রাশিয়ার জার সাম্রাজ্যের ইতিকথা

রাশিয়ার ইতিহাসের কথা চিন্তা করলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে ১৯১৭ সালের বলশেভিক বিপ্লবের কথা, যেখানে বিপ্লবীরা একনায়ক স্বৈরাচারী জার সরকারের পতন ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের পত্তন করে। আমাদের মধ্যে এই জার সম্পর্কে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কেউ কেউ জানেন যে জার ছিল একজন ব্যক্তি, আবার যারা আর একটু ভাল জানে তাদের আবার অনেকেই জানে না জার সাম্রাজ্যের পেছনের ইতিহাস। আর গতানুগতিক ধারার  ইতিহাসেও শেষের কয়েকজন ছাড়া বাকিদের বর্ণনা তেমনটা নাই বললেই চলে। আজকের পর্বে পাঠকদের জার সাম্রাজ্যের আদ্যোপান্ত জানানোর জন্যই এই আয়োজন।
সুপ্রিয় পাঠক চলুন তাহলে যাওয়া যাক মুল আলোচনায়-প্রায় ত্রয়োদশ শতকের গোঁড়ার দিক হতেই রাশিয়ান অঞ্চলে মঙ্গোলদের দৌরত্ব বেড়ে যায়। মঙ্গোল সম্রাট বাতু খানের হাতে রাশিয়ান শাসক তাদের গুরুত্বপূর্ন অঞ্চল হারায়। ফলে তাদের ক্ষমতা হ্রাস পেতে থাকে, একপর্যায়ে তাদের নিজস্ব প্রভাবাধীন অত্যন্ত সংকীর্ণ হয়ে পরে। তাদের একের পর এক শাসক পরিবর্তন হয় কিন্ত তাদের অবস্থার কোন উন্নতি হয় নি। কিন্তু পঞ্চদশ শতকের শেষের দিকে গ্র্যান্ড ডিউক ইভান তাতারদের বিতাড়িত করে এবং রাশিয়ার সীমানা সম্প্রসারিত করে। তার পরবর্তী সময়ে ১৫০৩ সালে ক্ষমতায় আসেন ভ্যাসেল ৩। তার সময়ে মস্কো আয়তন ও ক্ষমতায় আরো প্রভাবশালী হয়ে উঠে। তারপর ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে তৃতীয় ইভান আর এই ইভানই প্রবর্তন করেন জার সাম্রাজ্যের। ‘জার’ শব্দের বাংলা অর্থ হল সম্রাট। ১৫৪৭ সালে তৃতীয় ইভান নিজেকে জার (সম্রাট) হিসেবে ঘোষণা করেন। তার পরবর্তী সময়ের শাসকগণ তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে জার উপাধি গ্রহণ করে ফলে তাদের শাসক বংশই ইতিহাসে জার হিসেবে জায়গা দখল করে নেয়।
জারদের প্রতিষ্ঠাতা ইভান
জারদের প্রতিষ্ঠাতা ইভান 
জারদের ক্ষমতায় আসার পটভূমি
জারদের প্রতিষ্ঠাতা তৃতীয় ইভান ক্ষমতা গ্রহণের পর রাজ্য সীমা সম্প্রসারণে মননিবেশ করেন। তিনি মঙ্গোলদের অধিকৃত অঞ্চলে মস্কোর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি রণকৌশলের মাধ্যমে সুইডিশ ও পলিশদের পরাজিত করেন। এবং মস্কোকে আধুনিক করে গড়ে তোলেন। তিনি ১৫৮১ সালে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পূর্বে সাইবেরিয়া ও ইউরোপে তার আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে যান। তার পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসেন ফিউডর। এবং তার ক্ষমতার স্থায়িত্বকাল হয় ১৫৯৮ পর্যন্ত। ফিউডর ততটা সফল শাসক ছিলেন না। তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন ১ম বরিস তিনিও অপেক্ষাকৃত দুর্বল শাসক ছিলেন। তিনি ১৬০৫ সালে মৃত্যুবরণ করলে ক্ষমতায় আসেন তার নাবালক পুত্র ২য় ফিউডর। কিন্ত তাকে দুর্বৃত্তরা হত্যা করলে জার সাম্রাজ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পরে। উত্তপ্ত এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতায় আসেন ২য় দীমিত্রী । কিন্ত তিনিও সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন পরিস্থিতি মোকাবেলায়। ফলে সমগ্র রাশিয়া জুরে ছড়িয়ে পরে অর্থনৈতিক মন্দা, দেখা দেয় খাদ্য সঙ্কট, সর্বত্র ছড়িয়ে পরে হানাহানি, মারামারি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ ও নানা ধরনের রোগ, এর উপরে আবার পার্শ্ববর্তী শাসকদের আক্রমণ, ফলে পরিস্থিতি চলে শাসকের নিয়ন্ত্রণের বাহিরে। এরকম পরিস্থিতিতে প্রিন্স পুজারস্কি ও কোজমানিনের নেতৃত্বে ১৬১২ সালে গড়ে উঠে জাতীয় ঐক্য। এবং পলিশ সৈন্যদের দমন করেন।
তার পরবর্তীতে রুশরা সকল জাতির মতামতের ভিত্তিতে নতুন শাসক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন যে, রাশিয়া ছিল তখন বহু জাতি-ধর্মের মানুষের মিশ্রিত রাষ্ট্র। তাই সকল জাতির মতামতের ভিত্তিতে ১৬১৩ সালে শাসক হিসেবে নির্বাচিত হন রোমানব বংশের ১৬ বছর বয়সী তরুণ মিখাঈল রোমানব। আর এই রোমানবরাই ১৬১৩-১৯১৭ পর্যন্ত দীর্ঘ ৩০৪ বছর শাসনকার্য পরিচালনা করেন।
জারদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মিখাঈল।
জারদের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা মিখাঈল
মিখাঈল রোমানব (১৬১৩-৪৫)
মিখাঈল রোমানব বা ১ম মিখাইল ১৬১৩ সালে নির্বাচিতভাবে প্রথম জার হিসেবে শাসন ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি রাশিয়ার সামগ্রিক অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন। পোল্যান্ডসহ অন্যান্য শত্রু রাষ্ট্রের সাথে বিরোধের মীমাংসা করেন। সেনাবাহিনীকে সুসংহত করেন, সেনাবাহিনীকে কয়েকটি ডিভিশনে ভাগ করেন ও পদবি নির্ধারণ করেন। শাসন ব্যবস্থাকে আরো সুসংহত করার জন্য তিনি সমগ্র রাষ্ট্রকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেন। এবং সেখানে শাসক নিয়োগ করেন। প্রশাসন পরিচালনার জন্য আমলাদের নিয়োগ দান করেন। সর্বোপরি তিনি একজন দক্ষ প্রশাসক ও শাসক হিসেবে সুনাম অর্জন করেন। এই মহান শাসক ১৬৪৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
আলেক্সিস (১৬৪৫-৭৬)
১ম মিখাঈলেরর মৃত্যুর পর তার পুত্র ১ম আলেক্সিস ক্ষমতায় আসেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ রদবদল করেন। তিনি ক্ষমতায় আসার পর সুবর্নয়া ইলজানিয়া নামে একটি আইন প্রণয়ন করেন যার ফলে তৎকালীন ৮০% কৃষক ভূমি দাসে পরিণত হয়। আর এই অবস্থা চলে বংশানুক্রমিক অর্থাৎ দাসের ছেলে দাস হবে। কেউ চাইলেও তার অবস্থান পরিবর্তন করতে পারত না। তারা সকল প্রকার মানবিক অধিকার বঞ্চিত ছিল। আলেক্সিসের এই অবৈধ আইনকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে এই হীন ব্যবস্থার পক্ষে খ্রিষ্টান চার্চরা তাদের অবস্থান গ্রহণ করেন। ফলে এটি সমাজ স্বীকৃতি পেয়ে যায়। এবং শুরু হয় জারদের অমানুষিক শাসনের পালা যা পরবর্তী ২০০ বছর পর্যন্ত বজায় থাকে। আলেক্সিস পলিশ ও লিথুনিয়ার বিরুদ্ধে জয় লাভ করলে রাশিয়ার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। তাই রাশিয়া ইউক্রেন দখল করে নেয়। আলেক্সিসের অপশাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি তা কঠোর হস্তে দমন করেন। এবং বিদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ১৬৭৬ সালে আলেক্সিস মৃত্যু বরন করেন।
