ঘরের নেয়ে

বাবা মারা গেলে কি হয়? একটু আগেই রতনের বাবা মারা গেলেন। মরা বাড়ির দৃশ্য সব প্রায় একই রকম। কান্নাকাটি হচ্ছে। আশপাশের বাড়ি থেকে মানুষজন সান্ত¡না দিচ্ছে। রতন পাশেই পুকুর পাড়ে ছিল। সে একই জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মাথায় কেবল চাপটি নামের একটা খাবারের কথা ঘুরছে। হাটে পাওয়া যায়। দুই ধরনের চাপটি হয়। একটা গাঢ় চিনির শিরায় বাদাম মিশিয়ে বানানো হয়। আর একটা মিঠাই এর শিরায় বাদাম মিশিয়ে। এর বাইরে আর কিছুই ঢুকছে না মাথায়। কান্নাকাটির শব্দও তেমন কিছুই মনে হচ্ছে না।

অল্প শোকে কাতর, অধিক শোকে পাথর। হয়তো অধিকের উপরের শোকে আবার নরম্যাল। রতন ভাবছে তার শোকটা অল্পও না, অধিকও না। তাই তার কিছুই মনে হচ্ছে না। সে বাড়ির মেজ ছেলে। বড় দুই ভাই, ছোট এক ভাই, এক বোন। এক ভাই ঢাকায় বুয়েটে পড়ছেন। অন্য ভাই চিটাগাং ইউনিভার্সিটিতে। দুই ভাইকে খবর দিতে হবে। ছোট বোনটা স্কুলে, ওকে খবর দেয়ার দরকার নেই। একটু পরে এমনিতেই চলে আসবে। আত্মীয়-স্বজনদের খবর দিতে হবে। এলাকায় মাইকিং করতে হবে। মৃত্যুর পর শোক বুকে নিয়েই অনেক ফর্মালিটিজ পালন করতে হয়। এরপরেও কোনো একটায় ভুল হলে তা ক্ষমার অযোগ্য বলেই সবাই ধরে নেয়। ওমুককে কেন খবর দেয়া হলো না, তুমুককে কেন সবার শেষে বলা হলো।

সকালের দিকেই রতনের বাবার খুব শ্বাস-কষ্ট হচ্ছিল। তিনি রতনকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, রতন তুই ছাড়া এই সংসারের হাল ধরার কেউ নাই। মৃত্যুর ঠিক আগ মুহূর্তেও মানুষের মাথায় সংসার নামের ব্যাপারটা থাকে! বাবার মুখটা মনে আসার সঙ্গে সঙ্গেই চোখে পানি আসল। চোখের পানি এত গরম হয়? রতন ঝরঝর করে অনেকক্ষণ কাঁদল, বাবা বাবা...

পকেটে টাকা বলতে শ’খানেক আছে। রতন সবেমাত্র ইন্টার পাস করেছে। তার পকেটে এরচেয়ে বেশি টাকা থাকে না। সে কোনোদিন কারো কাছে টাকা ধারও করেনি। কাফনের কাপড় কিনতে হবে। ভালোটাই কিনতে হবে। বাবা খুব পরিষ্কার ও রুচিওয়ালা মানুষ ছিলেন। মৃত্যুতে অবহেলা নিয়ে যেন বিদায় না হয়। ছোট বোনটা চলে এসেছে। কান্নাকটি আরেক ধাপে শুরু হলো। এর মধ্যে বসে থাকলে চলবে না। রতন ঘরে ঢুকে বাবার দোকানের চাবি হাতে নিল। যদি ক্যাশে কোনো নগদ টাকা থেকে থাকে এই আশায়। এই প্রথম বাবার দোকানের চাবিতে হাত দিল রতন।

