অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টায় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প by শফিক রহমান

অতীত গৌরব হারিয়ে এখন শুধু অস্তিত্ব রক্ষার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প। দেশটির বছর শুরু করতে হয়েছে আমদানি করা চলচ্চিত্র দিয়ে। ৪ জানুয়ারি ছিল বছরের প্রথম শুক্রবার। বাংলাদেশে সাধারণত এই দিনটিতে নতুন চলচ্চিত্র মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু ওই দিন মুক্তি দেয়ার মতো কোন দেশীয় চলচ্চিত্র না থাকায় কলকাতার কৌশিক গাঙ্গুলী পরিচালিত ‘বিসর্জন’ সিনেমাটি ঢাকার মধুমিতা, বলাকা, শ্যামলী, স্টার সিনেপ্লেক্স এবং চট্টগ্রামের সিলভার স্ক্রিনে মুক্তি দেয়া হয়। চলচ্চিত্রটির আমদানিকারক মধুমিতা মুভিজ-এর কর্ণধার ইফতেখার উদ্দিন নওশাদ বলেন, “দেশি সিনেমা দিয়ে বছরটা শুরু করতে পারলে আমাদের ভালো লাগতো।” তিনি ঢাকার প্রায় ৫১ বছরের পুরোনো সিনেমা হল মধুমিতার কর্ণধারও।
গেল বছরও কোন ভালো খবর দিতে পারেনি চলচ্চিত্র শিল্প। ওই বছর আমদানি করা ১১টি কলকাতার বাংলা ছবি এবং ৪টি যৌথ প্রযোজনার ছবিসহ মোট ৫৬টি ছবি মুক্তি পায় বাংলাদেশে। কিন্তু এর ৫০টি ছবিই ছিল দর্শক বিমুখ।
এর আগের বছর ২০১৭ সালও এর ব্যতিক্রম কিছু ছিলনা। ওই বছর ৬ অক্টোবর মুক্তি পাওয়া গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামালাকে ভিত্তি করে দীপংকর দীপন পরিচালিত ‘ঢাকা অ্যাটাক’ ছবিটি ছাড়া কোনটিই সাড়া ফেলতে পারেনি। ওই বছর মুক্তি পেয়েছিল ৫৭টি ছবি। যদিও গত শতাব্দির আশির দশকে বছরে ১২০টিরও বেশি চলচ্চিত্র মুক্তি পেত। যার অধিকাংশই থাকতো দর্শক প্রিয়তার শীর্ষে।
চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ঠ ও গবেষকরা বলছেন, ঢাকার চলচ্চিত্রে ধস ও দর্শক বিমুখতার এ ধারা শুরু হয় নব্বইয়ের দশক থেকে, অশ্লিল চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে। পরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় টিভি নেটওয়ার্কের বিস্তার, সিডি, ভিসিডি, ডিবিডি। পরে যুক্ত হয়েছে ইন্টারনেট, ইউটিউব। সম্প্রতি এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নেটফ্লিক্স। এছাড়া চলচ্চিত্রের গল্পে বৈচিত্র্য ও নির্মাণশৈলীতে দক্ষতার অভাব থাকছেই। ফলে দর্শক আর হলমুখো হচ্ছে না।
এতে অস্তিত্বের সংকটে পড়েছে সিনেমা হলগুলো। একে একে সেগুলো বন্ধ করে, ভেঙ্গে ফেলে সেখানে নির্মাণ করা হচ্ছে বহুতল শপিংমল। এ প্রক্রিয়ায় সর্বশেষ ভাঙ্গা হচ্ছে ঢাকার কাওরান বাজার এলাকার বহুল পরিচিত পূর্ণিমা সিনেমা হলটি।
এর আগে ঢাকাতেই ভাঙ্গা হয়েছে আরমানিটোলা এলাকার শাবিস্তান সিনেমা হল, ওয়াইজ ঘাট এলাকার মুন সিনেমা হল, সদরঘাটের রূপমহল, ইসলামপুরের লায়ন, গুলিস্তানের গুলিস্তান ও নাজ, এলিফ্যান্ট রোডের মল্লিকা, মিরপুরের বিউটি এবং শ্যামলী এলাকার শ্যামলী সিনেমা হলটি।
এর মধ্যে ‘শাবিস্তান’ ছিল ঢাকার প্রথম সিনেমা হল। প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সময় ঢাকার আরমানিটোলায় এটি স্থাপিত হয়। ১৯৫৬ সালের পর এর নামকরণ হয় পিকচার হাউজ। ওই বছর জনৈক মোহাম্মদ মোস্তফা সিনেমা হলটি কিনে নেন এবং নাম পরিবর্তন করে রাখেন শাবিস্তান।
