সারপোলে জাহাব শহরের সুন্দর দর্শনীয় নিদর্শন

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য, পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।
গত আসরে আমরা গিয়েছিলাম ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের সুন্দর প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনে সমৃদ্ধ শহর কেরমানশাহে। কেরমানশাহ প্রদেশের দুটি ঐতিহাসিক স্থাপনার সঙ্গেও আমরা খানিকটা পরিচিত হয়েছিলাম। একটি ঐতিহাসিক শাফেয়ী জামে মসজিদ। তুর্কিদের মসজিদের ডিজাইনে তৈরি করা হয়েছে এই মসজিদটি। এই মসজিদের বিশাল বিশাল মিনার পুরো শহরের সৌন্দর্য ব্যাপক বৃদ্ধি করেছে।
আরেকটি হলো কেরমানশাহ বাজার। এই বাজারের ভেতরে আবার শাখা বাজারও রয়েছে। এগুলোর মধ্যে সোনার বাজার, ইসলামি বাজার এবং তোপখানা বাজারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। বাজারটির কাঠামো বেশ দৃষ্টিনন্দন। প্রাচীন কাঠামোর সঙ্গে আধুনিকতার সংমিশ্রণে গড়ে তোলা হয়েছে এর স্থাপত্যশৈলী। যার ফলে যে কোনো পর্যটকই প্রথম দেখাতেই বাজারের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে পারেন না। যাই হোক এরকম আরো একটি স্থাপনা হলো সারপোলে জাহাব শহর। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে এই শহরটিরও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বলাবাহুল্য এই শহরটিই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও সারপোল জাহাব শহরের সৌন্দর্য ও প্রাকৃতিক অনাবিল দৃশ্য নান্দনিক মনের লোকদেরকে এখনও আকৃষ্ট করে। পর্যটকদের ভিড় তাই এই শহরে একটুও কমে নি। কেরমানশাহ প্রদেশ সফরে গিয়ে কেউ যদি সারপোলে জাহাব শহরে বেড়াতে না যায় সেটা হবে খুবই দু:খজনক। কেননা এই শহর এবং শহরের আশেপাশে যেসব সুন্দর সুন্দর এবং দর্শনীয় নিদর্শন রয়েছে সেগুলো না দেখাটা ঠিক হবে না। সারপোলে জাহাব শহরটি গড়ে উঠেছে প্রাচীন হালাভন শহরের ধ্বংসাবশেষের কাছে। এরই পাশে রয়েছে শাসানীয় শাসনামলের ধ্বংসপ্রাপ্ত দুর্গটি। সারপোলে জাহাব ছিল সীমান্ত ঘাঁটি এবং কেল্লা। এর অবস্থান ছিল পাকিস্তান-ইরান সীমান্তবর্তী এলাকায়। আরবরা যখন ইরানের ওপর হামলা চালিয়েছিল তখন কেল্লাটি ধ্বংস হয়ে যায়। এই শহরটি এখন তেহরান-বাগদাদ মহাসড়কের কাছে পড়েছে। সারপোলে জাহাব শহরের আরেক প্রান্ত মিলেছে পার্বত্য এলাকা এবং তার পার্শ্ববর্তী সমতল ভূমির সঙ্গে। এখানেই রয়েছে বিখ্যাত দালাহু পর্বতগুলো এবং রিজাব নামক সুন্দর এলাকা।
সারপোলে জাহাব শহরের উপকণ্ঠেই রয়েছে 'পিরন' নামে একটি গ্রাম। এই গ্রামটি দালাহু পর্বতগুচ্ছের সবুজের সমারোহপূর্ণ উপত্যকার ওপরে গড়ে উঠেছে। গ্রামটি এতোই সুন্দর যে যে-কোনো ইরান-পর্যটককেই আকর্ষণ না করে পারে না। এই গ্রামের পাশেই রয়েছে সবুজ উদ্ভিদময় জঙ্গল। এইসব জঙ্গলে রয়েছে সুন্দর সুন্দর এবং বড় বড় চেনর গাছ, তাব্রিজি বৃক্ষ, আখরোট ও ডুমুর এবং অন্যান্য গাছের সমাহার। চমৎকার উপভোগ্য এই পরিবেশে অবকাশ যাপন করতে আপনি খুবই প্রশান্তি উপলব্ধি করবেন নি:সন্দেহে। এই গ্রামের সবচেয়ে আকর্ষণীয় জিনিসটি হলো ঝরনা। অনেক উপর থেকে এই ঝরনার জলপতনের দৃশ্য বেশ দূর থেকেও দেখা যায়। ওই ঝরনার কাছে যেতে হলে সারপোলে জাহাব শহর থেকে আনুমানিক নয় কিলোমিটার গেলে শলন নামে একটি গ্রাম পড়বে। ওই গ্রাম থেকে পণেরো মিনিট হেঁটে গেলে ঝরনা সমৃদ্ধ গ্রামের দেখা মিলবে।
