সব চেষ্টাই ব্যর্থ ইমরান খানের

ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন। ক্রিকেটের এই আপ্ত বাক্যটিই শেষ পর্যন্ত সত্য হয়েছে রাজনীতিক ইমরান খানের জন্য। শত চেষ্টা করেও গদি বাঁচাতে পারলেন না ‘কাপ্তান’ ইমরান খান। এমন কোনো উপায় নেই, যা তিনি চেষ্টা করেননি। এমনকি শনিবার মধ্যরাতে সেনাপ্রধানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন বলে খবর বেরিয়েছে। তাতেও সফল হননি। সুপ্রিম কোর্টের আদেশে শনিবার দিনভর এবং মধ্যরাত পর্যন্ত চরম নাটকীয়তা চলতে থাকে পাকিস্তানে। এদিন স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই (বিদায়ী) প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাবে পার্লামেন্টে ভোট করার নির্দেশ ছিল আদালতের।

কিন্তু স্পিকার আসাদ কাইসার ও ইমরান খানের দল পিটিআইয়ের পার্লামেন্ট সদস্যরা চতুরতার আশ্রয় নেন। তারা পার্লামেন্টের অধিবেশনকে বিলম্বিত করার সব রকম চেষ্টা করতে থাকেন। এরই মধ্যে কমপক্ষে চার দফা অধিবেশন মুলতবি করা হয়। এরই মধ্যে খবর আসে ইমরান খানের বাড়িতে হেলিকপ্টারে করে দু’জন অতিথি গিয়েছেন। তারা কারা, কি উদ্দেশ্যে গিয়েছেন, তার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। এ নিয়ে বিবিসি রিপোর্ট করেছে যে, ওই দুই অতিথি ইমরানের ইসলামাবাদের বাড়িতে গোপন বৈঠক করতে গিয়েছিলেন। ১৫ মিনিট তাদের মধ্যে বৈঠক হয়। এর মধ্যে ‘শীর্ষ এক কর্মকর্তাকে’ তার পদ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চেয়েছিলেন ইমরান খান। আবার বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে দাবি করেছে, শনিবার রাতেই পাকিস্তানের সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়া এবং সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই’র মহাপরিচালক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আঞ্জুমের সঙ্গে গোপন বৈঠক করেন ইমরান। তবে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এমন বৈঠকের রিপোর্টকে মিথ্যা বলে জানিয়েছে পাকিস্তানের আইএসপিআর। একই সঙ্গে এ রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করেছেন ইমরান খানও। আইএসপিআর বলেছে, এমন রিপোর্ট প্রপাগান্ডা বা প্রচারণা। এর কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। এ তথ্য যাচাই করা এবং সংশ্লিষ্ট সূত্রের নয়। এর মধ্যদিয়ে বিবিসি সাংবাদিকতার মৌলিক নীতি লঙ্ঘন করেছে বলে দাবি করা হয় আইএসপিআরের বিবৃতিতে। এ বিষয়টি বিবিসি’র সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছে তুলে ধরা হয়েছে। ওদিকে পাকিস্তানের জিও নিউজ নির্ভরশীল সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে রিপোর্ট করে যে, সেনাপ্রধান কমর জাভেদ বাজওয়াকে তার পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছেন বলে যে রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছেন ইমরান খান। এখানে বলে রাখা ভালো যে, আইএসআইয়ের মহাপরিচালক নিয়োগ নিয়েই ইমরান খান ও সেনাপ্রধান বাজওয়ার মধ্যে দূরত্বের বিষয়টি ফুটে ওঠে। এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ইমরান খান যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান তাদের দাস নয়। এরপরই সেনাপ্রধান বলেন, পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু যুক্তরাষ্ট্র। ফলে তাদের মধ্যে দূরত্ব যে বেড়েছে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এখন নানা দিক থেকে বিশ্লেষণ চলছে। অনেকে বলছেন, সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিরোধ, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিরোধ এবং রাশিয়া, বেইজিংয়ের সঙ্গে সখ্যতার কারণে ইমরান খানকে ক্ষমতা হারাতে হয়েছে।
