কেরমানশাহ: শাফেয়ি জামে মসজিদ

এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। দেখার দেশ ইরান। ঘুরে বেড়ানোর দেশ ইরান। আর্যভূমির এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে ঘুরে বেড়াবো আমরা। গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দর প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ শহর কেরমানশাহে। কেরমানশাহ প্রদেশের দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনার সঙ্গেও আমরা খানিকটা পরিচিত হয়েছিলাম।
আপনারা নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন যে এই কেরমানশাহ প্রদেশে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। ওই ভূ-কম্পনে প্রদেশের শহরগুলো ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল। জেনে রাখা ভালো যে কেরমানশাহের শহরগুলো ইরানের ঐতিহাসিক এবং সুন্দরতম শহরগুলোর অন্তর্ভুক্ত। স্বয়ং কেরমানশাহ শহর ইরানের ঐতিহাসিক এবং সুন্দর শহরগুলোর অন্যতম। কেরমানশাহের কথা উঠলে প্রথমেই অনেকের মনে পড়ে যায় বিস্তুনের শিলালিপির কথা। এই শিলালিপিটি ফরহাদের প্রস্তরলিপি নামেই বেশি পরিচিত। এখানকার হেরাক্লিয়াসের ভাষ্কর্যও দেখেছি আমরা। আরও দেখেছি পর্যটক আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক আরেকটি পাথুরে শিল্প স্থাপনা 'ত্বক বোস্তন'।
বলেছি যে কেরমানশাহ'তে ত্বক বোস্তন আর বিস্তুন পাহাড় ছাড়াও আরও বহু দর্শনীয় স্থাপনা রয়েছে। বিশেষ করে কাজার এবং পাহলাভি রাজবংশের শাসনামলের বহু নিদর্শন রয়েছে এখানে। ইরানে আকর্ষণীয় যতগুলো মসজিদ রয়েছে তাদের মধ্যে একটি মসজিদ এই কেরমানশাহ প্রদেশে অবস্থিত। এই ঐতিহাসিক মসজিদটি শাফেয়িদের মসজিদ। শাফেয়ি জামে মসজিদ নামেও পরিচিতি রয়েছে এই মসজিদের। তুর্কিদের মসজিদের ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে এই মসজিদটি। এই মসজিদের বিশাল বিশাল মিনার পুরো শহরের সৌন্দর্য ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে। এটি একটি সুন্নি মসজিদ। মসজিদের এক প্রান্ত গিয়ে মিশেছে কেরমানশাহ বাজারের সঙ্গে। কেরমানশাহ বাজারের বয়স দেড় শ বছরের বেশি। এখানে রয়েছে বিচিত্র সরাইখানা। রয়েছে বহু প্যাসেজ এবং শপিং মল, ছোটো ছোটো অনেক মসজিদ, জিমনেশিয়াম এবং  হাম্মামখানা।
এইসব প্রাচীন স্থাপনা প্রমাণ করছে যে কেরমানশাহ বেশ প্রাচীন একটি শহর। কেরমানশাহ শহরের লোকজনের সংস্কৃতি, স্মৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য তথা সমৃদ্ধ অতীতের কথা প্রামাণ্য করে তোলে এইসব স্থাপনা। কেরমানশাহ বাজারটি তার সমকালে ছিল সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় বাজার। এর ভেতরে আবার শাখা বাজারও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সোনার বাজার, ইসলামি বাজার এবং তোপখানা বাজারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাজারটির কাঠামো বেশ দৃষ্টিনন্দন। প্রাচীন কাঠামোর সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়ে তোলা হয়েছে এর স্থাপত্যশৈলী। যার ফলে যে কোনো পর্যটকই প্রথম দেখাতেই বাজারের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারেন না।এই বাজারে কেরমানশাহের ঐতিহ্যবাহী কিছু জিনিসপত্র বিশেষ করে হস্তশিল্প দেখতে পাওয়া যায়। যেমন: নামাদমলি মানে দুম্বার পশম দিয়ে তৈরি এক ধরনের গালিচা। একইভাবে মৌজবফি মানে ঢেউয়ের মতো বুননের কাজ দিয়ে হাতে তৈরি এক ধরনের গালিচা। এই গালিচা সুতোর তৈরি।