রূপমহল ছিল ঢাকার দ্বিতীয় সিনেমা হল। ১৯২৪ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৫৬ সালে ঢাকায় তৈরি করা প্রথম সবাক চলচ্চিত্র ‘মুখ ও মুখোশ’ মুক্তি পায় এখানে।
ঢাকার আরেকটি বিখ্যাত সিনেমা হল লায়ন। বলা হচ্ছে এটি ঢাকার তৃতীয় সিনেমা হল। এখানেই মুক্তি পায় উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আলম আরা।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির তথ্যমতে, দেশ স্বাধীনের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে সিনেমা হলের সংখ্যা ছিল ৩০০টির মতো। আশির দশকে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৪০০টিতে। সেখানে এখন সচল আছে মাত্র ৩০০টি। সঙ্গে রাজধানীর বসুন্ধরা সিটি, যমুনা ফিউচার পার্ক ও শ্যামলী শপিংমল কেন্দ্রিক কয়েকটি সিনেপ্লেক্স।
চলচ্চিত্র শিল্পের বর্তমান এ বাস্তবতাকে এক কথায় ‘স্থবির’ বলে উল্লেখ করছেন চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াত। তিনি বলেন, সিনেমা মানেই সিনেমা হল ও বড় পর্দা। এর ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে বেসিক সিনেমা। কিন্তু বাংলাদেশে বড় পর্দা আর অগ্রসর হচ্ছেনা। বরং সংকুচিত হচ্ছে। আরেক দিকে কিছু চলচ্চিত্র হচ্ছে দেশে বিদেশে পুরস্কারও পাচ্ছে কিন্তু পুঁজি আসছে না। তার মানে এটাকে স্থবিরতাই বলা চলে।
দীর্ঘ ৪৫ বছরে ধরে চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতা টেনে অনুপম হায়াত বলেন, ১৯৬৪ সালে মুক্তি পায় কবরী ও বেবী জামান অভিনিত ও সুভাষ দত্ত পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘সুতরাং’। ওই সময় চলচ্চিত্রটি বানাতে খরচ হয়েছিল সোয়া এক লাখ টাকা আর আয় করেছিল সাড়ে ৮ লাখ টাকা। আজকে কেউ এর ধারে-কাছেও নেই।
১৯৭০ সালে মুক্তি পাওয়া রাজ্জাক, সুচন্দা, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল অভিনিত ‘জীবন থেকে নেয়া’ চলচ্চিত্রের প্রসঙ্গ টেনে অনুপম হায়াত বলেন, ছবিটির যখন নির্মাণের কাজ চলে তখন দেশের শাসন ক্ষমতায় আইয়ুব খান। সবকিছু স্থবির। ওর মধ্যেও চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে সেই সেনা শাসক আইয়ুব খানের একনায়কোচিত চরিত্রকে এক গৃহবধু নারীর মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন পরিচালক জহির রায়হান। আজকে এ ধরনের গল্প কি কল্পনা করা যায়?
ঝিমাচ্ছে এফডিসি
চলচ্চিত্রের উন্নয়নে বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভলপমেন্ট করপোরেশনও (এফডিসি) এখন আর ভূমিকা রাখতে পারছে না। ১৯৫৭ সালে যখন স্বয়ংসম্পূর্ণ ফিল্ম স্টুডিও ছিল শুধু বোম্বে, লাহোর, করাচি ও কলকাতায় তখন বাংলাদেশ অঞ্চলে চলচ্চিত্র শিল্পের বিকাশে সাড়ে ছয় একর জমির ওপর স্থাপন করা হয় এফিডিসি। এখানেই নির্মিত হয়েছে বাংলা চলচ্চিত্র ইতিহাসের কালজয়ী সব চলচ্চিত্র ও গান। আজ প্রতিষ্ঠানটি হারিয়ে ফেলেছে সেই গৌরব। গত বছর এফিডিসি’র তত্ত্বাবধানে মাত্র ২৬টি চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে। এর মধ্যে ৩টি ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায়।
