করাচি: মৃত ভাস্কর্যের সমাজ by জাহরা নাকভি

কল্পনা করে দেখুন তো, তারুণ্যে ভরপুর রানী ভিক্টোরিয়া আপনার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন, আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মুণ্ডুহীন একটি পুরুষের অবয়ব, অনুমান করা যায় যে তিনি হলেন প্রিন্স আলবার্ট? বিচারের অন্ধ দেবী হাত হারিয়ে স্থবির হয়ে গেছেন। আরেক ভদ্রলোকের মাথাটি গড়াগড়ি খাচ্ছে তার পায়ের কাছে। এমন দৃশ্য কোথায় দেখতে পাবেন? করাচিতে। কেএমসি (করাচি মেট্রোপলিটন কর্পোরেশন) গুদামঘর আপনাকে স্বাগত জানাবে মৃত ভাস্কর্যের সমাজে। করাচির পুরনো মহল্লায় আশ্চর্য এসব সামগ্রী থরে থরে সাজানো রয়েছে সবার অগোচরেই।
মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে একটি ভাস্কর্যের ভাঙ্গা মুন্ডু
এসব সামগ্রী দেশটির উপনিবেশ আমলের স্মারক। তবে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের হাতে পড়ে এগুলোর এমন অবস্থা হয়েছে। ভাস্কর্য হলো ইতিহাসের সত্যিকারের একটি অংশ। কিন্তু কুফুরি বিষয় হিসেবে আখ্যায়িত করে এগুলোকে মূল স্থান থেকে তুলে এনে এখানে রাখা হয়েছে।
দৃশ্যত আইয়ুব খানের আমলে মৌলবাদীরা এসব ভাস্কর্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সৌদি বাদশাহ ফয়সালের আগমন আসন্ন হওয়ায় অনৈসলামিক এসব ভাস্কর্য নিশ্চিহ্ন হওয়ার মুখে পড়ে। পরিণতিতে এগুলোকে স্থাপনের স্থান থেকে সরিয়ে আনা হয়। এগুলোর ঠাঁই হয় লরেন্স রোডের এক গুদামঘরে। তবে ভাস্কর্যগুলোর আস্ত আসতে পারেনি, কারো হাত, কারো পা, কারো মুণ্ডু বিসর্জন দিতে হয়েছে।
নিজের চারপাশে অদ্ভুত পরিবেশ দেখছেন রানী ভিক্টোরিয়া, ছবি: আরিফ মাহমুদ
এই মূর্তিগুলোর সন্ধানেই আমার এখানে আসা। আমার উপস্থিতির সময় কেডব্লিউএসবি (করাচি ওয়াটার এন্ড স্যুয়েরেজ বোর্ড)-র কাজ করছিল পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। এসব মূর্তির প্রতি আগ্রহ এসব লোক খুব একটা ভালো চোখে দেখেনি। যেখানে মূর্তিগুলো রাখা ছিল, সেখানে যাওয়ার পথ পাচ্ছিলাম না। তারাও বলতে পারছিল না। আমি একটি ঘরে নক করলে একজন বের হয়ে এলেন। যে লোকটি বের হয়ে এলেন, প্রথমে তাকে ইতস্তত করতে দেখা গেলেও তিনি একটি ব্যবস্থা করলেন। টেবিল আর চেয়ার পেতে উঁকি দিয়ে প্রাচীরঘেরা স্থানে রাখা ভাস্কর্যগুলো দেখার ব্যবস্থা করে দিলেন। প্রাচীরে দরজা বা অন্য কোনো ফাঁকা স্থান নেই, যেখান দিয়ে সেখানে সরাসরি যাওয়া যায়। আর এভাবেই দেখা হলো এক রোমান যোদ্ধা, একটি অ্যাঞ্জেল, এক ইংরেজ সিপাহিকে।
এক পরিচ্ছন্নতা কর্মী বললেন, আমি এসব কোয়ার্টারে ১৫ বছর ধরে বাস করছি। শুরু থেকেই ভাস্কর্যগুলোকে এভাবেই দেখে আসছি।
দুর্দশাকবলিত কুমারীরা