পিরন ঝরনার কথা বলছিলাম আমরা। সম্ভবত বিদেশি পর্যটক তো বটেই এমনকি ইরানি ভ্রমণবিদরাও হয়তো ভাবতেও পারেন না যে ইরানের ভেতর এক শ মিটার লম্বা কোনো ঝরনা থাকতে পারে। তাদের জন্য আশার কথা হলো এই যে, এই ঝরনাটি সত্যিই শতাধিক মিটার লম্বা। বেশ দ্রুত গতিতেই এই ঝরনার পানি নীচে পড়ে। এখানে গেলে আরও দেখা যাবে পর্বতারোহীদের ডিগবাজি খেলা। সেই উঁচু চূড়া থেকে পর্বতারোহীদের নীচে নেমে আসার দৃশ্য যে কাউকেই আকর্ষণ না করে পারে না। কেবল এই ঝরনাই নয়, মূলত সারপোলে জাহাবের আশেপাশের এলাকা দর্শনীয় বহু নিদর্শনে পূর্ণ বলা যায়। এখানে রয়েছে অবকাশ যাপনের জন্য উপযোগী জঙ্গল বা বনাঞ্চল। পতক নামক গ্রামের ভেতরে বিদ্যমান এই বনের নাম হলো ইমাম আব্বাস। এই পতক গ্রামটিকে পবিত্র গ্রাম নামেও অভিহিত করা হয়।
এর কারণ হলো এই গ্রামের প্রাকৃতিক সকল উৎসকে খুব যত্নের সঙ্গে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এই গ্রামে সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে গ্রামের সকল পরিবারের ঘরে ঘরে। তাই এরকম নাম। এখানে রয়েছে 'জিয মানিযেহ' নামক একটি প্রাচীন দূর্গ। হাজার বছর আগের এই দূর্গটি পাথর দিয়ে বানানো হয়েছে। এটি একটি শাহী দূর্গ। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও মন কেড়ে নেয়া সুন্দর। সব মিলিয়ে পতক গ্রামটি পরিণত হয়েছে একটি পর্যটক আকর্ষণীয় স্পটে। পুরো কেরমানশাহ প্রদেশের মধ্যে এই গ্রামটি অনন্য সাধারণ একটি স্থান। যেখানে গেলে কেরমানশান প্রদেশ বেড়াতে যাওয়াটা সার্থক বলে মনে হবে যে-কোনো পর্যটকের কাছে।
সারপোলে জাহাব শহরের কথা বলছিলাম আমরা। এই শহরের পাশ্ববর্তী মহাসড়কগুলোও আমাদেরকে অসম্ভব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে নিয়ে যাবে খুব সহজেই। উদাহরণ হিসেবে রিজব মহাসড়কের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এই রিজব মহাসড়ক ধরে যেতে যেতে পথেই পড়বে চমৎকার আবহাওয়াময় সুন্দর পরিপাটি করে সাজানো গোছানো সবুজ গ্রামের পর গ্রাম। এই গুচ্ছগ্রামই রিজব নামে পরিচিত। এই রিজব মহাসড়কের শেষ প্রান্তে রয়েছে একটি কবর। বাবা ইয়দেগারের কবর এটি। বিখ্যাত এই কবরে যেতে হলে কিংবা এখানকার বিনোদন কেন্দ্রে যেতে হলে একটু হাঁটতে হবে। বর্ণনা থেকে নিশ্চয়ই আঁচ করা যায় যে বাবা ইয়দেগার হলো একটি পবিত্র কবরস্থান এবং এর পাশেই রয়েছে একটি অবকাশ যাপন কেন্দ্র। কবরটি আকাশচুম্বী পাথুরে পাহাড়ের উচ্চতায় অবস্থিত। চারদিকে রয়েছে অনেক বড় বড় প্রাচীন গাছ গাছালি। সব মিলিয়ে পুরো দৃশ্য বেশ আকর্ষণীয়। এখানকার হিম শীতল হাওয়া অতিথি পর্যটকদের জন্য সর্বোত্তম উপহার।

No comments

Powered by Blogger.