নিঃসঙ্গ হওয়ার জন্য স্বেচ্ছায় বনবাসী হওয়া দু'জনের গল্প

নীরবতায় পরমানন্দ পান সারা মেইটল্যান্ড।
অনেক মানুষ আছেন যারা একা থাকতে পছন্দ করেন না। তারা একাকী বোধ করেন।
আবার কিছু মানুষের কাছে এই নিঃসঙ্গতাই হল আনন্দের উৎস।
বিবিসির শবনম গ্রেওয়াল এমনই স্বেচ্ছায় বনবাসের জীবন বেছে নেয়া দু'জনের সঙ্গে কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে একজন হলেন ক্রিস্টোফার নাইট।
১৯৮৬ সালে জন্ম নেয়া ওই ব্যক্তি ২০ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যের একটি বনে বসবাস শুরু করেন।
তিনি নিজের গাড়ি বাড়ি সব ছেড়ে শুধুমাত্র জরুরি প্রয়োজনের কিছু জিনিষপত্র নিয়ে শুরু করেন তার অরণ্যবাস।
গত ২৭ বছরে একবারের জন্যও তিনি সেই অরণ্য থেকে বেরিয়ে আসেননি।
ইচ্ছাকৃতভাবে হারিয়ে যাওয়ার পরে, মিস্টার নাইট শেষ পর্যন্ত নিজের বাড়ির জন্য কাঙ্ক্ষিত জায়গাটি খুঁজে পেয়েছিলেন।
নর্থ পণ্ড নামের একটি হ্রদের চারপাশে ঘন জঙ্গলে ঘেরা একটি অংশ। তার মাঝে একটি ফাঁকা জায়গায় তিনি তার থাকার ঘরটি তৈরি করেন।
গাছের মাঝে কিছু তার ঝুলিয়ে তার মধ্যে নিজের নাইলনের তাঁবুটি স্থাপন করে তিনি শুরু করেন তার স্থায়ী বনবাস।
তার অবস্থান সম্পূর্ণ লুকানো থাকলেও মাত্র কয়েক মিনিট হাঁটার পথেই ছিল কয়েকশ সামার কেবিন।
নাইট মূলত সেসব কেবিন এবং কমিউনিটি সেন্টারের জিনিসপত্র চুরি করে টিকে ছিলেন।
সেখান থেকে তিনি কেবল তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলি নিতেন - যেমন খাদ্য, রান্নার জন্য জ্বালানী, কাপড়, বুট, টর্চের জন্য ব্যাটারি এবং প্রচুর বই।
২০ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের মেইন রাজ্যের একটি বনে বসবাস শুরু করেন ক্রিস্টোফার নাইট
তবে বছরে ১০০০ টিরও বেশি চুরির ঘটনায় কেবিন মালিকদের মধ্যে প্রচুর উদ্বেগ সৃষ্টি হয়।
অবশেষে পুলিশ একটি ফাঁদ পেতে হাতেনাতে ধরে নাইটকে। এরপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
ওই কারাগারে নাইটের সঙ্গে কথা হয় লেখক মাইক ফিনকেলের। তিনি তখন "দ্য স্ট্রেঞ্জার ইন দ্য উডস: দ্য এক্সট্রা অর্ডিনারি স্টোরি অফ দ্য লাস্ট ট্রু হার্মিট" বইটি লিখেছিলেন।
তিনি নাইটের কাছে জানতে চান যে "কেন তিনি দুনিয়া থেকে মুখ ফিরিয়ে পুরোপুরি একা বাঁচতে চলে গেলেন?"
ক্রিস নাইট জানান যে তিনি অন্যান্য মানুষের আশেপাশে থাকতে খুব অস্বস্তি বোধ করেন। তার একাকী হওয়া চেষ্টা অনেকটা মহাকর্ষীয় শক্তির মতো কাজ করে, যেখানে তার সমস্ত শরীর বলতে চায় যে তিনি কেবল নিজের সাথেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।"
তার এই চেষ্টা এতটাই প্রবল ছিল যে তিনি কোন ব্যক্তির সাথে কথা না বলে প্রায় তিন দশক কাটিয়ে দিতে পেরেছেন।
তবে এরমধ্যে তিনি একজন ব্যক্তির সাথে কথা বলেছিলেন - এক হাইকার তার সামনে হোঁচট খেয়ে পড়ায় তিনি তাকে "হাই" বলেছিলেন।
নর্থ পন্ডে নাইটের তৈরি ক্যাম্প
মেইনের বিরূপ আবহাওয়ার সঙ্গেও নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন নাইট।
তাপমাত্রা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নেমে গেলেও তিনি আগুন জ্বালাননি না। তার যুক্তি হল আগুনের ধোঁয়া অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে।
দিনের পর দিন তাহলে কী করে সময় কাটিয়েছেন নাইট?
ফিনকেলের এমন প্রশ্নের জবাবে নাইট বলেন যে, তিনি সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিতেন। এবং রাতে যখন শীত বাড়তে থাকে, বিশেষ করে রাত তিনটার দিকে তিনি অ্যালার্ম দিয়ে রাখতেন। সে সময় তিনি ঘুম থেকে উঠে সকাল পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করতেন, যেন নিজেকে উষ্ণ রাখা যায়।
কিছুক্ষণ তিনি কিছু বই পড়তেন, ক্রসওয়ার্ড বা শব্দ তৈরির খেলা খেলতেন ... তবে শুধু এসব করেই যে সময় কাটাতেন, ঠিক তা না। তিনি মূলত যা করতেন তা হ'ল 'কিছুই না'"
