজুহাত বানিয়ে ইস্কুলের অসাফল্যগুলোকে সান্ত্বনা দেয়। সংসারে তার অক্ষমতাগুলো স্পষ্ট, সেগুলো ঝেড়ে ফেলাও কঠিন নয়, সুদেব ভাবে দ্বিতীয়বার বিবাহ করে এবার সংসারী হবে।
প্রথমবার বিয়ের থেকে সুদেব ও সেই মেয়েটির কোনো ছেলেপুলে হয়নি। সুদেবের দ্বিতীয় বউয়ের প্রথম পক্ষ থেকে একটি মেয়ে ছিলই। বন্ধুদের আসরে সুদেবের সঙ্গে দ্বিতীয় বউয়ের প্রথম পরিচয় হয়। তখনও সুদেবের প্রথম ডিভোর্সটি হয়নি। দুজনের সম্পর্কটা কেবলমাত্র পরিচিতির স্তরেই ছিল। দ্বিতীয় বউয়ের ততদিনে প্রথম ডিভোর্সটি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সুদেব তাই আর বেশি ছোঁকছোঁক করেনি, উদ্দেশ্য যখন সংসারী হওয়া তখন আর প্রেমে মজে বৃথা সময় নষ্ট করা কেনো!
দ্বিতীয় বউটি ভালোই, নিঃসন্দেহে। বিয়াল্লিশ বছরের মদ্যপ, চাকুরিজীবীকে বিবাহ করার মানসিকতা নিয়েই সে সুদেবের বাগুইহাটির ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। বিয়ে হল অনাড়ম্বরভাবে। এ জীবনে, সুদেব হাঁপ ছেড়ে ভাবলো, দু’দুটি বিবাহের পিছনে লোক খাইয়ে তাকে আর পয়সা নষ্ট করতে হল না। গেজেটেড অফিসার বাপ প্রথম বিয়েটি টাকা পয়সা উড়িয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিয়েতে, সইসাবুদের পর বন্ধুদের আপবিট বেঙ্গলি ফিউশন রেস্তোরাঁতে বাফে খাইয়ে দেওয়া হল, বিল হল হাজার আঠারো—এবাদে বউ আর মেয়ের ট্যাক্সিভাড়া বাবদ আরো হাজার। দ্বিতীয় বউ যখন সুদেবের ফ্ল্যাটে ঢুকছে তার ডানহাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়ে। সুদেব স্যুটকেশ নামিয়ে ফ্ল্যাটের তালাচাবি খুললো। পাশের ফ্ল্যাটের মজুমদাররা এসে বউ দেখে গেলেন। মজুমদার গিন্নি একটা হালকা নথ উপহার দিলেন। রাত্রি দশটার দিকে বন্ধুবান্ধব গানবাজনা করে বিদায় নিলে, মেয়েও ঘুমের অজুহাতে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। দ্বিতীয় বউ যেন মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারলো না। সুদেব দ্বিতীয়বারের জন্য ফুলশয্যায় প্রবেশ করলো। দ্বিতীয় বউয়ের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। সে প্রথমবার লক্ষ্য করল তার দ্বিতীয় স্বামীর বুকময় সাদা চুল। পরদিন সকালে উঠে বাজার নামিয়েই সুদেব ছুটলো ফার্নিচারের দোকানে মেয়ের জন্য একখানি সস্তার সিঙ্গল খাট কিনতে, নিদেনপক্ষে একটি ক্যাম্পখাট। এইভাবে সুদেব তার দ্বিতীয় সংসার শুরু করলো।
দ্বিতীয় বউ এককালে চাকুরি করতো, মেয়ে জন্মানোর পর ছেড়ে দেয়। ডিভোর্সের পর মায়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করে। চাকরিতে আর ফেরা হয়নি, মৃত বাবার পেনশন, অল্প সঞ্চয় আর খোরপোশে মেয়েকে পড়াচ্ছিলো, নিজেকে সামলাচ্ছিলো। ডিভোর্সের পর দু’একবার পুরুষের প্রেমাসিক্ত হতে হতেও নিজেকে সামলেছে। পরনির্ভরশীল একট ডিভোর্সি মেয়েকে ফুঁসলে নেওয়ার মতো দুর্জনের অভাব কলকাতা শহরে নেই। অতপর সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, মেয়ের পড়াশোনায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। ময়লা