পুরান ঢাকায় ‘লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম’ by শফিক রহমান

খাবারের ঐতিহ্য আর ঐতিহ্যের সঙ্গে খাবার। এই দুইয়ের সম্মিলনে রাজধানী ঢাকার পুরনো শহরের নূর বকস রোডের দুই শতাধিক বছরের পুরনো ‘জমিদার সাহেব বাড়িতে’ চালু হয়েছে ‘লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম’।
উনিশ শতকের মাঝামাঝি ঢাকা ও সোনারগাঁয়ের সাবেক জমিদার মৌলভী আবুল খায়রাত মোহাম্মদের (১৮৫০-১৯৩০) তৈরি করা লাল রঙের দোতলা ঐতিহাসিক ওই বাসভবনে বাঙ্গালীর পারিবারিক আপ্যায়নের আবহ ও পুরনো ঢাকার খাবারের ঘরোয়া স্বাদ নিয়ে এ আয়োজন আবু মোহাম্মদ ইমরানের। যিনি প্রতিনিধিত্ব করছেন আবুল খায়রাতের ষষ্ট প্রজন্মের।
পুরনো ঢাকার বেসরকারি, আধাসরকারি এমনকি সরকারি ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাগুলো যখন একে একে ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে তখন আবু ইমরানের অভিমত ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও প্রদর্শনের পক্ষে। বরাবরই যুক্ত রয়েছেন ‘সেইভ পুরান ঢাকা’ আন্দোলনের সঙ্গে। ‘লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম’ উদ্যোগকেও ওই আন্দোলনের অংশ হিসেবে দেখছেন ইমরান।
ইতোমধ্যে আবু ইমরানের এ আয়োজনে আবুল খায়রাতের সময়ের আর্ট, এন্টিক আর ডাইনিং টেবিলে আতিথেয়তা গ্রহণ করেছেন অনেকে। যাদের মধ্যে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে এ বছরের জানুয়ারির মধ্যে অংশ নিয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপাইনের অতিথিরা।
ইমরান বলেন, “আমার এ আয়োজনের বয়স মাত্র মাস পাঁচেক। কিন্তু আতিথেয়তা এবং আপ্যায়নে আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য দুইশ বছরেরও বেশি। এই বাড়িতে চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ছিলেন তিন মাসের বেশি সময়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই বাড়িতে বসেই লিখেছেন তার বিষের বাঁশি কাব্যের কয়েকটি কবিতা। তারও আগে এই বাড়িতে অসংখ্যবার এসেছেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক (অবিভক্ত বাংলা ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী), মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী (আওয়ামী মুসলিম লীগ ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির-ন্যাপ প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি), হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী (আওয়ামী লীগ নেতা ও পাকিস্তানের ৫ম প্রধানমন্ত্রী), বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ (আওয়ামী লীগ নেতা ও বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি) তৎকালীন নেতারা। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিকথায় এই বাড়িটির কথা উল্লেখ করেছেন। পঞ্চাশের দশকের যুক্তফ্রন্টের কয়েকটি বৈঠক এই বাড়িতেই হয়েছে।”

ইমরানদের পারিবারিক অ্যালবামে ১৯৩৭ সালে তোলা ‘Some Stalwarts of Eastern Bengal’ শিরোনামের একটি ছবিতেও দেখা যায় শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, বিচারপতি স্যার জাহেদ সোহরাওয়ার্দী, স্যার হাসান সোহরাওয়ার্দী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, অধ্যাপক শাহেদ সোহরাওয়ার্দী, ড. সয়ুদ হোসাইন, সৈয়দ আলী আহমদসহ দশ জনকে।
অ্যালবামের ৬৪ নাম্বার ছবিটি এখানে আরও প্রাসঙ্গিক। যার ক্যাপশনে লেখা রয়েছে- Moulana Shawkat Ali entertained at Dacca by Aligarh Old Boys। ছবিটি তোলা হয়েছিল ১৯২১ সালে।
তবে এ যুগে আবুল খায়রাতের পরিবারের ভিন্নধর্মী এ আপ্যায়নের আয়োজনে অংশ নিতে হলে অন্তত একদিন আগে ফোন করতে হবে আপনাকে। দিনে সর্বোচ্চ জায়গা পাবেন ২০ থেকে ২৫ জন। জন প্রতি খরচ কোনভাবেই এক হাজার টাকার ওপরে যাবে না।
ইতোমধ্যে ঢাকাইয়া খাবারের রসালো বর্ননা ও বাড়ির ঠিকানা খুঁজে পাওয়ার বিস্তারিত সব জানিয়ে খোলা হয়েছে ‘Lunch at Emran’s Heritage Home’ ফেসবুক পেজ।
ইমরান বলেন, ‘এ আয়োজনের পুরো কৃতিত্বের অংশিদার আরবান স্টাডি গ্রুপের (ইউএসজি) প্রধান নির্বাহী স্থ্যপতি তাইমুর ইসলাম। যিনি আমাদের পুরনো ঢাকার ইতিহাস ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মসহ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরতে গত ১০/১২ বছর ধরে নিরলসভাবে কাজ করছেন। ঐতিহ্য সংরক্ষণ সংশ্লিষ্ঠ দেশি-বিদেশী পেশাজীবীসহ নানা পেশার পর্যটকদের নিয়ে সপ্তাহে দুই দিন নিয়মিত আয়োজোন করছেন ‘হেরিটেজ ওয়াক’। যার সুবাধেই আবার নতুন করে অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠছে আবুল খায়রাত ও তার পরিবারের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ‘লাঞ্চ এট হেরিটেজ হোম’ এসব অনুপ্রেরণারই ফসল।
প্রসঙ্গত, জমিদার আবুল খায়রাত মোহাম্মদের প্রথম পুরুষ মুন্সী আলম। ইয়েমেনে যার জন্মস্থান। মুন্সী আলমের দুই ছেলের একজন মুন্সী গুল বকস ও আরেকজন মুন্সী নূর বকস। এই নূর বকসেরই ছেলে আবুল খায়রাত মোহাম্মদ। যার দুই ছেলের একজন আবুল হাসনাত ও আরেকজন আবু জাফর জিয়াউল হক ওরফে নাবালক মিয়া। নাবালক মিয়ার ছয় ছেলে ও ছয় মেয়ের মধ্যে এম এ জাহাঙ্গীরেরই ছেলে এ এম ইমরান।
পুরান ঢাকার বেচারাম দেউড়ির ওই বাড়িটির পাশের চারটি সড়কের নাম এই পরিবারের চার সদস্যের নামে- নূর বকস রোড, আবুল খায়রাত রোড, আবুল হাসনাত রোড ও নাবালক মিয়া লেন।

No comments

Powered by Blogger.