আলেক্সিস পরবর্তী দুর্বল শাসকগণ (১৬৭৬-৮৯)
আলেক্সিসের মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তৃতীয় ফিউডার। তিনি ১৬৭৬ থেকে ১৬৮২ সাল পর্যন্ত শাসন করে মাত্র ১৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তার সময়ে সাম্রাজ্যে বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি তা কঠোর হস্তে দমন করেন।
তার মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তার বোন সোফিয়া। সোফিয়া তার অপর দুই ভাই পঞ্চম ইভান ও ১ম পিটারের সহায়তায় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তার সময়ে দীর্ঘ দিনের বিরোধী শক্তি পলিশ ও লিথুনিয়াদের সাথে শান্তি চুক্তি করা হয়। এবং তুর্কি বিরোধী জোটে যোগদানসহ চীনের সাথে পারস্পরিক সহায়তা চুক্তি হয়। সোফিয়ার শাসন ক্ষমতা ১৬৮৯ পর্যন্ত স্থায়ী হয়।
প্রথম পিটার
প্রথম পিটার
প্রথম পিটার (১৬৮২-১৭২১)  
মূলত তার বোন সোফিয়ার সাথে সাথেই পিটারের শাসন কাল শুরু হয়। কারণ দুইজন দুই অঞ্চলের দায়িত্বে থাকলেও সোফিয়ার সকল কাজেই পিটার সাহায্য করতেন। কিন্ত ১৬৮৯ সালের পর সরাসরি সকল ক্ষমতার একক কেন্দ্র হন পিটার। তিনি ইউরোপের পক্ষ নিয়ে তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। তিনি রাশিয়াকে ইউরোপীয় ভাবধারায় নিয়ে আসেন। তার সময়ে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও স্থাপত্য কলার ব্যাপক প্রসার লাভ করে। এবং ইউরোপের সাথে পাল্লা দিয়ে শিল্পকারখানার উন্নয়ন করেন। পোশাক পরিচ্ছদের ব্যাপারেও তিনি উদার নীতি গ্রহণ করেন। তার সময়ে নৌবাহিনীর উত্থান ও আধুনিকায়ন সূচিত হয়। তার সময়ে ২য় নার্ভার যুদ্ধ সংঘটিত হয় ও তাতে রাশিয়ানরা জয়লাভ করে। পিটার তার নামানুসারে তার রাজধানী সেন্ট পিটাসবার্গে স্থাপন করেন। এবং সেখানে বড় বড় প্রাসাদ নির্মাণ করেন যা তাকে অনন্য মর্যাদা দান করেছে। সর্বোপরি পিটার এ অঞ্চলের অন্যতম শক্তিধর শাসক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। ১৭২১ সালে সে নিজেকে “পিটার দ্যা গ্রেট” ও জাতীর পিতা হিসেবে ঘোষণা করেন। পিটার দ্যা গ্রেট ১৭২৫ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
পিটারের পরবর্তী শাসকগণ (১৭২৫-১৮০১)
পিটারের পরবর্তী শাসকগণ ছিলেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল তাদের সময় বড় ধরনের কোন পরিবর্তন সূচিত হয়নি। পিটারের পর ক্ষমতায় আসেন তার স্ত্রী ১ম ক্যাথরিন । ক্যাথরিন বেশীদিন ক্ষমতা ভোগ করতে পারেন নি। তিনি ১৭২৫-২৭ পর্যন্ত মাত্র ২বছর ক্ষমতায় ছিলেন।
তার পর ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র ২য় পিটার। পিটারও খুব বেশি সফল ছিলেন না। তিনি মাত্র ১৪ বছর বয়সে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ফলে তার শাসনকাল দীর্ঘ হয়নি। তিনি মাত্র ৩ বছর ক্ষমতায় আসীন ছিলেন। অর্থাৎ ১৭৩০ সালে তিনি ক্ষমতা থকে অপসারিত হন।