ঝেড়ে ফের হারমোনিয়ামে রেওয়াজ শুরু করেছে, মাঝেমধ্যে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে ও মেয়েকে কোলে নিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দে মেতে উঠেছে। মা চাকরির কথা তুললে, ওসব ভুলে গেছি বলে দায় ঠেলেছে। মায়ের শরীর ভাঙতে শুরু করার পর, মা ‘ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যেই করেন’ এই দিকটা বুঝতে পেরেছেন। সংসারে তাকে দেখার বলতে একমাত্র এই ডিভোর্সি মেয়ে। সুদেবের দ্বিতীয় বউটি কিন্তু বিবাহিত সুদেবের দিকে একবারটির জন্যও হাত বাড়ায়নি, বন্ধুদের গ্রুপের অনেককে নিয়ে রাতজাগা-চিন্তায় রমণ করলেও সুদেব ছাড় পেয়েছিল। নিতান্ত সাধারন, নিতান্ত মদ্যপ, নিতান্ত চাকুরিজীবি সুদেব। আর সেকারণেই ডিভোর্সি সুদেবকে ভারি নির্ঝঞ্ঝাট মনে হল। এতগুলো বছর একা থাকার পর একটি পুরুষের জীবনে ফের জায়গা নেওয়ার মতো যথেষ্ট মনের জোর অবশিষ্ট ছিল না। পুরুষের দাবিগুলো কতটা মেটাতে সে সক্ষম হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল এবং তার মেয়ের জীবনেও জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম পুরুষের উপস্থিতি, সেই শঙ্কা! সুদেবের দ্বিতীয় বউ মায়ের পরামর্শ নিয়ে, মায়ের জন্য একটি আয়ার ব্যাবস্থা করে, বিয়েতে সম্মতি দিল।
দু’জনের দ্বিতীয় সংসারটিই দু’জনের জন্য অনেকটা বিস্ময়ের ও স্বস্তির হল। সুদেব কয়েকদিন সংসার করেই বুঝলো এইবার তার সংসারী হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে কিন্তু অপরপক্ষের সুদেবের কাছে সংসারী হওয়ার জন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। আর দ্বিতীয় বউটি দেখল—পুরুষের দাবিদাওয়া নিয়ে তার মনে যতই শঙ্কা থাক, সুদেবের কোনো দাবিই নেই। সুদেব বরং রোজ সকালে একব্যাগ বাজার নামিয়ে রাখছে, ফ্রিজে ডিম-দুধ ফুরিয়ে গেলে নিজেই দেখেশুনে কিনে আনছে। মেয়ের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে সুদেব সদাতত্পর। মেয়ের জন্য একটি খাট, পড়ার টেবিল আর সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ বিয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কিনে এনেছে। এবং প্রথম দু’একদিনের পর সুদেব নিজে খাওয়াদাওয়া হলে এসি চালিয়ে হালকা চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়ছে। সুদেবের দ্বিতীয় বউ নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়ের সঙ্গে মাধ্যমিকের পড়াশুনা চালাচ্ছে। সংসার করতে গিয়ে সুদেব দেখছে তবু যেন ছোটখাটো ভুল সে করেই ফেলছে, এই যেমন সেদিন কালোজিরের প্যাকেট শেষ, তবু বাজার থেকে আনতে ভুলে গেল, মাংসের জন্য দই আনতে দু’বার দোকানে যেতে হল। এজন্য সংসারে কোনো অশান্তি নেই, দ্বিতীয় বউটি অফিসের জামাকাপড় ইস্ত্রি করে রাখছে, টিফিনবাক্স গুছিয়ে রাখছে।
