আহমদ শাহ মাসউদঃ মৃত্যুঞ্জয়ী এক মুজাহিদের গল্প by নাঈমুর রাহমান নবীন

৯ সেপ্টেম্বর ২০০১… কাল্পনিক দুই ব্যক্তির কথোপথনঃ
(গভীর রাত পেন্টাগনের নিজ অফিসের করিডোর এর সামনে পায়চারি করছেন এক সিআইএ কর্মকর্তা, তার হাতে চুরুট, ধোঁয়া মিশে যায় অন্ধকারে আর তার সময় কাটে উৎকণ্ঠায়… একটি ফোনের অপেক্ষায় প্রতি মুহর্ত যেন অসহ্য মনে হচ্ছে)
পাশের ঘর থেকে সহযোগী…
– স্যার কফি দিব?
– (ইতস্তত হয়ে) না… হুইস্কি পাঠাও।
– জি স্যার
– এই পাকিস্তানি বলদগুলো কোন কাজ যদি ঠিক মত করত, (পেগ শেষ করতে করতে নিজে নিজে বলতে লাগলেন)।

হঠাৎ করে তার ব্যক্তিগত ফোন বেজে উঠল,ফোন ধরতে ওপাশ থেকে ভারী কর্কশ গলায়…
অজ্ঞাতঃ কাজ হয়ে গেছে।
কর্মকর্তাঃ বডি কনফার্মড?
অজ্ঞাতঃ হুম।
৪০ বছর পূর্বে…
পাঞ্জশির উপত্যকার পাহাড়ে দাঁড়িয়ে একটি ৮ বছর বয়সী আফগান বালক। সন্ধ্যায় দিগন্তে পাহাড়ের আড়ালে কিভাবে সূর্য হারিয়ে যায় তা দেখতে তার বড় ভাল লাগে। বাবা দোস্ত মোহাম্মদ রয়েল আর্মির কর্নেল, শখ করে ছেলের নাম রাখেন “আহম্মাদ শাহ্”। বড় হয়ে তার নামের সাথে যুক্ত হয় “মাসউদ”। “আহম্মাদ শাহ্ মাসউদ” নামটি কারো জন্য আতঙ্ক, আবার কারো জন্য দেশপ্রেমিক এক নায়কের প্রতিমূর্তি। বাবা-মা’র ইচ্ছা সে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ুক, কিন্তু তার ইচ্ছা সে বাবার মত যোদ্ধা হবে। স্কুলের অধ্যয়ন শেষে নিজের অমত সত্ত্বেও কাবুল ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ভর্তি হন, ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া আবস্থায় ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিক দল জামাতি-ই-ইসলাম(১৯৭৯) এর সাথে জড়িয়ে পড়েন। যা মূলত ছিল মিশরের মুসলিম ব্রাদারহুড (Muslim Brotherhood) সমর্থিত আফগান এন্টি কমিউনিস্ট পার্টি।