বাবার মৃত্যুর পর দু’দিন পার হয়ে গেল। তার মানে মৃত্যুর তিন দিন হলো। ‘আজ মরলে কাল দুই দিন’ হিসাব মতে। আগামী দিন মিলাদ পড়াতে হবে। ক্যাশে যা টাকা ছিল তা প্রায় শেষ। বড় ভাইরা এসেছিলেন। যাওয়ার সময় গাড়ি ভাড়া দিতে হলো। কেউ চায়নি, রতনের মনে হলো টাকা ছাড়া যাবেন কিভাবে? দু’দিন আগেও রতন বোঝেনি টাকার কতটা প্রয়োজন সংসারে। মৃত্যুর পরেও যদি ফর্মালিটিজে এত টাকা খরচ হয় তবে জীবন্ত মানুষের কেন টাকা লাগবে না? এলাকার চৌকিদারকে দিয়ে বাড়ি বাড়ি খবর দেয়ার কাজটা করা হয়েছিল। ছেলেটাকে কিছু টাকা দিতে হবে। এক কাজ করা যায়, ওকে দিয়ে চারদিনের মিলাদের টুকটাক কাজ করিয়ে সঙ্গে বকশিশ হিসেবে একটু বেশি টাকা দিয়ে দিলেই হবে।

কাউকে কিছু বলতে হলো না। সংসার নামের যে নৌকার মাঝি তিনদিন আগে রিটায়ার করলেন, সেই নৌকার হাল এখন রতনের হাতে। কোথার এই নদীর চড়া কোথায় গভীরতা তা সব এখন রতনেরই বুঝতে হবে। সে যে নায়ের নেয়ে এই নায়ের লক্ষ্য কোনো তীর নয়। এই নায়ের নেয়ের কাজই হলো একে ঠিকমতো বেয়ে নিয়ে যাওয়া। সংসার নামক নৌকার কোনো গন্তব্য থাকে না। অনাদি কাল থেকেই তা চলছে। যে নৌকায় হাল ধরার মতো কেউ থাকে না তা উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক-সেদিক চলে। চলতে চলতে ধাক্কা খায়, ঠোক্কর খায়। ধাক্কা, ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে কোনো একদিকে চলে যায়। ডুবেও যায় কেউ কেউ। রতন তা হতে দেবে না।

বড় ভাইদের পরীক্ষা ছিল, উনারা চলে গিয়েছিলেন। আগামী দিন আবার আসবেন। রতন দোকানে বসা শুরু করেছে। মাঝেমাঝেই মনে হচ্ছে সে ছাড়া আর কি কেউ আছে যে নাকি সংসারের হাল ধরবে? সে চিন্তা করে। কোনো ক‚ল-কিনারা পায় না। সে ছাড়া আর কে ধরবে হাল? বড় দুই ভাইয়ের পড়াশোনার আর কয়েক বছর বাকি। এর পরেই বড় চাকরি পাবেন। নিশ্চিত ভবিষ্যৎ ছেড়ে তারা গ্রামে ফেরত আসবেন? আবার শহরে থাকতে গেলে তাদের খরচ পাঠাবে কে? অতএব রতনই একমাত্র যোগ্য ব্যক্তি সংসারের হাল ধারার। ছোটদের দায়িত্ব তো এমনিতেই তার ওপর। যাই হোক, আপাতত মিলাদের কাজটা শেষ হোক।
মিলাদ শেষ হলো। বড় ভাই আসেননি, উনার পরীক্ষা। এর পরের জন এসে সেদিনই চলে গেলেন। সংসার নিয়ে কেউ কিছুই বলছে না। ছোট ভাই-বোন কেউই স্কুলে যায়নি এই কয়দিন। পাঁচ দিনের দিন আত্মীয়-স্বজন সবাই চলে গেল। বাড়ি প্রায় ফাঁকা। ছোট ভাইটা কাছে এসে বল্লো, ভাইয়া তোমার সাথে আমিও যাব দোকানে। খুব সহজ একটা কথা। ভেতরটা হু হু করে ওঠল রতনের। ভাইটাকে বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠল। মা আসলেন, ছোট বোনটা আসল। মরা বাড়ির শোকটা এখনো মরেনি, আবার যেন তা কয়লার আগুনে বাতাস লাগার মতো জ্বলে ওঠল। সবাই একসাথে কাঁদছে।