দ্বিতীয় বিয়ের তিনমাসের মাথায় সুদেবের চাকরিটা চলে গেল। সুদেব ছিল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। মাঝারি মাপের একটি ফার্মে সিনিয়ার ম্যানেজার। তাদের মাঝারি কোম্পানিটিকে একটি বড় আমেরিকান ফার্ম কিনে নিল এবং টপ ম্যানেজমেন্টের সবাইকে একদিনে রেজিগনেশন দিতে অনুরোধ করলো। সুদেব যদি জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বা নিদেনপক্ষে করণিক হত হয়ত চাকরিটা যেত না, হাজার পনের মাইনেতে সংসার চালিয়ে দিতে পারতো। নিচুতলার ছাঁটাই হলে কাজ করার লোক পাওয়া যাবে না, উপরতলার বদলি ইন্ডাস্ট্রিতে অঢেল, পিএফ আর ছাঁটাইয়ের ভয়ে সব বাবুরা রেজিগনেশন জমা করে দিল। সুদেব সেদিন অঢেল মদ খেলো, আলসারের পুরনো ব্যথায় কাতরালো, বমি আর খিস্তি করতে করতে বাড়ি ঢুকলো। সুদেবের অবস্থা দেখে মেয়ে ভয় পেয়ে গেল, দ্বিতীয় বউ তাড়াতাড়ি মেয়েকে বইখাতা সমেত—মেয়ের সামনে মাধ্যমিক—বেডরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে সুদেবকে মেয়ের খাটে শুইয়ে দিল। পরদিন সকালে এ নিয়ে কোনো কথা হল না, সংসারী সুদেব এক কিলোর ইলিশ নিয়ে এলো। মেয়ের সঙ্গে অনেকটা গল্প করে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। বউ জিজ্ঞেস করলো—অফিস যাবে না, শরীর ঠিক আছে? সুদেব বললো, একটু অম্বল। সুদেবের দ্বিতীয় বউ আর কোনো কথা না বলে ইলিশ রাঁধতে গেল।
মধ্যরাতে সুদেব তার দ্বিতীয় বউকে বললো—তার আর চাকরি নেই। বউ বললো—মেয়েকে বোলো না, সামনে মাধ্যমিক, চিন্তা করবে। মায়ের পেনশন তো আছে। আমারও কিছু গয়না আছে। এতগুলো বছরতো দুটো মানুষের চললোই। পরদিন এগারোটার মধ্যে সংসারের সব কাজ সেরে সুদেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কফিহাউসে দশ কাপ কফি খেয়ে চারঘণ্টা কাটালো, বিকালে ময়দানে গিয়ে ঘাসে তন্দ্রা দিল। মেয়ের যতদিন না মাধ্যমিক হলো সুদেবের এইভাবেই চললো। পাছে মেয়ে জানতে পেরে যায়, সুদেব তাই সারাদুপুর বন্ধুবান্ধবের অফিসে ঢুঁ মারে, নাটকের দলের রিহার্সাল দেখে, ময়দানে ঘাস চিবোয়, কফিহাউসে আর কফি খাওয়া হয় না, বরং সন্ধে নামলে সে টাকায় খালাসিটোলায় গিয়ে সস্তায় বাংলা খায়। একদিন পিএফের টাকা পেতে পুরনো অফিসে গেল, প্রথম বিয়ের পর সে এই অফিসে চাকরিতে ঢুকেছিলো, এখানে শেষ ষোলটা বছর আটঘণ্টা করে সপ্তাহের দিনগুলো কাটিয়েছে। নতুন একাউটেন্ট মেয়েটি বললো লাখ চারেকের মতো পিএফ পাওনা আছে সুদেবের। একগুচ্ছ ফর্মফিলাপ করতে হবে, বছরের শেষ দিকে হয়ত টাকাটা পেতে পারে। সুদেব ফর্মটর্ম পূরণ করে খালাসিটোলায় গেল। এক বাল্যবন্ধুর কাছে হাজার খানেক টাকা ধার নিয়েছে। তাতেই মদ, তাতেই বাসভাড়া। সকালে বাজারের পয়সা দ্বিতীয় বউ তার মায়ের পেনশন থেকে দিচ্ছে। হিসেব চাইছে না, সুদেব তবু বাজার থেকে ফিরে খুচরো টাকা, দশটাকার নোট ড্রেসিংটেবিলের সামনে রেখে দিচ্ছে। দু’একটা চাকরির খোঁজ আছে, কিন্তু সেসব কাজ চব্বিশ ছাব্বিশ বছরের তরুণ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার করতে পারে। পেটে আলসার, ব্লাডপ্রেসার নিয়ে আর সুদেব সাইটে দাঁড়াতে পারবে না। টাকার প্রয়োজন থাকলেও সুদেব তাই অফার ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা অফিসজব পেলে অবশ্যই নেবে, মিষ্টির দোকানে খাতা দেখার কাজ থাকলেও নেবে। কিন্তু সুদেব সংসারী। সকালবেলাটা তার সংসারের কাজে বেরিয়ে যায়, মেয়ের সামনে মাধ্যমিক, মেয়েকে তাই অংক দেখায়, দুপুরটা কাটে বন্ধুদের পয়সায় চা-কফি খেয়ে আর সন্ধেটা নিজের পয়সায় বাংলা খেয়ে। ওয়েলিংটন থেকে দুবার বাস পালটে সুদেব বাড়ি ফেরে, কন্ডাকটাররা মুখচেনা হয়ে গেছে, দু’একদিনের বাসভাড়া বাকি রাখা যায়।
