যারা জানে না যুদ্ধ কী: আফগানিস্তানের বিচ্ছিন্ন অংশ

‘তালেবান- ওটা আবার কী’, জিজ্ঞেস করলেন সুলতান বেগম। বেশ লাজুক ভঙ্গিতে। আফগানিস্তানের পার্বত্যময় হিমশীতল ওয়াখান করিডোরে তার বাস। জায়গাটি এতই প্রত্যন্ত যে কয়েক দশকের যুদ্ধে পুরো আফগানিস্তান লণ্ডভণ্ড হয়ে গেলেও সুলতান বেগমের এলাকা তা স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারেনি।
তার পাণ্ডুর মুখে ওই এলাকায় বসবাসকারী প্রায় ১২ হাজার যাযাবর মানুষের কঠিন জীবনযাত্রার ছাপ রয়ে গেছে।
ওখানে বাসকারী লোকজনের কাছে এলাকাটির নাম বাম-ই-দুনিয়া অর্থাৎ ‘পৃথিবীর ছাদ’। পাকিস্তান ও তাকিজিস্তানের সীমান্তবর্তী (চীনও যাওয়া যায় এই করিডোর দিয়ে) পার্বত্যময় ওই এলাকাটি প্রাকৃতিকভাবেই বৈরী এবং অত্যন্ত দুর্গম।
খুব কম লোকই সেখানে যাওয়ার সাহস করে। দুর্গম হওয়ার কারণেই ৪০ বছর ধরে যে যুদ্ধ আফগানিস্তানকে শেষ করে দিচ্ছে, তা সেখানে যেতে পারেনি।
ওয়াখান করিডোরের সুলতার বেগম, ছবি: এএফপি
আর তাই বেগম বলতে পারেন, ‘যুদ্ধ, যুদ্ধ কী? এখানে তো কখনো যুদ্ধ হয়নি।’ গোবরের জ্বালানি দিয়ে আগুনের ওম নিতে নিতে তিনি অবশ্য তাদের লোকজনের হাতে রুশ সৈন্যদের সিগারেট তুলে দেওয়ার কথা স্মরণ করলেন।
কয়েক দশক আগে সোভিয়েত আগ্রাসন ও মার্কিন তহবিলপুষ্ট মুজাহিদদের যুদ্ধের কথা এই এলাকার লোকজন জানে। কিন্তু এরপর তালেবানের উত্থান, তাদের সাথে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধ বেগমের কাছে কিংবদন্তির মতো শোনায়।
বেগমের বড় ছেলে আসকার শাহের কাছে যখন আইএসের কথা বলা হলো তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন। বলেন, ‘বিদেশীরা আমাদের দেশে আক্রমণ করছে?’ আমেরিকা ও তার মিত্ররা ২০০১ সাল থেকে তালেবানের যুদ্ধে যুদ্ধ করছে শুনে অবিশ্বাসের চোখে তাকালেন।
এই এলাকাটি সৃষ্টি করা হয়েছিল ১৯ শতকে। জারতন্ত্রী রাশিয়া ও ব্রিটিশ ভারতের মধ্যে গ্রেট গেম-এ বাফার জোন হিসেবে এর উদ্ভব। তারপর থেকে স্থানটি তেমনই রয়ে গেছে, সরকার বদল হলেও সেখানে কেউ হাত দেয়নি।
ওয়াখি গোত্রের লোকজন, ছবি: এএফপি
আশপাশের দেশগুলো থেকে এই করিডোরে যাওয়া যায়। তবে তা হয় কেবল বন্ধুর পথ বেয়ে। ঘোড়া, ইয়াক বা পায়ে হেঁটে পৃথিবীর অন্যতম উঁচু পাহাড়ি এলাকা ‘পামির নট’ পাড়ি দিয়ে।
আফগানিস্তানের তারা পামিরি নামে পরিচিত। তারা মূলত কিরগিজ উপজাতীয়। আগা খানের অনুসারী উদারবাদী ইসমাইলি মুসলিম তারা। সেখানে মুসলিম নারীরা বোরকা কী জানে না।
তারা অপরাধ, সহিংসতা কী, তাও জানে না। ইয়াক আর গবাদি পশু নিয়েই তাদের জীবন কাটে। ওই এলাকায় সামান্য কয়েকজন ব্যবসায়ী যায়। তাদের কাছ থেকেই তারা প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করে।
ওই এলাকায় নেই বিদ্যুৎ, নেই ইন্টারনেট বা মোবাইল ফোন। ওয়াকি-টাকি নিয়ে ওই বিশাল এলাকা অতিক্রম করা যেতে পারে।
ওই এলাকার লোকজন মাঝে মাঝে রেডিওতে রুশ ভাষার খবর শুনতে পায়। তবে সে সুযোগও খুব বেশি নয়। অনেক ব্যবসায়ী নিয়ে আসেন। তবে ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলে তা আর কাজ করে না।
ওয়াখি গোত্রের লোকজন, ছবি: এএফপি
বছরে ৩০০ দিন সেখানকার তাপমাত্রা থাকে ০ ডিগ্রির কম। চিকিৎসা সুবিধা নেই বলতে গেলে। এমনকি সামান্য ফ্লুতেও জীবন চলে যেতে পারে। জীবনের মতোই মৃত্যু একেবারে স্বাভাবিক ব্যাপার। একটি মাত্র ড্রাগ সেখানে অবাধে পাওয়া যায়। তা হলো আফিম। আর তাতে ওই এলাকার সবাই আসক্ত।
অবশ্য পরিবর্তন আসছে। আফগান সরকার বলছে, তারা বিমান থেকে জরিপ চালাচ্ছে, সেখানে যাওয়ার সহজ কোনো পথ সৃষ্টি করা যায় কিনা তা দেখতে।
চীন ওই এলাকায় একটি সামরিক ঘাঁটি তৈরিতে কাবুলকে সহায়তা করার প্রস্তাব দিয়েছে বলে আফগান কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
তা যদি ফলপ্রসূ হয়, তবে ওই এলাকায় আরো ব্যবসা, পর্যটন, চিকিৎসাসেবা বয়ে আনবে।
তবে যুদ্ধ থেকে তারা যে সুরক্ষা পেয়ে আসছিল, তারও অবসান ঘটবে।
পশু পালন ওয়াখিদের প্রধান জীবীকা, ছবি: এএফপি

No comments

Powered by Blogger.