তার পরবর্তীতে ক্ষমতায় আসেন তার চাচাতো বোন এনা। এনা ১৭৩০-১৭৪০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তিনি তার জার্মান প্রেমিক দ্বারা প্রভাবিত হন। এবং রাশিয়াকে ইউরোপীয় ভাবধারায় এগিয়ে নেয়ার জন্য ব্রতী হন। তার সময়ে রাশিয়ান প্রশাসন ড্যানিশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পরে।
এনার পর ১৭৪০ সালে ক্ষমতায় আসেন ৬ষ্ঠ ইভান। কিন্ত তিনি সিংহাসন সুসংহত করতে পারেন নি। মাত্র ১ বছর ক্ষমতায় থেকে ১৭৪১ সালে তার মেয়ের হাতে নিহত ও ক্ষমতাচ্যুত হন।
ইভানের পর ক্ষমতায় আসেন এলিজাবেথ। তার ছিল বেশ কয়েকজন যুবক প্রেমিক তা সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একজন দক্ষ শাসক। তার সময়ে ফ্রান্স ও অস্ট্রিয়ার সাথে রাশিয়ার জোট গড়ে উঠে। তিনি প্রুয়েশিয়ার সাথে দীর্ঘ সাত বছর যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তার সময়ে সেন্ট পিটারসবার্গের বিখ্যাত উইন্টার প্যালেসের কাজ সমাপ্ত হয়। ১৭৬২ সালে তিনি পিটারসবার্গে মৃত্যুবরণ করেন।
এলিজাবেথের পর ক্ষমতায় আসেন ২য় ক্যাথরিন। তিনি ১৭৬২-৯৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। তার ক্ষমতায় আসার পূর্বে তার স্বামী অল্প কিছুদিন ক্ষমতায় ছিলেন।
১ম পিটারের পরবর্তীতে রাশিয়ার সিংহাসন দীর্ঘদিন ধরে ঐরকম যোগ্য শাসকের অভাব বোধ করছিল। আর সেই শূন্যতা পূরণ করার জন্যই আবির্ভাব হয় ২য় ক্যাথরিনের। ক্যাথরিনও পিটারের মতই “দ্যা গ্রেট” উপাধি ধারণ করেন। তিনি ছিলেন ফ্রেঞ্চের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তিনি ক্ষমতায় আরোহণের পর ১ম পিটারের অসমাপ্ত কাজকে এগিয়ে নেয়ার অগ্রপথিক হিসেবে কাজ করেন। তার সময়ে প্রদেশগুলোর উপর কেন্দ্রের শক্ত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। রাশিয়ার সীমানা পূর্ব ইউরোপ থেকে মধ্যে ইউরোপ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়। সর্বোপরি সমগ্র ইউরোপে প্রভাবশালী একজন শাসক হিসেবে তার নাম প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তার সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে ব্যাপক উন্নতি লাভ করে। বিশেষ করে চিত্রকলা ও স্থাপত্য শিল্পে প্রভুত্ব উন্নতি সাধিত হয়। তার সময়ে রাশিয়ায় প্রথম জাদুঘর স্থাপিত হয়। কিন্ত ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব হলে তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েন। এবং উদারনীতির শাসন প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। ১৭৯৬ সালের মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত প্রজারঞ্জক বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। তিনি দাসদের প্রতি কিছু নরম নীতি গ্রহন করেন। এই মহীয়সী শাসক ১৭৯৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
২য় ক্যাথরিনের পর ক্ষমতায় আসেন তার পুত্র ১ম পল। পল ছিলেন সামরিক নিয়মকানুনে অতিমাত্রায় আচ্ছন্ন। তাই তিনি তার মায়ের সকল কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা শুরু করে দেন। তার নেতৃত্বে রাশিয়া যোগ দেয় ইউরোপীয় জোটে এবং ফরাসি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। কিন্ত এই যুদ্ধে রাশিয়ান বাহিনী পরাস্ত হয়। ১৮০১ সালে তিনি দুর্বৃত্তদের হাতে তার প্রাসাদেই নিহত হন।
প্রথম আলেকজান্ডার (১৮০১-২৫) 
পলের পর ক্ষমতায় আসেন তার ২৩ বছর বয়সী পুত্র ১ম আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার তার প্রপিতামাহী ক্যাথরিনকে তার শাসনের আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। এবং আধুনিক রাশিয়া গড়ার প্রত্যয় নিয়ে আগাতে থাকে। তার উপদেষ্টা হিসেবে মেধাবী মিখাঈলকে নিয়োগ করা হয় এবং তার নেতৃত্বে রাশিয়ার অর্থনীতি পুনর্ঘটিত হয় ও উদারনৈতিক সংবিধান প্রণয়ন করা হয়।
এসময়ে ফ্রান্সে নেপোলিয়নের আবির্ভাব হয়। ফলে নেপোলিয়ন রাশিয়ার সাথে যুদ্ধে জরিয়ে পরে। নেপোলিয়ন রাশিয়ার বন্ধু রাষ্ট্র অষ্ট্রিয়া ও ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। কিন্ত ১৮০৭ সালে উভয়ের মধ্যে শান্তি চুক্তি স্থাপিত হয়। তার মধ্যবর্তী সময়ে রাশিয়া সুইডেন ও ফিনল্যান্ড আক্রমণ করে। ফলে নেপোলিয়নও ১৮১২ সালে পুনরায় রাশিয়াকে আক্রমণ করে। এতে ফ্রান্স ও রাশিয়ার মধ্যে ইতিহাসের অন্যতম রক্তাক্ত যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এতে রাশিয়া পরাজিত হয় কিন্ত তার সেনাবাহিনী অক্ষত থাকে। নেপোলিয়ন ব্রিটেন ও পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রদের দ্বারা পরাজিত হলে রাশিয়াও শত্রু মুক্ত হয়। ফলে রাশিয়া আরো শক্তিশালী হয়ে উঠে। তাই রাশিয়া পোল্যান্ড, লিথুনিয়া, চেচনিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া দখল করে নেয়। এবং এ অঞ্চল হতে অটোমানদের বিতাড়িত করে। ফলে সমগ্র ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ার একক আধিপত্য গড়ে উঠে। সর্বোপরি রাশিয়ার প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পায়। ১৮২৫ সালে আলেকজান্ডার মৃত্যুবরণ করলে তার শাসনাবসান হয়।
প্রথম আলেকজেন্ডার
প্রথম আলেকজেন্ডার।
প্রথম নিকোলাস (১৮২৫-৫৫)
প্রথম আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ১৮২৫ সালে ক্ষমতায় আসেন তার ভাই প্রথম নিকোলাস। তার ক্ষমতা আরোহণকালে রাশিয়া ছিল ইউরোপীয় ভাবধারায় প্রতিষ্ঠিত ও সুসংঘটিত সেনাবাহিনী সমৃদ্ধ একটি রাষ্ট্র। যেসকল সেনাবাহিনী নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল তাদের প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশী। ফলে এসকল সেনাবাহিনী ১ম নিকোলাস কে সহজভাবে মেনে নেয়নি। সুতরাং তারা সিক্রেট সোসাইটির মাধ্যমে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে ও সেনাঅভ্যূত্থান করে। নিকোলাস তা কঠোর হস্তে দমন করেন। এবং নেতৃত্বদানকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেন ও বাকিদের নির্বাসন দেয়া হয়। তিনি রাষ্ট্রীয় মূলনীতিকে তিনটি স্লোগানে আবদ্ধ করেন যথা– “অর্থোডক্স,একনায়কতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ”। সুতরাং তিনি রাষ্ট্রকে প্রতিষ্ঠা করেন- চার্চ, জার ও রাশিয়ান জাতীয়তাবাদের উপর।