মেয়ের মাধ্যমিকের পর সুদেবের আর বাড়িতে মদ খাওয়ায় কোনো বাধা রইলো না। সে জন্তু না, সে মদ খেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে না আর তার দ্বিতীয় পক্ষের বউটাও ভালো। সুদেব তাই রাত্রে খাওয়ার টেবিলে বসে বরফঠাণ্ডা জলে বাংলা মেশায়। বউ আর মেয়ে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সুদেব ভালো সংসারী হতে চেয়েছিল। দ্বিতীয়বারের সংসারে সে যে জিনিসটা প্রথম কিনেছিল তা হল মেয়ের জন্য খাট। অল্প টলতে টলতে এসে সেই খাটে এখন বেঘোরে ঘুমায় সুদেব। বউ-মেয়ে তার মদ্যপানে বাধা দেয় না, সুদেবও তাদের কাছে কিছুর দাবি করে না তবু তার বউ কালো জিরে দিয়ে কাটাপোনা রাঁধে। মাসে একবার করে গিয়ে সুদেবের দ্বিতীয় বউ মায়ের পেনশনের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনে। সুদেব যে টাকা বন্ধুদের থেকে ধার নিয়েছিল সে টাকা ফুরিয়েছে, মদ খেয়ে আর সংসারের টুকটাক কাজে ফুরিয়েছে। মদ খেতে খেতে সুদেব নিজের ক্রমক্ষীয়মাণ শরীরের দিকে তাকায়। প্রথম বউয়ের কথা মনে করার চেষ্টা করে। মনে করার চেষ্টা করে বিয়েতে কী কী মেনু ছিল আর বউ চলে যাওয়ার পর প্রথম মাসটা সে কেমন বিছানায় ছটফট করত। ভাবতে ভাবতে সুদেব লুঙ্গির মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নিজেকে খোঁজে। ভাবে একটা চাকরি পেলে পুজোয় ঘু্রতে যাবে। ভাবতে ভাবতে দ্বিতীয় সংসারের জন্য কেনা সিঙ্গল খাটে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে উঠে সুদেব আজকাল আর বাজারে যাচ্ছে না। বিগত কয়েকদিন ড্রেসিংটেবিলের উপর বাজারফেরতা খুচরো রাখেনি। ইচ্ছে করেই; মদের সঙ্গে চাট কেনার টাকাটাও বন্ধুদের থেকে হাত পেতে নিতে হাত কাঁপে। সুদেব বাজার ফেরতা দশ-বারো টাকার চানাচুর কিনে সিঙ্গল খাটের ম্যাট্রেসের নিচে রেখে দেয়। সুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রীটি কোনো অশান্তি করেনি, নির্দ্বিধায় সুদেবের এলোমেলো বেডকভার গুছিয়ে দেয়। তার চোখে চানাচুরের খালি-ভর্তি প্যাকেট পড়েছে। অথর্ব মায়ের পেনশনের টাকা, সংসারের জন্য ঐ কটি টাকাই। সুদেবকে কিছু বলেনি। সুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী নিজেই চটের থলি নিয়ে বাজার করে আনে, সংসারের এটা ওটা দরকারের জিনিস কিনে আনেন। ঘুমচোখে সুদেব দেখে তার দ্বিতীয় বউ ফ্ল্যাটের দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল।
