শেষ নীল পাহাড়ের ওপারে: পাকিস্তানে আফগান উদ্বাস্তুদের স্মৃতিকথা by ঋশিকা পারদিকার

পাকিস্তানে এক আফগান উদ্বাস্তু, ছবি: ফ্লিকার
১৯৮৮ সালে পেশোয়ারের বাজারগুলোতে ঘুরে ঘুরে হ্যারিয়েট স্যান্ডিস কার্পেট আর বস্ত্রসামগ্রী কিনছিলেন তার লন্ডনের দোকানের জন্য। তখনো তিনি শুনলেন, পশতুদের স্বাধীন আবাসভূমির জন্য ক্লান্তিহীন যোদ্ধা আবদুল গাফফার খান মারা গেছেন। খবর প্রকাশের পরপরই আফগান সরকার চার দিনের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন, মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে বিরতি দেন এবং পেশোয়ারে তার কনস্যুলেটকে নির্দেশ দেয় যে যারা গাফ্ফার খানের জানাজায় অংশ নিতে চায়, তাদের সবাইকে যেন ভিসা দেয়া হয়। সাথে সাথে হ্যারিয়েট আবেদন করেন। আর তখনোই ‘বিয়ন্ড দ্যাট লাস্ট ব্লু মাউন্টেইন- মাই সিল্ক রোড জার্নিস’ লেখার শুরু হলো।
পুরো সফরে তিনি ছোট ছোট নোট নিয়েছিলেন। সেগুলো জড়ো করেই তার বইটি লেখা হয়ে গেল। ২০১৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর যুক্তরাজ্যভিত্তিক মদিনা পাবলিশিং বইটি প্রকাশ করে।
হ্যারিয়েট বেড়ে ওঠেন ইংল্যান্ডের লেক ডিস্ট্রিক্টে। প্রাচ্যে তার প্রথম সফর হয় ১৯৭৭ সালে, তার শৈশবের আর্ট শিক্ষক ম্যারি বারকেটের সাথে। তিনি একটি দল নিয়ে আফাগনিস্তানের বাজার, শহর আর প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলো দেখাতে নিয়ে চললেন। তখন তার বয়স ২৩।
এই সফরই তার জীবনধারা পাল্টে যায় বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন।
আফগানিস্তান দেশটি বৈচিত্র্যে ঠাসা। শুষ্ক মরুভূমি সেখানে আছে, আছে বিশাল বিশাল পর্বত, রয়েছে বর্ণালী সব বাজার। এসব বাজারে যাযাবর আর বণিকেরা কিলিম কার্পেট বিক্রি করে। তিনি যেমনটা প্রত্যাশা করেছিলেন, তার সবই আছে এখানে। আর এর টানেই তিনি তার মা-বাবার স্বপ্নকে জলাঞ্জলি দিয়ে নতুন পথ ধরেন।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসন হয় ১৯৭৯ সালে। এর জের ধরে ১৯৮০-এর দশকে লাখ লাখ আফগান চলে যায় পাকিস্তানে। এদের অনেকেই ছিল বিধবা বা পঙ্গু।
এই সময়ে হ্যারিয়েট ছিলেন পাকিস্তানে। তার সফরসূচির মধ্যে ছিল খাইবার পাসের কাছে কাতচাগুরি উদ্বাস্তু শিবির পরিদর্শন। এখানে প্রায় ৩৩ হাজার উদ্বাস্তু আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেখানে থাকা হাসপাতালের শয্যা ছিল ৪০টি। সবকটিই তরুণ আর শিশুদের ভরা ছিল।
হ্যারিয়েট পাকিস্তানের ওল্ড সিটির বাজারগুলোও সফর করেন। তিনি সেখান থেকে কার্পেট আর এম্ব্রয়েডারি কিনে লন্ডনে বিক্রি করতেন। স্যান্ডিস ওরিয়েন্টাল কার্পেটস নামের দোকানটি ছিল তার মালিকানায়। তবে অর্থ ও মুনাফা পাশে সরিয়ে তিনি যেসব উদ্বাস্তুর সাথে পরিচিত হতেন, তাদের সহায়তা করতে আগ্রহী ছিলেন।
পরিচিত কয়েকজনের মাধ্যমে তিনি আফগান উদ্বাস্তু নারীদের কাছ থেকে এম্ব্রয়ডারি ও কার্পেট কিনে তাদের সহায়তা করার পদ্ধতিটি শিখে নেন। এছাড়া তিনি পেশোয়ারের ফুটপাতগুলো থেকে সালোয়ার কামিজ, আফগান চাপলান, রোপ প্যানিয়ার ইত্যাদিও কিনেছেন।
এর এইসব কাজও তিনি করেছেন যুদ্ধের দামামার মধ্যে। ওই যুদ্ধে লাখ লাখ লোক নিহত হয়। নিহতদের মধ্যে এমন কয়েকজন সাংবাদিক ও ফটোগ্রাফারও ছিলেন, যারা হ্যারিয়েটের সফরে তার সাথে পরিচিত হয়েছিলেন।
তারপর ১৯৯১ সালে হ্যারিয়েট কাবুলে ইকাত সিল্ক বোনার শিল্পটির সন্ধান করেন। খুবই জটিল এই শিল্পটির কেন্দ্র ছিল কাবুলের এমন এলাকায়, যেখানে কোনো কোনো দিন ৪০টিরও বেশি রকেট হানা দিতো। ওই সময় যুদ্ধ করতে সক্ষম এমন প্রতিটি লোককেই কাশালনকিভ কাঁধে নিয়ে রাজপথে ছুটতে দেখা যেত। হ্যারিয়েট যে এলাকায় ছিলেন, তার কাছাকাছি এলাকাগুলোতেও হানা দিত সশস্ত্র ব্যক্তিরা।
তবে এমন বিপদের মধ্যেও আফগানিস্তান আর পাকিস্তান তাকে কাছে টেনেছে। পাকিস্তান আর আফগানিস্তানে তিনি যে উষ্ণ আতিথেয়তা পেয়েছেন, তা ভোলার নয়। তারা তার সাথে তাদের খাবার ভাগ করে খাইয়েছেন। এই যে আন্তরিকতা, তা তিনি পাশ্চাত্যে কখনো পাননি।
আফগানিস্তান থেকে তিনি বসনিয়া-হার্জেগোভিনায় সহায়তা মিশনে গিয়েছিলেন। তার উদ্দেশ্য ছিল স্লাভিক মুসলিম সম্প্রদায়কে সহায়তা করা। সেখানে মুসলিমেরা জাতিগত নির্মূল অভিযানের শিকার হয়েছিল সার্বিয়া আর ক্রোয়েশিয়ার লড়াইয়ে। এরপর আসে সিরিয়া সফর। তারপর তিনি যান সিরিয়ায়।
তবে তার ভাষ্য কেন্দ্রিভূত আফগানিস্তানের বর্ণাঢ্য বাজার আর রাস্তাঘাটের মধ্যে। তার বই যুক্তরাজ্যের বেশ স্বচ্ছল জীবনকে উপেক্ষা করে এক নারীর অনেক সময় একাকী সঙ্ঘাত-জর্জরিত এলাকায় তার অভিযানের কথাই সামনে নিয়ে আসে।
লেখা: ফ্রিল্যান্স সাংবাদিক, বেঙ্গালুরু
বিয়ন্ড দ্যাট লাস্ট ব্লু মাউন্টেইন, হ্যারিয়েট স্যান্ডিস, পেঙ্গুইন র‌্যান্ডম হাউস ইন্ডিয়া, ২০১৭

No comments

Powered by Blogger.