ফড়িংবন্ধু by অরণ্য প্রভা

স্কুলে যাবার সময় আম্মু তালহাকে অনেক বুঝিয়েছেন, কিচ্ছুতেই গলে নি সে। তার একটাই কথা—আগে কাশবনে বেড়াতে যাবে তারপর...।

দিন গড়িয়ে বিকেল এলে তালহার আনন্দ দেখে কে? বাড়ির অদূরেই কাশবন। কাশবন তো নয় এটা গড়। এটা ঐতিহাসিক মহাস্থানগড়েরই অংশবিশেষ। এই গড়ের নিচ দিয়েই বয়ে গেছে করতোয়া নদীপুত্র। স্থানীয়রা তার নাম দিয়েছে সুবিল। এই সুবিল এসেছে শিলাদেবীর ঘাট থেকে। শিলাদেবী ছিলেন পরশুরামের বোন। যাকগে সেসব, আজ এখানে এমন ইতিহাস জানতে আসে নি তালহা।

তালহা যখন আম্মুর সঙ্গে গড়ের ওপর এসে দাঁড়াল, তখন আকাশে খণ্ড খণ্ড মেঘ প্যাঁচানো তুলার মতো। আর অদূরের কাশফুলগুলো যেন মেঘের সঙ্গে মিশে গেছে। এমন দৃশ্যে তালহার প্রবল ইচ্ছে জাগে ছবি আঁকবার। পশ্চিম আকাশে সূর্যের আলো ফিকে হয়ে এলে তালহা বলে, আম্মু দেখ দেখ, গঙ্গাফড়িং আর ঘাসফড়িং কীভাবে খেলা করছে। ফড়িং নাকি খুব বুদ্ধিমান। আম্মু ফড়িং আমার বন্ধু হতে পারে না?

আম্মু বলেন, পশুপাখিকে পোষ মানানো যায়, কিন্তু পোকামাকড়, কীটপতঙ্গকে পোষ মানানো যায় কি-না আমার জানা নেই।

কাশবনে দুলে ওঠা হাওয়ায় দুজনেরই মন ভরে ওঠে। এরই মধ্যে তালহা এক পা, দু পা করে এগিয়ে যায় গঙ্গাফড়িং ধরতে। খুব ধীরে ধীরে, নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে যেই-না ফড়িংয়ের ল্যাজটা ধরবে—অমনি ফড়িংটা ফুড়ুত করে উড়ে গিয়ে বসে অন্য কাশফুলে।

ফড়িং ধরার নেশায় চিত্কার দিয়ে পড়ে যেতে থাকে নিচে। অল্পের জন্য সুবিলের পানি থেকে রক্ষা পায়। চিত্কার শুনে আম্মু দ্রুত নিচে নেমে তালহাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। তালহা আলতো করে আম্মুর বাহুডোর  থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, তুমি ঠিকই বলেছ আম্মু। আর যা-ই হোক কীটপতঙ্গের সঙ্গে বন্ধু হয় না। ওই ফড়িংটার জন্যেই তো আমাকে পড়তে হলো।

-----২.-----

সন্ধ্যায় পড়ার টেবিলে এসে বাম হাঁটুতে ব্যথার সঙ্গে জেগে উঠেছে ফড়িংটাকে না-ধরতে পারার কষ্ট। ক্ষোভের সঙ্গে তালহা বলে, ফড়িংয়ের বাচ্চা, ধরতে পারলে বুঝিয়ে দিতাম, আর কেমন মজা দেখাতাম। আজ না হোক অন্য কোনোদিন তোকে নিশ্চয় ধরে ফেলব।

আম্মু তালহার পড়ার টেবিল হরলিক্স দিয়ে যাবার পরপরই কোত্থেকে একটা ফড়িং এসে ভ..র..র... ভ...র...র... ভ...র...র... করে উড়তে থাকে। তখন তার কী আনন্দ! আম্মু আম্মু দেখে যাও, তাড়াতাড়ি আসো, আবার বেরিয়ে যাবে।...