বিয়েটা কেনো টিকলো না ভাবার চেষ্টা করলে সুদেব আর মেয়েটির কোনো দোষ দেখতে পায় না। মেয়েটিই যেখানে ঝাপসা হয়ে গেছে, সেখানে মেয়েটির আর কী দোষই বা স্পষ্ট থাকবে। সুদেব বরং নিজের দোষ দেখতে পায়। প্রচুর দোষ, অসংখ্য দোষ। গুছিয়ে সংসার করার বয়সে সে সংসারে প্রবেশ করেনি। অল্পবয়সে বিয়েটা করেছিল। কলেজের লাস্ট ইয়ারে। আর গুছিয়ে সংসার করার বয়সে পৌঁছে অগোছালোভাবটা তার সর্বাঙ্গ ঢেকে দিয়েছে। সুদেব তাই এবার সাতটায় উঠে বাজারে যাবে, দরকারি কোনো জিনিস কিনতে ভুল করবে না, সংসারের মানুষদের প্রয়োজন মেটাবে, বছরে একবার পাহাড়ে ঘুরতে যাওয়াও যেতে পারে। আলসারের অপারেশনের পর এমনিতেই মদ খাওয়া কমে গেছে, সপ্তাহে দু’একদিন, এক-দু পেগ, তাও পুরনো বন্ধুদের চাপে। সুদেবের স্কুলবেলার কথা মনে পড়ে—এনুয়াল পরীক্ষায় মাঝারি ফল করার পর প্রতিবার প্রতিজ্ঞা করতো নতুন ক্লাসে ভালোভাবে পড়াশুনা করবে। মধ্যমেধার ছাত্র সে, মধ্যমেধাকে অজুহাত বানিয়ে ইস্কুলের অসাফল্যগুলোকে সান্ত্বনা দেয়। সংসারে তার অক্ষমতাগুলো স্পষ্ট, সেগুলো ঝেড়ে ফেলাও কঠিন নয়, সুদেব ভাবে দ্বিতীয়বার বিবাহ করে এবার সংসারী হবে।
প্রথমবার বিয়ের থেকে সুদেব ও সেই মেয়েটির কোনো ছেলেপুলে হয়নি। সুদেবের দ্বিতীয় বউয়ের প্রথম পক্ষ থেকে একটি মেয়ে ছিলই। বন্ধুদের আসরে সুদেবের সঙ্গে দ্বিতীয় বউয়ের প্রথম পরিচয় হয়। তখনও সুদেবের প্রথম ডিভোর্সটি হয়নি। দুজনের সম্পর্কটা কেবলমাত্র পরিচিতির স্তরেই ছিল। দ্বিতীয় বউয়ের ততদিনে প্রথম ডিভোর্সটি হয়ে গেছে। দ্বিতীয়বার বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সুদেব তাই আর বেশি ছোঁকছোঁক করেনি, উদ্দেশ্য যখন সংসারী হওয়া তখন আর প্রেমে মজে বৃথা সময় নষ্ট করা কেনো!
দ্বিতীয় বউটি ভালোই, নিঃসন্দেহে। বিয়াল্লিশ বছরের মদ্যপ, চাকুরিজীবীকে বিবাহ করার মানসিকতা নিয়েই সে সুদেবের বাগুইহাটির ফ্ল্যাটে প্রবেশ করলো। বিয়ে হল অনাড়ম্বরভাবে। এ জীবনে, সুদেব হাঁপ ছেড়ে ভাবলো, দু’দুটি বিবাহের পিছনে লোক খাইয়ে তাকে আর পয়সা নষ্ট করতে হল না। গেজেটেড অফিসার বাপ প্রথম বিয়েটি টাকা পয়সা উড়িয়ে দিয়েছিল। দ্বিতীয় বিয়েতে, সইসাবুদের পর বন্ধুদের আপবিট বেঙ্গলি ফিউশন রেস্তোরাঁতে বাফে খাইয়ে দেওয়া হল, বিল হল হাজার আঠারো—এবাদে বউ আর মেয়ের ট্যাক্সিভাড়া বাবদ আরো হাজার। দ্বিতীয় বউ যখন সুদেবের ফ্ল্যাটে ঢুকছে তার ডানহাত শক্ত করে চেপে ধরে আছে মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়ে। সুদেব স্যুটকেশ নামিয়ে ফ্ল্যাটের তালাচাবি খুললো। পাশের ফ্ল্যাটের মজুমদাররা এসে বউ দেখে গেলেন। মজুমদার গিন্নি একটা হালকা নথ উপহার দিলেন। রাত্রি দশটার দিকে বন্ধুবান্ধব গানবাজনা করে বিদায় নিলে, মেয়েও ঘুমের অজুহাতে ড্রয়িংরুমের সোফায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। দ্বিতীয় বউ যেন মেয়েকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গিয়েও পারলো না। সুদেব দ্বিতীয়বারের জন্য ফুলশয্যায় প্রবেশ করলো। দ্বিতীয় বউয়ের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেল। সে প্রথমবার লক্ষ্য করল তার দ্বিতীয় স্বামীর বুকময় সাদা চুল। পরদিন সকালে উঠে বাজার নামিয়েই সুদেব ছুটলো ফার্নিচারের দোকানে মেয়ের জন্য একখানি সস্তার সিঙ্গল খাট কিনতে, নিদেনপক্ষে একটি ক্যাম্পখাট। এইভাবে সুদেব তার দ্বিতীয় সংসার শুরু করলো।