শনিবার পাকিস্তানের পার্লামেন্টে দিনভর চলতে থাকে হাই ড্রামা। মধ্য রাতে তাতে যবনিকাপাত হলো। ড্রামা বা নাটকের শেষ অঙ্ক মঞ্চায়ন হলো। আর রচিত হলো পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন ইতিহাস। চারদিকে আলোচনা মধ্যরাতের ‘ওই অতিথিদের’ ইমরান খানের বাড়িতে যাওয়ার পরেই আকস্মিকভাবে পার্লামেন্টে নাটকের শেষ অঙ্কের যবনিকাপাত শুরু হয়। পার্লামেন্টের স্পিকার আসাদ কাইসার, ডেপুটি স্পিকার কাসিম সুরি পদত্যাগ করেন রাত ১২টা বাজার ১০ মিনিট আগে। এরপর স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএলএন) নেতা ও সাবেক স্পিকার আয়াজ সাদিক। তাতেই রাত ১২টার পরে নতুন দিনে অর্থাৎ রোববার দিনের একেবারে শুরুর লগ্নে পার্লামেন্টে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট হয়। এতে বিরোধী দলের ১৭৪ জন এমপি ভোট দেন। ইমরান খানের পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফের (পিটিআই) সদস্যরা এ সময় পার্লামেন্ট থেকে বেরিয়ে যান। এই ভোটেই পাকিস্তানে প্রথম ক্রিকেটে বিশ্বকাপে চ্যাম্পিয়ন ট্রফি এনে দেয়া ক্যাপ্টেন ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হন। এরই মধ্যে তিনি হেলিকপ্টারে করে ইসলামাবাদ ত্যাগ করেন। ক্রিকেটের মাঠে অসম্ভব নৈপুণ্য দেখালেও রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত হেরে যান ইমরান। আর এর মধ্যদিয়ে তিনি হলেন অনাস্থা প্রস্তাবে প্রথম ক্ষমতা হারানো পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী। তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে পেরে বিরোধী শিবিরে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়েন ইমরানভক্তরা।
পাকিস্তানের স্থানীয় সময় শনিবার দিবাগত রাত একটায় (বাংলাদেশ সময় রাত ২টা) এই প্রস্তাব পাস হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছেন ১৭৪ জন এমপি। পাস হতে প্রয়োজন হয় ১৭২টি ভোট। কিন্তু তার চেয়ে দুটি ভোট বেশি হওয়ায় প্রস্তাব পাস হয়েছে বলে ঘোষণা দেন স্পিকারের আসনে নতুন আসা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের নেতা আয়াজ সাদিক। দলটির আরেক নেত্রী মরিয়ম আওরঙ্গজেব বলেছেন, স্পিকারের আসনে বসে সভাপতিত্ব করার কারণে আয়াজ সাদিক ভোট দিতে পারেননি। ওদিকে পিটিআইয়ের বিদ্রোহীদের ভোট কাস্ট হয়নি। স্থানীয় সময় রাত ১২টার (বাংলাদেশ সময় রাত ১টা) ১০ মিনিট আগে এই কার্যক্রম শুরু হয়। এর আগে স্পিকার আসাদ কাইসারকে সতর্ক করা হয় যে, তিনি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ না মানলে তার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা হবে। ততক্ষণে সুপ্রিম কোর্টে ফিরে যান প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়াল। বলা হয়, অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট না দিলে স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা দেয়া হতে পারে। এমন এক প্রেক্ষাপটে পদত্যাগ করেন তিনি। নতুন স্পিকার হিসেবে তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগ নওয়াজের (পিএমএলএন) নেতা ও সাবেক স্পিকার আয়াজ সাদিককে স্পিকার হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে যান এবং তাকে অধিবেশন পরিচালনার অনুরোধ করেন। পদত্যাগ করে স্পিকার আসাদ কাইসার বলেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের বিদেশি ষড়যন্ত্রের অংশ হতে পারেন না। এর আগে বিকালেই তিনি জানিয়ে দেন, ইমরান খানের সঙ্গে তার ৩০ বছরের সম্পর্ক। তার বিরুদ্ধে তিনি অনাস্থা ভোট দিতে পারবেন না। আসাদ কাইসার পদত্যাগের ঘোষণা দেয়ার আগে বলেন, মন্ত্রিপরিষদ থেকে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ডকুমেন্ট পেয়েছেন। তা দেখার জন্য তিনি বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরীফ ও প্রধান বিচারপতি উমর আতা বান্দিয়ালকে আমন্ত্রণ জানান। তার পদত্যাগের পর আয়াজ সাদিক স্পিকারের আসনে বসেন। এরপর আসাদ কাইসারকে তার দলের প্রতি অনুগত থাকার জন্য এবং সম্মানের সঙ্গে বিদায় নেয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন নতুন স্পিকার আয়াজ সাদিক। তার সম্পর্কে আয়াজ সাদিক বলেন, তার সঙ্গে আমাদের সবার খুব সুসম্পর্ক ছিল। কাজের সম্পর্ক ছিল। তিনি মর্যাদার সঙ্গে সব কাজ করেছেন। বিরোধী দলের সঙ্গেও একই রকম কাজ করেছেন। এরপরই তিনি পার্লামেন্টে বেল বাজাতে বলেন। এর মধ্য দিয়ে সদস্যদের এটাই জানিয়ে দেয়া হয় যে, অনাস্থা প্রস্তাবে ভোট শুরু হয়ে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট পরেই পার্লামেন্টের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর রাত ১১টা ৫৮ মিনিটে ভোট কার্যক্রম শুরু হয়। আয়াজ সাদিক এরপর নিয়ম অনুযায়ী চার মিনিটের জন্য অধিবেশন মুলতবি করেন। কারণ, একই অধিবেশন মধ্যরাত বা রাত ১২টার পরে চলতে পারে না। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত ও নাত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে নতুন অধিবেশন শুরু হয় রাত ১২টা ২ মিনিটে। এরপর ভোটিং প্রক্রিয়া শুরু হয়। পার্লামেন্টের একটি দরজার কাছে রক্ষিত রেজিস্ট্রারে পার্লামেন্ট সদস্যদের নাম লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে ভোট নিশ্চিত করতে বলা হয়।
একযোগে পদত্যাগ করবেন ইমরানের এমপিরা
পাকিস্তানের বিদায়ী তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী বলেছেন, ইমরান খান ক্ষমতা হারানোর পর আজ সোমবার জাতীয় পরিষদ থেকে একযোগে পদত্যাগ করবেন পাকিস্তান তেহরিকে ইনসাফ (পিটিআই) দলের সব এমপি। এদিনই অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করার কথা পার্লামেন্টের। রোববার প্রধানমন্ত্রী পদে পিএমএলএনের প্রার্থী শাহবাজ শরীফের মনোনয়নপত্র নিয়ে আপত্তি উত্থাপন করে পিটিআই। কিন্তু জাতীয় পরিষদের সেক্রেটারিয়েট সেই আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেছে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন ডন। পিটিআইয়ের অন্য নেতা ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাজধানী ইসলামাবাদে মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন ফাওয়াদ চৌধুরী। তিনি জানান, ইমরান খানের সঙ্গে তার বানিগালার বাসায় পিটিআইয়ের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির মিটিং হয়েছে। সেখানে সার্বিক পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এ সময় কমিটি ইমরান খানের কাছে জাতীয় পরিষদ থেকে পিটিআইকে পদত্যাগ করা উচিত বলে সুপারিশ উত্থাপন করেছে। ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, যদি শাহবাজ শরীফের মনোনয়নপত্রের বিষয়ে আমাদের আপত্তি আমলে নেয়া না হয়, তাহলে সোমবার আমরা পদত্যাগ করবো। তবে আজ প্রধানমন্ত্রী পদে দলীয় প্রার্থী ও পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মাহমুদ কুরেশির মনোনয়ন প্রসঙ্গে ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, এর মাধ্যমে শাহবাজ শরীফের মনোনয়নপত্রকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে। শাহবাজ শরীফ ও তার ছেলে হামজা শরীফের বিরুদ্ধে ১৪০০ কোটি রুপি পাচারের একটি মামলা আছে। সেই মামলায় তিনি আজই অভিযুক্ত হতে পারেন। সেই একই দিনে প্রধানমন্ত্রী পদে তার নির্বাচন করাকে ‘বড় অবিচার’ বলে আখ্যায়িত করেন ফাওয়াদ চৌধুরী। তিনি বলেন, বিদেশের বাছাই করা এবং বিদেশ থেকে আমদানি করা সরকার চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে। তাতে শাহবাজের মতো একজন ব্যক্তি হতে যাচ্ছেন প্রধান।



No comments

Powered by Blogger.