জিন্নাহ, গান্ধী ও খেলাফত

পুলিৎজার পুরস্কার বিজয়ী শিলা রেড্ডি তার নতুন ‘মি. এন্ড মিসেস জিন্নাহ: দ্যা ম্যারেজ দ্যাট শক ইন্ডিয়া’ বইয়ে জিন্নাহ দম্পতির সম্পর্কের বিভিন্ন দিক খতিয়ে দেখেছেন। এ ব্যাপারে বইটি থেকে কিছু উদ্ধৃতি তুলে ধরা হলো:
গান্ধী তার পরীক্ষামূলক রোলাট-বিরোধী আন্দোলনে ব্যর্থতা থেকে কিছু শিখেননি বলে মনে হয়। গান্ধী মনে হয় কিছু বিশেষ ব্যক্তিকে ঠিক করতে চেয়েছিলেন, এদের মধ্যে জিন্নাহও ছিলেন। গান্ধী তার চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে আপনি যত দ্রুত সম্ভব গুজরাটি ও হিন্দি শিখবেন। আমি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম ম্যাকুলের মতো এর অন্তত একটি ভাষা আপনি শিখবেন। ভাষা শেখার জন্য ম্যাকুলের মতো আপনার হাতে ছয় মাস সময় নেই। অবশ্য ম্যাকুলের মতো একই রকম সমস্যাও আপনার নেই।’
১৯৯১ সালের ২৮ জুন লেখা একই পত্রে গান্ধী জিন্নাহ’র দ্বিতীয় স্ত্রী রতনবাঈ বা ‘রুত্তি’, যিনি পরে মরিয়ম জিন্নাহ নামে পরিচিত হন, তার ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রসঙ্গও তুলেছেন: ‘প্রার্থনা করে আমি মিসেস জিন্নাহকে বলছি সে যেন তিনি মিসেস বাকের ও পাঞ্জাবি মহিলা মিসে রমাবাঈয়ের কাছে ফিরে আসে।’ জিন্নাহর ওপর জোর খাটাতে না পারলেও রুত্তির সঙ্গে গান্ধী সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। সম্ভবত সরোজিনির মাধ্যমে তিনি রুত্তির সঙ্গে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ করেন। তারা যে রুত্তির ওপর জোর খাটান তা বুঝা যায় রুত্তিকে লেখা গান্ধীর পত্র থেকে। এসব পত্রে সরোজিনির অনেক সরসকৌতুকের উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে জিন্নাহ এতে অংশ নেননি। এর কারণ সম্ভবত তার মর্যাদাবোধ।
জিন্নাহ ও রুত্তি লন্ডনে থাকা অবস্থায় গান্ধীর লেখা একটি পত্র থেকে মনে হয় জিন্নাহ এসব বিষয়ে পাত্তা দিতেন না। গান্ধীই বরং রুত্তির মাধ্যমে তার আর্জি জিন্নাহর কাছে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন। ১৯২০ সালের ৩০ এপ্রিল লেখা পত্রে বলা হয়: ‘দয়া করে আমার কথা জিন্নাহর কাছে বলো, তাকে হিন্দি বা গুজরাটি শিখতে উদ্বুদ্ধ করো। আমি যদি তোমার জায়গায় থাকতাম তাহলে তার সঙ্গে গুজরাটি বা হিন্দুস্তানি ভাষায় কথা বলা শুরু করে দিতাম। এতে তোমার ইংরেজি ভুলে যাওয়ার ভয় নেই। নিজেদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝিও সৃষ্টি হবে না। তুমি কি এ কাজটি করবে?
গান্ধী তার জিদপূর্ণ ভঙ্গিতে লিখেন, ‘হ্যাঁ, আমার প্রতি তোমার ভালোবাসার দোহাই দিয়ে আমি তোমাকে এটা করতে বলছি।’
হিন্দু-মুসলিম মিলন ঘটানোর জন্য ধর্মীয় কোন ইস্যু সম্ভবত গান্ধীর আগে-পরে আর কোন রাজনীতিবিদ বেছে নেননি। এটি ছিলো খেলাফত ইস্যু। প্রথম বিশ^যুদ্ধের পর পরাজিত তুরস্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে মুসলমানদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি হয়। অটোম্যান সম্রাজ্জ ভেঙে ফেলা হয়। তুর্কি খেলাফতের অধীন ভূখন্ড গুলো অমুসলিমরা দখল করে নেয়ায় পবিত্রভূমিগুলোর প্রতি হুমকি দেখা দেয়। মিত্রবাহিনীর শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে উত্তেজিত করতে এই একটি ইস্যুই ছিলো যথেষ্ট।
জিন্নাহর দৃষ্টিতে খেলাফতের প্রশ্নটি ছিলো দুর্ভাগ্যজনক। তবে এটা আদৌ কোন রাজনৈতিক ইস্যু নয়। যদিও এই ইস্যুতে তার কিছুটা আগ্রহ দেখা যায়, কিন্তু তা আন্তরিকতা পূর্ণ নয়। কিন্তু গান্ধী তার গতানুগতিক মিশনারি উদ্দীপনা নিয়ে এটি গ্রহণ করেন। জিন্নাহ যেখানে দূরে সরে থাকতে চান সেখানে গান্ধী কট্টর মুসলিম নেতাদের নিয়ে খেলাফতের পক্ষে আন্দোলন চালানোর ঘোষণা দেন। এটা তিনি করেছিলেন তার অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি মুসলমানদের সমর্থন পাওয়ার জন্য। অবস্থা এমন হয় যে তিনি যেখানেই যান যেখানেই কথা বলেন, খেলাফত প্রসঙ্গ নিয়ে আসেন। তার সহায়তা ও নির্দেশনায় প্রতিটি প্রদেশে খেলাফত কমিটি গঠিত হয়। জিন্নাহর মস্তিস্ক যখন ছিলো সংস্কার বিল নিয়ে চিন্তায় পূর্ণ তখন গান্ধী জনগণের দৃষ্টি সংস্কার থেকে খেলাফত ইস্যুতে ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম হন।
অমৃতসরের ঘটনার পর গান্ধী তার খেলাফত প্রচারণা আরো জোরেসোরে শুরু করেন। তিনি আলী ভাইদের নিয়ে সারা ভারত চষে বেড়ান হিন্দুদের কাছ থেকে খেলাফতের পক্ষে সমর্থন আদায়ের জন্য। এভাবে গান্ধী জিন্নাহকে আরেকটি বড় রকমের উভয় সঙ্কটে ফেলে দেন। জিন্নাহ আর খেলাফত থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলেন না। তবে তিনি গান্ধী বা গান্ধীর মুসলিম বন্ধুদের কাছ থেকে আসা চাপে ভেঙে পড়তে চাননি। পরিস্থিতি একদিকে তাকে টানছিলো, অন্যদিকে টানছিলো তার আত্মমর্যাদাবোধ। তবে স্বভাব মতো নিজের সমস্যাগুলো নিজের কাছেই রেখে দেন তিনি।

No comments

Powered by Blogger.