দ্বিতীয় বউ এককালে চাকুরি করতো, মেয়ে জন্মানোর পর ছেড়ে দেয়। ডিভোর্সের পর মায়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করে। চাকরিতে আর ফেরা হয়নি, মৃত বাবার পেনশন, অল্প সঞ্চয় আর খোরপোশে মেয়েকে পড়াচ্ছিলো, নিজেকে সামলাচ্ছিলো। ডিভোর্সের পর দু’একবার পুরুষের প্রেমাসিক্ত হতে হতেও নিজেকে সামলেছে। পরনির্ভরশীল একট ডিভোর্সি মেয়েকে ফুঁসলে নেওয়ার মতো দুর্জনের অভাব কলকাতা শহরে নেই। অতপর সে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, মেয়ের পড়াশোনায় নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে। ময়লা ঝেড়ে ফের হারমোনিয়ামে রেওয়াজ শুরু করেছে, মাঝেমধ্যে মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে ও মেয়েকে কোলে নিয়ে অনির্বচনীয় আনন্দে মেতে উঠেছে। মা চাকরির কথা তুললে, ওসব ভুলে গেছি বলে দায় ঠেলেছে। মায়ের শরীর ভাঙতে শুরু করার পর, মা ‘ঈশ্বর যা করেন ভালোর জন্যেই করেন’ এই দিকটা বুঝতে পেরেছেন। সংসারে তাকে দেখার বলতে একমাত্র এই ডিভোর্সি মেয়ে। সুদেবের দ্বিতীয় বউটি কিন্তু বিবাহিত সুদেবের দিকে একবারটির জন্যও হাত বাড়ায়নি, বন্ধুদের গ্রুপের অনেককে নিয়ে রাতজাগা-চিন্তায় রমণ করলেও সুদেব ছাড় পেয়েছিল। নিতান্ত সাধারন, নিতান্ত মদ্যপ, নিতান্ত চাকুরিজীবি সুদেব। আর সেকারণেই ডিভোর্সি সুদেবকে ভারি নির্ঝঞ্ঝাট মনে হল। এতগুলো বছর একা থাকার পর একটি পুরুষের জীবনে ফের জায়গা নেওয়ার মতো যথেষ্ট মনের জোর অবশিষ্ট ছিল না। পুরুষের দাবিগুলো কতটা মেটাতে সে সক্ষম হবে তা নিয়ে সংশয় ছিল এবং তার মেয়ের জীবনেও জ্ঞান হওয়ার পর প্রথম পুরুষের উপস্থিতি, সেই শঙ্কা! সুদেবের দ্বিতীয় বউ মায়ের পরামর্শ নিয়ে, মায়ের জন্য একটি আয়ার ব্যাবস্থা করে, বিয়েতে সম্মতি দিল।
দু’জনের দ্বিতীয় সংসারটিই দু’জনের জন্য অনেকটা বিস্ময়ের ও স্বস্তির হল। সুদেব কয়েকদিন সংসার করেই বুঝলো এইবার তার সংসারী হওয়ার ইচ্ছে রয়েছে কিন্তু অপরপক্ষের সুদেবের কাছে সংসারী হওয়ার জন্য কোনো প্রত্যাশা নেই। আর দ্বিতীয় বউটি দেখল—পুরুষের দাবিদাওয়া নিয়ে তার মনে যতই শঙ্কা থাক, সুদেবের কোনো দাবিই নেই। সুদেব বরং রোজ সকালে একব্যাগ বাজার নামিয়ে রাখছে, ফ্রিজে ডিম-দুধ ফুরিয়ে গেলে নিজেই দেখেশুনে কিনে আনছে। মেয়ের যাতে কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে সুদেব সদাতত্পর। মেয়ের জন্য একটি খাট, পড়ার টেবিল আর সেকেন্ড হ্যান্ড ল্যাপটপ বিয়ের প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই কিনে এনেছে। এবং প্রথম দু’একদিনের পর সুদেব নিজে খাওয়াদাওয়া হলে এসি চালিয়ে হালকা চাদর টেনে ঘুমিয়ে পড়ছে। সুদেবের দ্বিতীয় বউ নিশ্চিন্ত হয়ে মেয়ের সঙ্গে মাধ্যমিকের পড়াশুনা চালাচ্ছে। সংসার করতে গিয়ে সুদেব দেখছে তবু যেন ছোটখাটো ভুল সে করেই ফেলছে, এই যেমন সেদিন কালোজিরের প্যাকেট শেষ, তবু বাজার থেকে আনতে ভুলে গেল, মাংসের জন্য দই আনতে দু’বার দোকানে যেতে হল। এজন্য সংসারে কোনো অশান্তি নেই, দ্বিতীয় বউটি অফিসের জামাকাপড় ইস্ত্রি করে রাখছে, টিফিনবাক্স গুছিয়ে রাখছে।