নাইটের এই "কিছুই না" বিষয়টিকে ফিনকেল ব্যাখ্যা করেছেন অনেকটা এভাবে-
"প্রথমত নাইট ২৭ বছরে মধ্যে এক মুহূর্তের জন্যও একঘেয়েমি বোধ করেননি। তিনি কখনও নিঃসঙ্গ বোধ করেননি। বরং তিনি বিশ্বের সমস্ত কিছুর সাথে সম্পূর্ণ এবং নিবিড়ভাবে যুক্ত ছিলেন। যার যোগাযোগ ছিল শুধুমাত্র প্রকৃতির সাথে। এই কিছুই না সময়ে এই যোগাযোগটি স্থাপন হয়েছে।"
ক্রিস্টোফার নাইট তার চুরির জন্য সাত মাস জেল খেটেছেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি লেখক ফিনকেল ছাড়া আর কারো সঙ্গেই কথা বলেননি।
নর্থ পন্ড, মেইন
তারপর এই বনবাস নিয়ে গুগলে সার্চ করতে গিয়ে আরেকজন স্বেচ্ছা বনবাসীর খোঁজ পান ফিনকেল।
আর তিনি হলেন সারা মেইটল্যান্ড। স্কটল্যান্ডে নিজের তৈরি একটি সুন্দর ছিমছাম কুটিরে একা থাকেন তিনি।
তার সামনের দরজা থেকে মাইলের পর মাইল বিস্তৃত ভূমি চোখে পড়ে।
হারমিট বা তার মতো বনবাসীদের নিয়ে মানুষের অনেক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে কথা বলেন মিজ মেইটল্যান্ড।
প্রথমত অনেকেই ভাবেন হারমিটরা সেলফিশ বা স্বার্থপর হয়। যা নিয়ে মিজ মেইটল্যান্ড রসিকতা করতেও ছাড়েননা।
তবে একাকী নীরবে কেন এতো দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতে চান? এর উত্তরে মিজ মেইটল্যান্ড বলেন, "নীরবতা এমন একটি জায়গা যেখানে আমি পরমানন্দ পাই এবং এটি কেবল একটি কল্পিত অনুভূতি।"
"আমি কেবল এটিকে নিস্তব্ধতায় পেয়েছি এবং আমি জানি বেশিরভাগ লোকেরা এটি কেবল নীরবতার মধ্যেই পান। "- জানান তিনি।
যারা দীর্ঘ সময় একা একা কাটান তাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে রয়েছে, তারা নিজেদের ব্যাপারে অতি সচেতনতা বোধ হারিয়ে ফেলেন এবং পুরোপুরি নিজের মতো হয়ে ওঠেন, সেখানে ভদ্রতার চর্চা করতে হয়না বা অন্যকে অন্যকে খুশি করার চেষ্টাও থাকেনা। এর অর্থ আপনি চাইলেই নাক খোঁচাতে পারবেন। জোরে গান করতে পারবেন আবার পোশাক পরতেও ভুলে যেতে পারেন।
এছাড়া যেকোনো খাবারের স্বাদ স্বাভাবিক সময়ের চাইতে একাকীত্বের জীবনে অনেক বেশি সুস্বাদু লাগে বলেও তিনি জানান।
নাইট মূলত পাশের সামার কেবিন এবং কমিউনিটি সেন্টারের জিনিসপত্র চুরি করে টিকে ছিলেন
গোসল করার মতো স্বাভাবিক কার্যকলাপেও অনেক আনন্দ পাওয়া যায়। আর গরম পানিতে গোসলকে তো মনেহবে রীতিমত বিলাসিতা।
তবে এই নিস্তব্ধতার প্রভাব একেকজনের ক্ষেত্রে একেকরকম বলে মনে করেন মিজ মেইটল্যান্ড।
তিনি জানান যে, প্রিয়জন মারা যাওয়ার পরে, বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরে মানুষ প্রায়শই প্রথমবারের মতো নীরবতার মুখোমুখি হয়।
অনেকের ওপর সেই নিঃসঙ্গতার বিরূপ প্রভাব পড়ে।
এ কারণে তিনি মনে করেন যে মানুষকে যদি শৈশব থেকে একাকীত্ব বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখায় বা একাকীত্বের অভিজ্ঞতাকে আনন্দদায়ক হিসেবে শেখায়, তাহলে এমনটা হওয়ার আশঙ্কা থাকবেনা।
"আমার মতে শাস্তি হিসাবে কখনও 'নিজের ঘরে যাও' এমন কথা বলা ঠিক হবেনা। বরং একাকী থাকার বিষয়টি পুরস্কার হিসাবে ব্যবহার করতে পারেন।"- বলেন মিজ মেইটল্যান্ড।
ক্রিস্টোফার নাইটও মনে করেন নীরবতা ও নিঃসঙ্গতা হল পুরস্কারের মতো। তিনি চান তার সারা জীবন বনের এই ছোট্ট কুটিরে কাটিয়ে দিতে এবং এখানকার গাছের সারিতে সব ধরণের জাগতিক মায়া পেছনে ফেলে মারা যেতে।
ফেসবুক এবং সোশ্যাল মিডিয়ার এই যুগে এ ধরণের ব্যক্তিদের আক্ষরিক অর্থে চাওয়ার কিছু থাকেনা।," মাইক ফিনকেল বলেছেন। তার কোনও ক্যামেরা ছিল না। তিনি কখনও পত্রিকা রাখেন নি। কিছুই ছিল না। তিনি পুরোপুরি অজানা থাকতে চেয়েছিলেন, এবং সাফল্যের কাছাকাছি এসেছিলেন।"
সারা মেইটল্যান্ড।

No comments

Powered by Blogger.