বাজারে সহজলভ্য ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্রের কথা বলছিলাম। এই বাজারে আরও যেসব জিনিসপত্র পাওয়া যায় তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন রকমের থান কাপড়, রঙ-বেরঙের কাপড়, তৈরি করা জামা-কাপড়, বিচিত্র হস্তশিল্প ইত্যাদি। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বিচিত্র উপহার সামগ্রীও এই বাজারে পাওয়া যায়। যেমন চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরি রুটি, কাকা রুটি এটা দেখতে অনেকটা পাকপান পিঠার মতো, খোরমা রুটিসহ স্থানীয়ভাবে তৈরি বহু রকমের মিষ্টি। এগুলোর বাইরেও বিভিন্ন রকমের গেলিম, গালিচা, জাজিম মানে সুতোর তৈরি মাদুর জাতীয় এক ধরনের মোটা গালিচা, জুতা, কুর্দি লেবাস ইত্যাদিও পাওয়া যায় এই বাজারে। এখানে আরও যে স্থাপনাটি না দেখলেই নয় তা হলো মোয়াবেনুল মুলক তাকিয়া। এই স্থাপনা বাংলাদেশের পুরান ঢাকার ইমামবাড়ির মতো। অনেকে হোসাইনিয়াও বলেন। সচিত্র টাইলসের কারুকাজে সাজানো এই স্থাপনাটির স্থাপত্যশৈলী দেখার মতো। কাজার শাসনামলের সুন্দরতম স্থাপনাগুলোর অন্যতম এই মোয়াবেনুল মুলক হোসাইনিয়া।
নাম থেকেই বোঝা যায় যে এটি একটি ধর্মী স্থাপনা। ধর্মীয় অনুষ্ঠানসহ উপজাতীয় ও গোত্রীয় দ্বন্দ্ব-মতপার্থক্য নিরসনে এই স্থাপনার ব্যাপক ভূমিকা ছিল। পরবর্তীকালে অবশ্য এটি একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। কাজার শাসনামলের আরও একটি তাকিয়া স্থাপনা হলো 'বিগলারবেইগি'। আয়নার কারুকাজের জন্য এই তাকিয়াটি ব্যাপক প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। মুজাফফার উদ্দিন শাহের আমলের এই স্থাপনায় রয়েছে লিপিকর্ম ও ক্যালিগ্রাফির সমৃদ্ধ সংগ্রহ। কেরমানশাহ বেড়াতে গেলে নিলুফার হ্রদ না দেখে আসা বোকামি হবে। নীলপদ্মময় এই হ্রদের সৌন্দর্যই অন্যরকম। গ্রীষ্মের মৌসুমে সবুজ থালার মতো পত্রময় সাদা, নীল, লাল পদ্মে ভরে যায় পুরো হ্রদ। পাশের কয়েকটি ঝরনা থেকে আসা পানিতে হ্রদ পরিপূর্ণ থাকে প্রায় সবসময়। বাতাসে পদ্মফুলের নৃত্য খেলা করে স্ফটিকস্বচ্ছ হ্রদের জলে। এর সৌন্দর্য সত্যিই অপূর্ব এবং রসিক মনের জন্য উপভোগ্য।
কেরমানশাহ দেখতে কিংবা বেড়াতে যাবেন কেন? কেবল তার পদ্মহ্রদ দেখার জন্য? ত্বক-বোস্তন, বিস্তুন পাহাড়, ইমামবাড়ি, ঐতিহ্যবাহী বাজার কিংবা রঙ-বেরঙের পোশাক-আশাক আর বিখ্যাত সব মিষ্টির জন্য? না। বরং কেরমানশাহ প্রদেশ এবং শহরে বেড়াতে যেতে হবে এই এলাকার মানুষের অতিথি পরায়ণতা, তাদের ঔদার্য আর সদয় ধৈর্যশীল আচরণের অভিজ্ঞতা লাভ করার জন্য। সেইসঙ্গে তাদের প্রতিরোধের দৃঢ়তা ও বীরত্বপূর্ণ মনমানসিকতার সঙ্গে পরিচিত হবার জন্য। ইরাকের বাথ সরকারের চাপিয়ে দেওয়া আট বছরব্যাপী যুদ্ধের সময় ইরানের সার্বভৌমত্ব, সম্মান ও মর্যাদা সুরক্ষার স্বার্থে শত্রুদের মোকাবেলায় যেরকম বীরত্ব দেখিয়েছে এই কেরমানশাহের জনগণ তা ইতিহাসে বিরল। তার নিদর্শন এখনও তাদের মনে-প্রাণে-দেহে লক্ষ্য করা যাবে।
দেশের স্বার্থে প্রাণ বিসর্জনের সেই উন্নত মানসিকতা এখনও তাদের মাঝে বিরাজ করছে। এখনও কেরমানশাহ এলাকার জনগণ দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও অগ্রগতির জন্য নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

No comments

Powered by Blogger.