দ্বিতীয় বিয়ের তিনমাসের মাথায় সুদেবের চাকরিটা চলে গেল। সুদেব ছিল ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার। মাঝারি মাপের একটি ফার্মে সিনিয়ার ম্যানেজার। তাদের মাঝারি কোম্পানিটিকে একটি বড় আমেরিকান ফার্ম কিনে নিল এবং টপ ম্যানেজমেন্টের সবাইকে একদিনে রেজিগনেশন দিতে অনুরোধ করলো। সুদেব যদি জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বা নিদেনপক্ষে করণিক হত হয়ত চাকরিটা যেত না, হাজার পনের মাইনেতে সংসার চালিয়ে দিতে পারতো। নিচুতলার ছাঁটাই হলে কাজ করার লোক পাওয়া যাবে না, উপরতলার বদলি ইন্ডাস্ট্রিতে অঢেল, পিএফ আর ছাঁটাইয়ের ভয়ে সব বাবুরা রেজিগনেশন জমা করে দিল। সুদেব সেদিন অঢেল মদ খেলো, আলসারের পুরনো ব্যথায় কাতরালো, বমি আর খিস্তি করতে করতে বাড়ি ঢুকলো। সুদেবের অবস্থা দেখে মেয়ে ভয় পেয়ে গেল, দ্বিতীয় বউ তাড়াতাড়ি মেয়েকে বইখাতা সমেত—মেয়ের সামনে মাধ্যমিক—বেডরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে সুদেবকে মেয়ের খাটে শুইয়ে দিল। পরদিন সকালে এ নিয়ে কোনো কথা হল না, সংসারী সুদেব এক কিলোর ইলিশ নিয়ে এলো। মেয়ের সঙ্গে অনেকটা গল্প করে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। বউ জিজ্ঞেস করলো—অফিস যাবে না, শরীর ঠিক আছে? সুদেব বললো, একটু অম্বল। সুদেবের দ্বিতীয় বউ আর কোনো কথা না বলে ইলিশ রাঁধতে গেল।
মধ্যরাতে সুদেব তার দ্বিতীয় বউকে বললো—তার আর চাকরি নেই। বউ বললো—মেয়েকে বোলো না, সামনে মাধ্যমিক, চিন্তা করবে। মায়ের পেনশন তো আছে। আমারও কিছু গয়না আছে। এতগুলো বছরতো দুটো মানুষের চললোই। পরদিন এগারোটার মধ্যে সংসারের সব কাজ সেরে সুদেব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। কফিহাউসে দশ কাপ কফি খেয়ে চারঘণ্টা কাটালো, বিকালে ময়দানে গিয়ে ঘাসে তন্দ্রা দিল। মেয়ের যতদিন না মাধ্যমিক হলো সুদেবের এইভাবেই চললো। পাছে মেয়ে জানতে পেরে যায়, সুদেব তাই সারাদুপুর বন্ধুবান্ধবের অফিসে ঢুঁ মারে, নাটকের দলের রিহার্সাল দেখে, ময়দানে ঘাস চিবোয়, কফিহাউসে আর কফি খাওয়া হয় না, বরং সন্ধে নামলে সে টাকায় খালাসিটোলায় গিয়ে সস্তায় বাংলা খায়। একদিন পিএফের টাকা পেতে পুরনো অফিসে গেল, প্রথম বিয়ের পর সে এই অফিসে চাকরিতে ঢুকেছিলো, এখানে শেষ ষোলটা বছর আটঘণ্টা করে সপ্তাহের দিনগুলো কাটিয়েছে। নতুন একাউটেন্ট মেয়েটি বললো লাখ চারেকের মতো পিএফ পাওনা আছে সুদেবের। একগুচ্ছ ফর্মফিলাপ করতে হবে, বছরের শেষ দিকে হয়ত টাকাটা পেতে পারে। সুদেব ফর্মটর্ম পূরণ করে খালাসিটোলায় গেল। এক বাল্যবন্ধুর কাছে হাজার খানেক টাকা ধার নিয়েছে। তাতেই মদ, তাতেই বাসভাড়া। সকালে বাজারের পয়সা দ্বিতীয় বউ তার মায়ের পেনশন থেকে দিচ্ছে। হিসেব চাইছে না, সুদেব তবু বাজার থেকে ফিরে খুচরো টাকা, দশটাকার নোট ড্রেসিংটেবিলের সামনে রেখে দিচ্ছে। দু’একটা