ককেশাস সীমান্ত সমস্যা নিয়ে পার্সিয়ানদের সাথে সমস্যা দেখা দিলে রাশিয়ার সাথে তুর্কি অটোমানরা জরিয়ে যায়। কারণ তখন পার্সিয়া অটোমানদের অধীনে ছিল। এ যুদ্ধের ফলে পার্সিয়া তার বৃহৎ সীমানা হারায় ও জরিমানা দিতে হয়। তার সময়েই রাশিয়ান সমর্থনে গ্রিস স্বাধীনতা লাভ করে। ১৮৫৪ সালে খ্রিষ্টান নেতৃত্ব হস্তান্তরকে কেন্দ্র করে রাশিয়া পুনরায় অটোমানদের সাথে বিরোধে জরিয়ে পরে। রাশিয়া অন্যায়ভাবে মালদাবিয়া ও ওলেসিয়া দখল করে নেয় যা ছিল অটোমানদের অধীনে। ফলে রাশিয়া ও তুর্কিদের মধ্যে সংঘটিত হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। এ যুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের সহায়তায় রাশিয়া জয় লাভ করে ও তুর্কিরা পরাজয় বরন করে অধিকৃত অঞ্চল ছেড়ে দেয়। তার সময়ে রেল ব্যবস্থার সম্প্রসারণ হয়। ১৮৫৫ সালে তার মৃত্যু হলে নিকোলাসের শাসনাবসান হয়।
দ্বিতীয় আলেকজান্ডার (১৮৫৫-৮১)
১ম নিকোলাসের মৃত্যুর পর ১৮৫৫ সালে ক্ষমতায় আসেন দ্বিতীয় আলেকজান্ডার। তিনি ক্ষমতায় আসর পর শাসনকার্য শুরু করেন অত্যন্ত চমকপ্রদভাবে। ১ম নিকোলাসের দ্বারা নির্বাসিত ডিসেম্বিষ্ট বিদ্রোহীদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনেন ও অন্যান্য বন্দিদের মুক্ত করে দেন। আলেকজান্ডারের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল সার্ফ প্রথা বাতিল করা। তার পূর্ববর্তী সময়ে রাশিয়ার ৬০ ভাগের বেশি মানুষ ছিল সার্ফ। অর্থাৎ তাদের নূন্যতম মানবিক অধিকারও ছিল না। সার্ফরা ছিল তার মনিবের আজ্ঞাবহ। সার্ফ প্রথার উচ্ছেদ করার সাথে জমির উপর থেকে জমিদারদের দখলদারিত্বেরও অবসান হয়। কৃষকদের ঋণ দেয়া হয় যাতে তারা জমি ক্রয় করতে পারে। তিনি প্রদেশ গুলোতে প্রতিনিধিত্বমুলক শাসন ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে আলাদা করেন। যদিও তার এই সার্ফ প্রথা বাতিল ও অন্যান্য সংস্কারের মধ্যে কিছু ত্রুটি ছিল। কিন্ত এটি নিঃসন্দেহে বলা যায় তার উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃত অর্থেই জনকল্যাণকার। ১৮৮১ সালে তাকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়।
তৃতীয় আলেকজান্ডার (১৮৮১-৯৪)
২য় আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ১৮৮১ সালে ক্ষমতায় আসেন ৩য় আলেকজান্ডার। ক্ষমতায় আসার পর তিনি প্রতিক্রিয়াশীল নীতি গ্রহণ করেন। তার পিতা যেহেতু নিলিষ্টদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। তাই তিনি নিলিষ্টদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করেন এবং তাদের বন্দি করেন। নিলিষ্টরা ছিল শিক্ষিত উদারপন্থী ও সংস্কারমনা তারা জারদের পতন ও তৎস্থলে উদারনৈতিক শাসকের জন্য লড়াই করছিল। আলেকজান্ডার শিক্ষাব্যবস্থাকে অতিমাত্রায় সরকারী করন করেন। কৃষকদের জোর পূর্বক সামন্তপ্রভূদের হয়ে কাজ করতে বাধ্য করেন। এবং সংবাদপত্রের উপর নজরদারি আরোপ করেন। তার সময়ে বাণিজ্যে ও রেল ব্যবস্থার কিছু উন্নতি হয়। তিনি অতিমাত্রায় রুশিকরণ নীতি গ্রহণ করেন। অন্যজাতির বিরুদ্ধে আগ্রাসী নীতি গ্রহণ করেন। ফলে জনগণ বিদ্রোহী হয়ে যান। এবং এলাকা ভিত্তিক সমিতি গড়ে তোলেন। ফলে ধীরে ধীরে নিবিষ্টরা সংঘটিত হয়ে যায়। ১৮৯৪ সালে ৩য় আলেকজান্ডার এই নিলিষ্টদের হাতেই নিহত হন।