“লায়ন অফ পাঞ্জশির”
১৯৭৮ সালে আফগান নবাবকে হত্যার মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে সোভিয়েত মদদপুষ্ট পাপেট কমিউনিস্ট সরকার। যা সাধারণ আফগানরা কখনো মেনে নিতে পারেনি। তারা বিদ্রোহ করে সরকার পতনের জন্য। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে রাশিয়ানরা আফগানিস্তান আক্রমণ করে (১৯৭৯)। পবিত্র ভূমিতে “নাস্তিক”দের পদার্পণ সাধারণ ধর্মপ্রাণ আফগানদের মনে বর্শার মত বিঁধে। শুরু হয় একটি অসম যুদ্ধের, বস্তুর সাথে অবস্তুর সংঘাত। রুশ লাল ফৌজদের নির্বিচারে হত্যা হতে বাদ যায়নি, শিশু,তরুণ, বৃদ্ধ এমনকি গর্ভবর্তী মহিলা পর্যন্ত। গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়িয়ে ফেলছে, ধর্ষণ, গনহত্যা, নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা মাত্র।
দেশের এই দুর্দিনে তরুণ মাসউদ পারলেন না ভোগবিলাসে জীবন কাটাতে। যার রক্তই যোদ্ধার, সে কি পারে যুদ্ধের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে? ছুটে গেলেন নিজ মাতৃভূমি পাঞ্জশিরে প্রতিরোধ গড়ে  তুলতে। পাঞ্জশিরকে বলা হয় আফগানিস্তানের হৃদয়। রুশ সেনারা সমগ্র আফগান দখল করে শুধু উত্তর প্রদেশ বাদে। রুশ সেনাদের একটি যুদ্ধে জেতার জন্য যা যা দরকার সবই ছিল, আধুনিক অস্ত্র, প্রযুক্তি, দক্ষ সেনা, গোয়েন্দা। কিন্তু সাধারণ কৃষক, পশুপালক আফগানদের ছিল তীব্র দেশপ্রেম আর ধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
অপ্রতিরুদ্ধ রুশ সেনারা এগিয়ে যাচ্ছিল পাঞ্জশির আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের মাঝ দিয়ে, সংখ্যায় তারা হাজার বা তার বেশি। আচমকা মাসউদ গেরিলা আক্রমণ করেন, দুই পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা নিরীহ কৃষক ঝাঁপিয়ে পড়ে রুশ সেনাদের উপর ক্ষুধার্ত বাঘের মত। রুশদের দম্ভ চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়, জয় হয় সত্যের। নয় বছর স্থায়ী আফগান যুদ্ধে একটিবারের জন্যেও তারা উত্তর প্রদেশ জয় করতে পারেনি।
অপরদিকে কোল্ড ওয়ার (COLD WAR) চলাকালীন সময় এরকম ব্যায়বহুল যুদ্ধ রাশিয়ার অর্থনীতির মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছিল। রুশরা বাধ্য হল আফগানিস্তান ত্যাগ করতে (১৯৮৯)। এটা ছিল মাসউদ যে অপ্রতিরুদ্ধ সোভিয়েত কমিউনিস্ট সরকারের বুকে শেষ ছুরি মারেন। “The wall street” জার্নালে তাকে আখ্যা দেওয়া হয়েছিল “The Afgan who won the cold war”।
১৯৯২ সালে তিনি কাবুল (আফগানিস্তানের রাজধানী) দখল করেন, আফগানিস্তানকে শত্রু মুক্ত ঘোষণা করেন। তাকে উত্তর প্রদেশের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হতে অনুরোধ করা হয়, কিন্তু তিনি তা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ঘরের শত্রু বিভীষণ
আফগানিস্তান একটি বহুজাতিক দেশ যেখানে বরাবরই Pastun/পশতুন বা পাঠানরা প্রতাপশালী ছিল। কিন্তু বুরাহানউদ্দিন রব্বানী, যিনি আফগান যুদ্ধের পর রাষ্টপতি হন, তিনি ও মাসউদ দুইজনই ছিলেন (Tajks) তাজাক্স জাতি। প্রভাব প্রতিপত্তিতে তাজাক্সরা পাঠানদের চেয়ে এগিয়ে গেল যা পাঠানদের কাছে ঈর্ষনীয়।একই সময় আফগান কম্যুনিস্ট অনুসারীরা স্বাধীন আফগান সরকারের বিরুদ্ধে নানা চক্রান্ত করে, যা অনেকটা জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় ঘি ঢালার মত। এতদিন যারা সোভিয়েতদের বিরুদ্ধে পরস্পরের কাঁধে কাঁধ রেখে নিজ মাতৃভূমির জন্য লড়াই করেছে তারাই আজ একে অপরের দিকে বন্দুক তাক করছে শুধু মাত্র নিজেদের জাতিগত স্বার্থের জন্য।
অপর দিকে আফগান যুদ্ধে অংশ নেয়া বিদেশি যোদ্ধা আল-কায়দার প্রধান ওসামা বিন লাদেন মাসউদকে অনুরোধ করেন তার সংগঠনের জন্য পাঞ্জশিরে একটি বেস ক্যাম্প স্থাপনের। কিন্তু মাসউদ আল-কায়দার উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন এবং তাদের হটিয়ে দেন। এমন অবস্থায় আল-কায়দার এমন একজনকে প্রয়োজন পড়ে যে আল-কায়দার হয়ে আফগানিস্তানে তাদের নিরাপত্তা দেবে।
ধর্ম যখন অস্ত্র
১৯৯৪ সালে দক্ষিণ আফগান-পাক সীমান্তে জড়ো হয় একদল মানুষ। এদের বেশি ভাগই পাকিস্তানে আফগান রিফিউজি, সোজা ভাবে বলতে গেলে পাক-গোয়েন্দা মদদপুষ্ট আফগান। তারা একটি সংগঠন তৈরি করল যার নাম দিল ‘তালেবান’। এক বছরের মধ্যে তারা গোটা আফগানিস্তানে ছড়িয়ে পড়ল দাবানলের মত। শুধু মাত্র মাসউদের অধীনস্থ উত্তর প্রদেশ বাদে সমগ্র আফগান তাদের মুখ গহ্বরে। তালেবান একটি অত্যাধুনিক সশস্ত্র সংগঠন যার জন্ম হয়েছে কিছু দেশত্যাগী তরুণদের হাত ধরে, যাদের ধর্মীয় ও আধুনিক শিক্ষার ক্ষেত্রে রয়েছে অজ্ঞতা এবং যারা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা পেয়েছে সৌদি আরব, এমনকি আমেরিকান পেট্রোলিয়াম কোম্পানির।
অর্থনীতির ভাষায় বলা চলে, তালেবান হল একটি ইন্ডাস্ট্রি যেখানে বিনিয়োগকারীদের সর্বোচ্চ মুনাফালাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বীকে সরানো একান্তই জরুরী। তাই মাসউদের মৃত্যুটা অনেকটা অনিবার্য ছিল।
২০০১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর, ৯/১১ হামলার দুইদিন আগে। দুইজন বিদেশি সাংবাদিকের ছদ্মবেশে আল-কায়দার দুইজনের আত্মঘাতী হামলাকারীর শিকার হন মাসউদ। আজও ৯ই সেপ্টেম্বর মাসউদ স্মরণে আফগানিস্তা শহীদ দিবস হিসেবে পালিত হয়।
মাসউদের সবচেয়ে বড় অপরাধ ছিল তিনি ছিলেন সুন্নি হানাফি মুসলিম। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন একটি গণতান্ত্রিক স্বাধীন দেশের, যেখানে গণতন্ত্র হবে ইসলামের আদলে। তিনি সেই গণতন্ত্রকে চাইতেন না,যেখানে প্রগতিশীলতার নামে ইসলামকে জাদুঘরে বন্দী করে রাখা হয়।
আহম্মাদ শাহ্ এর মাসউদ হয়ে ওঠা ছিল ‘শীতল যুদ্ধের অবসান’, আর তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে সূচনা হল সন্ত্রাসবাদ নির্মূল নামে নতুন সাম্রাজ্যবাদের উথান। ৯/১১-এর গল্পটা ছিল আহম্মাদ শাহ্ মাসউদের গল্প।

>>নিয়ন আলোয়
তথ্যসূত্রঃ
– নিউ ইয়র্ক টাইমস ১
– নিউ ইয়র্ক টাইমস ২
– দি ফেমাস পিপল
– আল জাজিরা

No comments

Powered by Blogger.