আম্মু দৌড়ে এলে তালহা বলে, আজ বিকেলে কাশবনে যে ফড়িংটাকে ধরতে গিয়ে গড় থেকে পড়ে গিয়েছিলাম ঠিক সেই ফড়িংটাই এসেছে।

ফড়িং আবার বাল্বের চারপাশ দিয়ে উড়তে থাকে ভ..র..র... ভ...র...র... ভ...র...র...।

ফড়িংটা এই মুহূর্তে পড়ে আছে লাইটের ওপরে ঝুলে থাকা হাওয়া চুপসে যাওয়া বেলুনে—বেশ ক’দিন আগে জন্মদিনের জন্য যে বেলুনগুলো ঝোলানো হয়েছিল।

ফড়িংটা পড়ামাত্র দেয়ালের অন্যপাশ থেকে টিকটিকি দ্রুত এগিয়ে আসে বেলুনের দিকে। ক্যা..ট.. ক্যা..ট.. করতে করতে টিকটিকি দুটো বেলুনের কাছাকাছি এলেই ফড়িংটা আবার উড়াল দেয়—ভ..র..র... ভ...র...র... ভ...র...র...।

তালহা ফড়িংটা ধরবার ফন্দি আঁটে। নখ দিয়ে ল্যাজটাকে ধরলে কামড়ে দিলে কেমন ব্যাথা পাবে? ফড়িংয়ের দাঁত কেমন তাও সে জানে না। ভয় পেয়ে নখ দিয়ে না ধরে সুতা দিয়ে ল্যাজটা বাঁধবার পরিকল্পনা করে।

টিকটিকিটা এবার ফড়িংয়ের খুব কাছে চলে এসেছে। তালহা তখন আফসোস করে বলতে থাকে—এই বুঝি ধরেই ফেলল। তাহলে কি ফড়িংটাকে ধরেই ফেলবে?

আবার ফড়িংটা ভ..র..র... ভ...র...র... ভ...র...র... করতে করতে তালহার সাদা খাতার ওপর টপাস করে পড়ে। তালহা ধরতে চায়, সাহস পায় না। ফড়িংটার নড়াচড়া আস্তে করে বন্ধ হয়ে গেলে তার মনটাও ভারী হয়ে ওঠে। সে কারণে বলে—ইস! ফড়িংটা মরে গেল।

আবার চিত্কার করতে থাকে। এবার আম্মু এসে ধমক দিয়ে তালহাকে অন্যঘরে নিয়ে যান। এ মুহূর্তে ফড়িং নিয়ে কোনো কথাই শুনতে চান না আম্মু। শাসনের সুরে বলেন—এমনিতে আজ স্কুলে যাও নি, স্কুল আছে, কাল সকালে উঠতে হবে, ঘুমিয়ে পড়ো।

------৩.------

ঘুমের মধ্যে চিত্কার দিয়ে লাফিয়ে ওঠে তালহা। আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলে, আম্মু তুমি তো বলেছ পশুপাখিকে পোষ মানিয়ে বন্ধু বানানো যায়, কিন্তু কীটপতঙ্গ পোষা যায় না। যে ফড়িংটা আমাদের বাসায় এসেছে সেটা বলল, আমি তোমার বন্ধু হতে এসেছি, বিকেলে কাশবনে আমাকে ধরতে গিয়ে তুমি যে ব্যথা পেয়েছ তার জন্য অনুতাপ প্রকাশ করতে এসেছি। বন্ধুত্ব গড়ার আরো অনেক সব কথা, স্বপ্নে কি এত কথা মনে থাকে!

তালহা যেখানে পড়ছিল সেখানে আম্মুকে টেনে নিয়ে যায়। আম্মু লাইটের সুইচ অন করলে তালহা দেখতে পায় দেয়ালে শত শত পিপড়ার সারি। কতকগুলো পিপড়া ফড়িংয়ের মস্তক, আবার কতকগুলো পাখা, কতকগুলো আবার ফড়িংয়ের ল্যাজ নিয়ে সারিবেঁধে যাচ্ছে। এমন দৃশ্যে কী এক অবর্ণনীয় ব্যথায় তালহার চোখ দুটো টলমল করে, আর ঠোঁট দুটোও থির থির করে কাঁপতে থাকে।

No comments

Powered by Blogger.