প্রতিষ্ঠানটির ৯টি ইনডোর শুটিং ফ্লোরের প্রায় সবগুলোই বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে। দুটি বেসরকারি টিভি চ্যানেল ৭ ও ৮নং ফ্লোর দুটি ব্যবহার করছে। ফলে চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক, শিল্পী, কলা-কৌশলী ও গণমাধ্যমকর্মীদের পদচারনায় যে এফডিসি ২৪ ঘন্টাই সরগরম থাকতো আজ তা ঝিমিয়ে পড়েছে। অধিকাংশ সময় অলস সময় পার করছেন কর্মকর্তারা। তবে সবেচেয়ে বেশি বিপদে পড়েছেন চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ঠ সহশিল্পী, ফাইট ম্যান, স্ট্যান্ট ম্যান ও সেট ডিজাইনাররা। কাজ না থাকায় বেকার হয়ে পড়েছেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং চলচ্চিত্র গবেষক ফাহমিদুল হক বলেন, পুরোনো সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু সিনেপ্লেক্স হচ্ছে। আরেক দিকে এফডিসি’র কার্যকলাপ ক্ষয়িষ্ণু কিন্তু চলচ্চিত্র হচ্ছে ইন্ডিপেনডেন্টলি। এতে গত দেড় দুই দশক ধরে এফডিসিতে যে অশ্লিল চলচ্চিত্র নির্মাণ হতো সেটা বন্ধ হচ্ছে। তবে কোন চলচ্চিত্র সাড়া ফেলছে না, দর্শক টিকেট কেটে হলে গিয়ে সিনেমা দেখছে না। কিন্তু প্রযোজক, পরিচালকের পুঁজিরও সংকট হচ্ছে না। সেটা কোন প্রকল্প বা অনুদানের মাধ্যমে আগে থেকেই সিকিউরড থাকছে। বলা যায় এক ধরনের জোড়া-তালি দিয়েই চলছে এবং আগামী কয়েক বছর এভাবেই চলবে। সেটাই ধারনা করা যায়।
হারিয়ে গেছেন সিনেমার ব্যানার-পোস্টার শিল্পীরা
ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের এই দুর্দিনের অনেক আগেই হারিয়ে গেছেন হাতে করা সিনেমার ব্যানার-পোস্টার শিল্প ও শিল্পীরা। বিশেষ করে নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে বাজারে ডিজিটাল প্রিন্ট আসাতে শুরু করে। ফলে ২০০০ সালের মধ্যে হারিয়ে যায় সিনেমা সংশ্লিষ্ঠ এ শিল্প মাধ্যমটি।
ঢাকায় ৩০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান ছিল যাদের মূল কাজ ছিল সিনেমার ব্যানার ও পোস্টার করা। শহরের পল্টন ও কাকরাইল এলাকা যেমন ছিল চলচ্চিত্র বিতরণ ও বিপণনের কেন্দ্রস্থল তেমন ব্যানার ও পোস্টার তৈরির কেন্দ্রবিন্দু ছিল পুরোনো ঢাকা। এর মধ্যে বিখ্যাত ছিল নবাবপুর এলাকার রূপায়ন পাবলিসিটি, কোর্ট স্ট্রীটের শিল্পী আর্ট পাবলিসিটি ও মায়া পাবলিসিটি। তাঁতিবাজার এলাকার চিত্রকর, জুগিনগরের এসএম পাবলিসিটি, পল্টনের বিকেটি পাবলিসিটি এবং নারিন্দার ফারজানা আর্ট।
এঁদের মধ্যে পাইওনিয়ার ছিল রূপায়ন পাবিলিসিটি। সত্তুরের দশকের শুরুর দিকে প্রতিষ্ঠানটি শুরু করেন সুভাষ চক্রবর্তী ও ধীরেন দাস। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তারা প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিয়ে ভারতে স্থায়ী হন।
জানা গেছে, ওই ধীরেন দাসই ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রে সর্বপ্রথম চার রঙের পোস্টার আঁকেন। আজিম, আনোয়ার হোসেন ও আনোয়ারা অভিনিত এবং নজরুল ইসলাম পরিচালিত ওই চলচ্চিত্রটির নাম ছিল ‘স্বর্ণ কমল’।
এঁদের মধ্যে ঝুলনবাড়ি এলাকার এভারগ্রীন পাবলিসিটির মালিক ছিলেন এ জেড পাশা। তিনিই ডিজাইন করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার কার্জন হল সংলগ্ন দোয়েল চত্ত্বরের, মতিঝিল শাপলা চত্বরের। এনসিসি ব্যাংকের লোগোটিও তার করা।
আরও জানা গেছে, পল্টন এলাকার জিন পাবলিসিটির বাবুল চৌধুরী ঢাকাইয়া চলচ্চিত্রের সর্ব প্রথম চার রঙের কম্পিউটারাইজড পোস্টার তৈরি করেন। তার প্রথম চলচ্চিত্র ছিল যমুনা ফিল্ম করপোরেশনের ‘অবুঝ মনের ভালোবাসা’।

No comments

Powered by Blogger.