ভ্রমণ : শ্রীলঙ্কা ডায়েরি by অশোক কে মেহতা

যে দেশটি ৩০ বছর ধরে নৃশংস যুদ্ধ আর বর্বর সন্ত্রাসবাদে ছারখার হয়েছে, যে দেশটির অন্যতম আলোচিত ঘটনা এক নারী বোমারুর ১৯৯১ সালে রাজীব গান্ধীর প্রাণ সংহার, সেই দেশটি আজ দক্ষিণ এশিয়ার দ্রুত বিকাশমান পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ থেকে পর্যটনে রূপান্তর একদিকে যেমন চমক সৃষ্টিকারী, অন্যদিকে বিস্ময়কর। এক তেল ছাড়া বলা যায় পৃথিবীর প্রায় সব সম্পদেই ভরপুর শ্রীলঙ্কা। বিশেষ করে বিশাল বিশাল বিচের কথা তো না বলেই পারা যায় না। তামিল যুদ্ধের কারণে অবশ্য পর্যটকের আনাগোনা বেশ কমে গিয়েছিল। এমনকি ওই যুদ্ধের মধ্যেই নির্ভীক কয়েকজন জার্মানি আরুগাম বে থেকে ভাকারাই পর্যন্ত পর্যটন ব্যবসার সাথে জড়িত ছিল। এলটিটিই তাদের ধ্বংস করার আগ পর্যন্ত তারা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল।
গত মাসে আমি নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলাম। অর্ধাবৃত্তাকারে ঘুরলাম শ্রীলঙ্কা। কলম্বো-গল-পুতভিল থেকে বাত্তিকোলোয়া-ত্রিনকোমালি-কলম্বো ছুটলাম। পাঁচ দিনে চক্কর দিলাম প্রায় ১,৬০০ কিলোমিটার। ২০০৯ সালের মে মাসে যুদ্ধ বন্ধ হয়। এরপর এক দিনের জন্যও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ঘটেনি। দেশটি পরিণত হয় শান্তির স্বর্গে। মনমুগ্ধকর পরিবেশ, বন্ধুপ্রতীম লোকজন, জিবে পানি আসা খাবার- আর কী চাই। আর সবাই পাওয়া যায় একেবারে অল্প দামে।
ডন্দ্র হেডের কাছে গল হলো শ্রীলঙ্কা সর্বদক্ষিণের প্রান্তভাগ। জায়গাটা অনেকটা উত্তরের পয়েন্ট পেড্রোর মতো। ১৫০৫ সাল পর্তুগিজদের বানানো ক্লক হাউজ আর লাইট হাউজ এখনো শোভা পাচ্ছে। তবে কেবল পর্তুগিজদেরই নয়, ডাচ, ব্রিটিশদের ছোঁয়া এখনো অনুভব করা যায়। সমুদ্র জাদুঘরে তাদের শিল্পকর্মগুলো বেশ যত্নে আছে। ডাচ রিফর্ম চার্চ, গল লাইব্রেরিও মনে ধরার মতো জিনিস। এক সময় হানাদারদের আটকানোর জন্য উপকূলে মোতায়েন ছিল ১৯টি কামান। এখনো সেগুলোর ভগ্নাবশেষ রয়ে গেছে।

প্রায় এক লাখ জাহাজ কাছের পূর্ব-পশ্চিম রুট দিয়ে চলাচল করে। এটা হলো ভারত মহাসাগরের সবচেয়ে ব্যস্ত বাণিজ্যিক রুট। প্রায় পুরো উপকূলই অবকাশকেন্দ্র আর হোটেলে পরিপূর্ণ। সি-সার্ফিং আর ডাইভিংপ্রিয় বিদেশিদের জন্য এটা হলো সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। বর্ষায় টুনা মাছ শিকার আর গল থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে তিমি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র যে কাউকে হাতছানি দেবে বারবার।
আবার গল থেকে ইস্টার্ন প্রভিন্সে সড়কপথটি চমৎকার। দুই মুখো রাস্তাটি চীনা-নির্মিত হাম্বানতোতা বন্দর আর রাজাপাকসে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এখন অবশ্য খুব কমই ব্যবহৃত হয়। রাজাপাকসে যদি তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারতেন, তবে হাম্বানতোতা হয়তো শ্রীলঙ্কার দক্ষিণমুখো রাজধানীতে পরিণত হতে পারতো।
তামিল ইস্টে রয়েছে হিন্দু আর মুসলিমদের আবাস। স্থানটি প্রজাপতি পার্কের জন্য বিখ্যাত। তাছাড়া আছে জেসুইট স্কুল।
অবশ্য এই এলাকায় পর্যটন তেমনভাবে বিকশিত হয়নি। অথচ এখানেও আছে বিশাল বিশাল বিচ। বিশেষ করে কালকুদাহ আর পুস্কুদার কথা বলতেই হয়।

সিডনির পর ত্রিনকোমালি হলো বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বোত্তম প্রাকৃতিক পোতাশ্রয়। এটা ইস্টার্ন প্রভিন্সের রাজধানীও। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যার জন্য সাবেক এলটিটিই মুখ্যমন্ত্রী পিলায়ান এখন জেলে রয়েছেন। এখানে এলে অবশ্যই হারবার ক্রুইজ অবধারিত। আছে নেভি হাউজ, এলিফ্যান্ট পয়েন্ট। এলিফ্যান্ট পয়েন্টে ১২ ইঞ্চির ব্রিটিশ কামানগুলো শত বছরের বেশি সময় ধরে শত্রুদের দূরে রাখছে। ত্রিনকোর উত্তরে রয়েছে নিলাভেলি বিচ। এখানকার জায়গার দাম বিশ্বে সবচেয়ে বেশি। প্রতি ইঞ্চি দাম সোনার মতো।
আর কলম্বোর জন্য গর্ব হয়, দু:খও লাগে। এর সৌন্দর্য হয়তো শিগগিরই হারিয়ে যাবে আকাশচুম্বি সব ভবনের জন্য। একের পর এক দীর্ঘ এপার্টমেন্ট, হোটেল হচ্ছে। এসবের বেশিই তৈরি করছে চীনারা।
শ্রীলঙ্কায় চীনারা সত্যিই বলতে পারে- এলাম, দেখলাম, জয় করলাম।
লেখক : সাবেক জিওসি, আইপিকেএফ সাউথ, প্রায়ই শ্রীলঙ্কা ঘুরে বেড়ান

No comments

Powered by Blogger.