২য় নিকোলাস
২য় নিকোলাস
দ্বিতীয় নিকোলাস (১৮৯৪-১৯১৭)
১৮৯৪ সালে ৩য় আলেকজান্ডারের পর ক্ষমতায় আসেন ২য় নিকোলাস। তিনি ছিলেন অপেক্ষাকৃত দুর্বল শাসক তাই তিনি তার স্ত্রী জারিনা ও রাজপুতিন নামে একজন উপদেষ্টার উপর নির্ভরশীল হয়ে পরেন। তিনিও ছিলেন রক্ষণশীল ও রুশীকরণ নীতির ধারক ফলে অন্যান্য জাতি বিদ্রোহী হয়ে পরে। তার সময়ে রাশিয়ান সমাজ ছিল অতি মাত্রায় সমস্যাপূর্ন কারণ অভিজাত শ্রেণীরাই সর্বময় ক্ষমতার মালিক ছিলেন। ২য় আলেকজান্ডারের সময়ে সার্ফ প্রথার উচ্ছেদ করলেও মীর নামক গ্রাম সমিতির জন্য তা ত্রুটিপূর্ন থেকে যায়। ফলে ২য় নিকোলাসের সময় তা আরো তীব্র আকার ধারণ করে। অন্যদিকে শিল্প সমাজের উত্থান হওয়ায় শ্রমিক শ্রেণী সেখানেও বঞ্চনার স্বীকার হয়। ফলে সর্বত্র বিদ্রোহ দানা বাধে।
১৯০৫ সালে রুশ-জাপান যুদ্ধে রুশরা পরাজিত হলে নিকোলাসের দুর্বলতা সামনে চলে আসে। এবং রাজ্যের সর্বত্র অভাব অনটন, দুর্দশা দেখা দিলে ১১ মার্চ শ্রমিক-কৃষক শ্রেণী ফাদার গ্যাপনের নেতৃত্বে জারের উইন্টার প্যালেসের দিকে অগ্রসর হন। তাদের এ শোভাযাত্রায় সেনাবাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে হাজার হাজার লোক নিহত হয়। ইতিহাসে এইদিনটি “ব্লাডি সানডে” পরিচিত। ফলে নিকোলাস অনেকটা কোণঠাসা হয়ে পরেন। তাই ১৯০৬ সালে প্রথম ডুমার অধিবেশন আহবান করেন। ফলে ডুমায় সীমিত পরিসরে জনপ্রতিনিধি যায়। এবং সেখানে তারা সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে কথা বলার সুযোগ পায়। কিন্ত প্রধান সমস্যা ছিল এটি যে সেখানকার অধিকাংশ প্রতিনিধিই ছিল জারের আজ্ঞাবহ।
১৯১৪ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রাশিয়া তাতে যোগদান করে। কিন্ত জার্মানির বিরুদ্ধে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে ব্যাপক সৈনিকের প্রাণহানি ব্যতীত রাশিয়া কোন সফলতা লাভ করতে পারেনি। অপরদিকে জার্মানিতে দেখা দেয় চরম দুঃখ-দুর্দশা খাদ্য সংকট ও শ্রমিক অসন্তোষ ফলে বিদ্রোহ দানা বাধে। তাই ১১ ই মার্চ ১৯১৭ ব্লাডি সানডের ১২তম দিবসে হাজার হাজার কৃষক-শ্রমিক রাস্তায় নেমে আসে। ফলে শুরু হয় জায়গায় জায়গায় খণ্ডযুদ্ধ। জার তার সেনাবাহিনীকে বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে নির্দেশ দিলে তারা জারের কথা অমান্য করে বিপ্লবীদের পক্ষ গ্রহণ করে। ফলে জার ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়। এবং বিপ্লবীরা ক্ষমতা দখল করে।
আর এভাবেই পতন হয় দীর্ঘকালের শাসনকারী জার সাম্রাজ্যের। বিপ্লবীদের মধ্যে হতে প্রতিনিধি নিয়ে ঘটিত হয় ডুমা প্রশাসন। তারা মাত্র কয়েকমাস শাসন পরিচালনা করেন। তারপরই সূচিত হয় অক্টোবরের মহান সেই বলশেভিক বিপ্লব। যার মধ্যদিয়ে রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতন্ত্র।
তথ্যসুত্রঃ
১. http://missinglink.ucsf.edu/lm/russia_guide/historyofrussia.htm
২. http://familypedia.wikia.com/wiki/List_of_Russian_rulers
৩. https://www.youtube.com/watch?v=w0Wmc8C0Eq0

No comments

Powered by Blogger.