ভাস্কর্যগুলোর প্রকৃত বয়স জানার উপায় নেই। তবে এগুলো নিয়ে টুকটাক যেসব লেখা হয়েছে, তাতে করে মনে হয়, এগুলো অন্তত ৮০ থেকে ৯০ বছরের পুরনো। ধারণা করা যেতে পারে রানী ভিক্টোরিয়া ও রোমান্টিক ইংরেজ রমনীর ভাস্কর্যটি পাশের ফ্রেয়ের হল থেকে আনা হয়েছে। এই হলটি নির্মাণ করা হয়েছিল ১৮৭০-এর দশকে। ফলে ভাস্কর্যের বয়সও তেমন হবে অনুমান করা যেতে পারে। সম্ভবত স্থানীয় হিন্দু কারিগরেরাই এগুলো গড়েছিল। তারা এ ব্যাপারে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিল। এখন মুণ্ডুহীন অবস্থায় থাকা বিশাল অবয়বের প্রিন্স অ্যালবার্টের ভাস্কর্যটি একসময়ের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড আলবার্ট ন্যাচারাল হিস্টরি মিউজিয়ামে ছিল।
মহাত্মা গান্ধী একসময় ছিলেন করাচি হাই কোর্ট ভবনে। তিনি এখন পুরোপুরি অদৃশ্য হয়ে গেছেন। করাচি পোলো গ্রাউন্ডে থাকা অতিকায় কালো গ্রানাইটের নেলসন মনুমেন্টের অবস্থাও একই হয়েছে। জুলফিকার আলী ভু্ট্টোর আমলে সব স্টোন ব্লকের লেখা মুছে ফেলা হয়। এটির নতুন নাম দেয়া হয় শেরপাও পার্ক।
কেএমসির সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড কালচারাল বিভাগের পরিচালক সাইফর রাহমান গ্রামি বলেন, এসব ভাস্কর্য পুনর্বাসনের একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে তার বিভাগের পক্ষ থেকে। প্রস্তাব অনুযায়ী, এগুলো বার্ন হল গার্ডেন্সের চারপাশে স্থাপন করা হবে। আর কেউ যদি মনে করে, এসব ভাস্কর্য ইসলামের খেলাপ হবে, তবে প্রদর্শন সীমিত করা যেতে পারে। বিদেশী পর্যটকেরা এদিকে আকৃষ্ট হতে পারে। তবে এ ধরনের আরো অনেক প্রস্তাবের মতো, এটিও লাল ফিতায় আটকে আছে।
মুণ্ডু হারিয়েও দাঁড়িয়ে আছেন প্রিন্স এলবার্ট
তবে এগুলো পুনঃস্থাপনের কাজটি সহজ হবে না। ইসলামবিরোধী বিবেচনা করার মানুষের অভাব নেই করাচিতে। তারা এগুলোকে স্থাপনের কাজটি সহজে মেনে নেবে না। আবার কর্তৃপক্ষও তাদেরকে রাজি করাতে বা ক্ষুব্ধ করার কাজটি করার প্রয়োজন বোধ করবে না। উগ্রবাদীদের আন্দোলনের মুখে পড়তে চায় কে?
আবার কোনো কোনো মহল ভাস্কর্য প্রদর্শনীর দিকে আগ্রহী হলেও তাদের চোখও এদিকে পড়ে না।
আরেকটি বিষয়ও আছে। এগুলোকে অনেকেই দেশপ্রেম-বহির্ভূত বিষয় মনে করে। ফলে এগুলো স্থাপনের বিরুদ্ধে একদিকে ধর্মীয় বাধা আছে, একইসাথে আছে দেশপ্রেম ভাবাবেগ।
অর্থাৎ প্রভাব বিস্তার করতে পারে, এমন কোনো মহলই এসব ভাস্কর্যের ব্যাপারে আগ্রহী নয়।
ফলে এখানেই হয়তো তাদের স্থান নির্ধারিত হয়ে থাকবে। এসব মহান লোক লোকচক্ষুর আড়ালেই তাদের করুণ অবস্থা লুকিয়ে রাখবে।
মার্জিত ভঙ্গীতে দাঁড়িয়ে আছে দুই ক্লাসিক্যাল সুন্দরী

No comments

Powered by Blogger.