চাকরির খোঁজ আছে, কিন্তু সেসব কাজ চব্বিশ ছাব্বিশ বছরের তরুণ ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার করতে পারে। পেটে আলসার, ব্লাডপ্রেসার নিয়ে আর সুদেব সাইটে দাঁড়াতে পারবে না। টাকার প্রয়োজন থাকলেও সুদেব তাই অফার ফিরিয়ে দিচ্ছে। একটা অফিসজব পেলে অবশ্যই নেবে, মিষ্টির দোকানে খাতা দেখার কাজ থাকলেও নেবে। কিন্তু সুদেব সংসারী। সকালবেলাটা তার সংসারের কাজে বেরিয়ে যায়, মেয়ের সামনে মাধ্যমিক, মেয়েকে তাই অংক দেখায়, দুপুরটা কাটে বন্ধুদের পয়সায় চা-কফি খেয়ে আর সন্ধেটা নিজের পয়সায় বাংলা খেয়ে। ওয়েলিংটন থেকে দুবার বাস পালটে সুদেব বাড়ি ফেরে, কন্ডাকটাররা মুখচেনা হয়ে গেছে, দু’একদিনের বাসভাড়া বাকি রাখা যায়।
মেয়ের মাধ্যমিকের পর সুদেবের আর বাড়িতে মদ খাওয়ায় কোনো বাধা রইলো না। সে জন্তু না, সে মদ খেয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে না আর তার দ্বিতীয় পক্ষের বউটাও ভালো। সুদেব তাই রাত্রে খাওয়ার টেবিলে বসে বরফঠাণ্ডা জলে বাংলা মেশায়। বউ আর মেয়ে শোওয়ার ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে। সুদেব ভালো সংসারী হতে চেয়েছিল। দ্বিতীয়বারের সংসারে সে যে জিনিসটা প্রথম কিনেছিল তা হল মেয়ের জন্য খাট। অল্প টলতে টলতে এসে সেই খাটে এখন বেঘোরে ঘুমায় সুদেব। বউ-মেয়ে তার মদ্যপানে বাধা দেয় না, সুদেবও তাদের কাছে কিছুর দাবি করে না তবু তার বউ কালো জিরে দিয়ে কাটাপোনা রাঁধে। মাসে একবার করে গিয়ে সুদেবের দ্বিতীয় বউ মায়ের পেনশনের টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে আনে। সুদেব যে টাকা বন্ধুদের থেকে ধার নিয়েছিল সে টাকা ফুরিয়েছে, মদ খেয়ে আর সংসারের টুকটাক কাজে ফুরিয়েছে। মদ খেতে খেতে সুদেব নিজের ক্রমক্ষীয়মাণ শরীরের দিকে তাকায়। প্রথম বউয়ের কথা মনে করার চেষ্টা করে। মনে করার চেষ্টা করে বিয়েতে কী কী মেনু ছিল আর বউ চলে যাওয়ার পর প্রথম মাসটা সে কেমন বিছানায় ছটফট করত। ভাবতে ভাবতে সুদেব লুঙ্গির মধ্যে দিয়ে হাত ঢুকিয়ে নিজেকে খোঁজে। ভাবে একটা চাকরি পেলে পুজোয় ঘু্রতে যাবে। ভাবতে ভাবতে দ্বিতীয় সংসারের জন্য কেনা সিঙ্গল খাটে ঘুমিয়ে পড়ে।
সকালে উঠে সুদেব আজকাল আর বাজারে যাচ্ছে না। বিগত কয়েকদিন ড্রেসিংটেবিলের উপর বাজারফেরতা খুচরো রাখেনি। ইচ্ছে করেই; মদের সঙ্গে চাট কেনার টাকাটাও বন্ধুদের থেকে হাত পেতে নিতে হাত কাঁপে। সুদেব বাজার ফেরতা দশ-বারো টাকার চানাচুর কিনে সিঙ্গল খাটের ম্যাট্রেসের নিচে রেখে দেয়। সুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রীটি কোনো অশান্তি করেনি, নির্দ্বিধায় সুদেবের এলোমেলো বেডকভার গুছিয়ে দেয়। তার চোখে চানাচুরের খালি-ভর্তি প্যাকেট পড়েছে। অথর্ব মায়ের পেনশনের টাকা, সংসারের জন্য ঐ কটি টাকাই। সুদেবকে কিছু বলেনি। সুদেবের দ্বিতীয় স্ত্রী নিজেই চটের থলি নিয়ে বাজার করে আনে, সংসারের এটা ওটা দরকারের জিনিস কিনে আনেন। ঘুমচোখে সুদেব দেখে তার দ্বিতীয় বউ ফ্ল্যাটের দরজা ভেজিয়ে বেরিয়ে গেল।
No comments