রতন চট করেই নিজেকে সামলে হালকা করে হাসি দিয়ে বলল, দোকানে যাইতে চাইলে যাবি, আগে স্কুলে যা। প্রায় মাস খানেক হয়ে গেল রতন সংসার চালাচ্ছে। ব্যাবসাটা ধীরে ধীরে বুঝতে শিখছে। একটা ব্যাপার ভেবে সে প্রায়ই মজা পায়। ঘটনাটা হলো, অনেকেই বাকি টাকা চাইতে আসছেন। কিন্তু কেউ কেউ তো বাকিতে নিশ্চয়ই নিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। বাকি যারা চাইতে আসছেন তাদের আস্তে আস্তে সে শোধ করছে। সব কিছুর পর হাতে তেমন টাকা থাকছে না। সংসার একটা তলাহীন ঝুড়ি, যতই দেয়া হয় ততই যেন নিমিষেই নাই হয়ে যায়। বাজার সদাই, মায়ের ওষুধ, ছোট ভাই বোন দুইটার খরচ। তার উপর আছে বড় দুই ভাই। বেশ কয়েকদিন ধরেই টুকটাক করে জমানোর চেষ্টা করছে রতন। তার ইচ্ছা হলো, বড় দুই ভাই লজ্জায় হয়তো তার কাছে চাইতে পারবে না। চাওয়ার আগেই যেন সে টাকা পাঠিয়ে দিতে পারে। বড় ভাই তার কাছে টাকা চাইবে এ হয় না। রতন কিছুতেই বড় ভাইদের এমন বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে দেবে না। এতে উনাদের চাইতে তারই লজ্জাটা বেশি হবে।

কখন যে কে সংসারের হাল ধরবে তা আগে থেকে কখনোই বুঝা যায় না। যে রতন কয়দিন আগেও বাবার কাছে টাকা চেয়ে না পেলে মন খারাপ করতো সেই রতন এখন টাকা দিতে না পারলে মনে কষ্ট পাচ্ছে। রতন দুই দুই চার হাজার টাকা বড় দুই ভাইয়ের নামে মানি অর্ডার করে দিল। মানি অর্ডারটা করার পর বেশ ফুরফুরে মন নিয়েই বাড়ি ফিরল রতন।

বাবা মারা যাওয়ার পর রতনের মা অনেকটা শক্ত হয়েছেন। আগে সংসারের অত ঝামেলা তিনি বুঝতেন না। এখন আস্তে আস্তে সবকিছুরই খবর রাখছেন। রতন তার বাবার ব্যবসাটা ভালো করে ধরতে পারছে না। যতটুকুই টুকটাক শুনতেন রতনের বাবার কাছে তা রতনের সঙ্গে শেয়ার করছেন। শীত আসার আগেই ভেজলিন কিনতে হবে মনে করিয়ে দিলেন। কৌটায় করে ভেজলিন ভরে রাখতে হবে। বিভিন্ন ছোট ছোট আড়তদাররা এই ভেজলিন নিয়ে যাবে। অনেকে আবার এর ওপর নিজেদের ট্যাগও লাগিয়ে নেন। জমিজামাগুলোও কিছু দেখতে হবে। মুশকিল হলো জমিজামা রতনের বাবাই সব দেখাশোনা করতেন। এছাড়া আর কেউ সব কয়টা জমি চিনেনও না। জমি না চিনলেও সমস্যা নাই। কোন মাঠে কত শতক জায়গা তা মুখে মুখে জানেন। বের করা বেশি কঠিন হবে না।

দেখতে দেখতে সময় দ্রুতই চলে গেল। ব্যবসায় উন্নতির কিছু হয়নি। অবনতি হতে হতে যখন বন্ধ প্রায় তখন রতনেরও দায়িত্ব প্রায় শেষ। বড় ভাই দুইজন পড়াশোনা শেষ করে বড় চাকরি করছেন। ছোট ভাইটা স্কলারশিপ পেয়ে দেশের বাইরে চলে গেল। ছোট বোনটা পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। হলে থাকে। এখন খরচ বলতে ছোট বোনের পড়াশোনা আর রতন আর তার মায়ের যা লাগে।

টাকায় টাকা আনে আবার টাকায় টাকার প্রয়োজনীয়তা বাড়িয়ে দেয়। বেশ কয়েক বছর ধরেই বড় ভাইরা ঈদে বাড়ি আসেন। কথায় কথায় বলেন, ঢাকা শহরে থাকা আর টাকা কচকচিয়ে খাওয়া। যে টাকা কচকচিয়ে তারা খান সে টাকায় কামড় দেয়ার ইচ্ছা রতনের নেই। তাদের মায়েরও না। প্রতিবারই তারা বলেন, একটু গুছিয়ে নেই তারপর আম্মা আপনারে নিয়ে যাব। রতনের মাও হাসি দিয়ে বলেন, গুছিয়ে নাও কিন্তু আমাকে নিতে হবে না।

No comments

Powered by Blogger.