নগর জীবন: কাবুলের শহুরে চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা by আলি এম লতিফি
যানজট এখন কাবুল শহরের অতিপরিচিত দৃশ |
বছর দুই আগে কাবুলের পশ্চিম পাশের পাহাড়ি এলাকার অস্থায়ী বাড়িগুলো প্যাস্টেল রঙে রঙিন হতে শুরু করে।
রাজধানী কাবুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধির অংশ হিসেবে কাবুল মিউনিসিপ্যালিটির প্রকল্পের অংশ ছিল এটা।
পাহাড়ি জয়-ই শির এলাকার বাসিন্দা – যেখানকার অধিকাংশ বাড়িই অনেকটা
অস্থায়ী ধরনের, তাদেরকে লাল, কমলা, নীল, হলুদ এবং সাদার মধ্য থেকে যে কোন
একটাকে বেছে নেয়ার সুযোগ দেয়া হয়।
৩০ বছর বয়সী ইট শ্রমিক হাবিব রহমান পুরো জীবনটাই কাটিয়েছেন ওই পাহাড়ি এলাকায়। এই পদক্ষেপে তিনি বেশ খুশি।
আল জাজিরাকে তিনি বলেন, “হাঁ, এটা একটা ভালো বিষয়”।
বিশ্বের সবচেয়ে আধুনিক শহরগুলোর রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা সম্প্রতি
কলম্বিয়া মেডেলিনে ওয়ার্ল্ড সিটিজ সামিটে মিলিত হয়ে নগরায়নের চ্যালেঞ্জ এবং
ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে ভালো চর্চাগুলো নিয়ে আলোচনা করেন। সেই সময়টাতেই
নিরাপত্তা ও পরিবেশগত উদ্বেগের মধ্যে বসবাসরত কাবুলের নাগরিক ও বিশেষজ্ঞরা
সেখানে আরও উত্তম শহর কৌশল ও জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন।
‘একদিন পর পর পানি’
২০১৪ সালের আগস্টে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে বর্তমান আফগান প্রেসিডেন্ট আশরাফ
ঘানি বলেছিলেন যে, বহু দশকের যুদ্ধের কারণে কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ আফগান নাগরিক
অস্থায়ী ধরনের ঘরে বাস করছে, যে কারণে ব্যাপক হারে মানুষের স্থানান্তর
ঘটেছে এবং দেশের নগর কেন্দ্রগুলোর উন্নয়নে যথাযথ পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ নেয়া
যায়নি।
সে সময় প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন ঘানি। তিনি বলেছিলেন যে, তিনি ‘সমস্ত
অস্থায়ী ঘরকে স্থায়ী রূপ দিতে চান কারণ জনগণের সম্পত্তির অধিকার সৃষ্টি
হলেই কেবল তারা পুলিশ ও আদালতের সেবা নিতে পারে”।
কিন্তু পুরো দেশ জুড়ে যেখানে হাজার হাজার অস্থায়ী ঘর, আদালত ব্যবস্থায়
যেখানে স্থবিরতা এবং দুর্নীতির চ্যালেঞ্জ, সেখানে পাঁচ বছর পরে এসেও
লক্ষ্যে পৌঁছা থেকে বহু দূরে অবস্থান করছেন ঘানি।
জয়-ই শির এলাকার বাসিন্দারা বলেছেন যে, বসতবাড়ির শৈল্পিক সৌন্দর্য
বাড়ানোর এই প্রচেষ্টাকে তারা সাধুবাদ জানান, কিন্তু একটা অপরিকল্পিত বসতিতে
বাস করার যে নানাবিধ সমস্যা রয়েছে, সেগুলো থেকে তাদের মুক্তির জন্যও
ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
দুই বছর আগে নগর কর্তৃপক্ষ শহরের পাহাড়গুলোর পৃষ্ঠদেশ রঙ্গীণ করতে শুরু করে, ছবি: আলি লতিফি |
স্থানীয়রা জানান, পাহাড়ে উপরে উঠার কোন পাকা রাস্তা না থাকায়
স্বাস্থ্যসেবা, স্কুলে যাতায়াত ও মৌলিক প্রয়োজন মেটাতে তাদেরকে অন্তত দুই
ঘন্টা ধরে উঠানামা করতে হয়।
যদিও পাহাড়ি এলাকায় কূপ ও ট্যাপ রয়েছে, কিন্তু পানির সঙ্কট সেখানে লেগেই আছে।
রহমান বলেন, “আমরা পানি পাই একদিন পর পর”।
এশিয়া ফাউন্ডেশান ২০১৮ সালে আফগান জনগণের উপর একটা জরিপ চালায়। সেখানে
দেখা গেছে যে, কাবুল প্রদেশের ৫৫.৪ শতাংশ নাগরিকের সুপেয় জলের সুবিধা নেই,
এবং এই সমস্যা আরও বাড়ছে। জরিপে অংশ নেয়া আরও ৪৭.১ শতাংশ নাগরিক জানিয়েছেন,
বিদ্যুৎ ও পানিসহ অন্যান্য ইউটিলিটি সেবা পাওয়ারও সুযোগ নেই তাদের, যেটা
তাদের কাছে একটা প্রধান চ্যালেঞ্জ।
‘নিরাপত্তা চায় মানুষ’
নাদেরা আর রহমান যে অভিজ্ঞতার মোকাবেলা করেছেন, সেটা আলাদা কিছু নয়। শহরের দারিদ্রপীড়িত এলাকাতেই যে শুধু সমস্যা, তা-ও নয়।
এমনকি শহরের আরও উন্নত অংশেও নাগরিকরা নানা ধরনের চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। এর একটা হলো অপরাধের মাত্রা বৃদ্ধি।
সাত বছর ধরে হামিদ মোহাম্মদি এআইবি ভবনে কাজ করেছেন। ১০ তলা এই ভবনটিতে
৯০টি পরিবার বাস করে। দুটো ব্যাংকের শাখা আছে এখানে। আর আছে কয়েক ডজন
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। রাজধানীর বাণিজ্যিক কেন্দ্র শের-ই-নওয়ে এই ভবনটির
অবস্থান।
পরিবেশ দূষণ কাবুল শহরের আরেকটি বড় সমস্যা, ছবি: আলি লতিফি |
তিনি বলেন, কাবুলের নাগরিকদের সামনে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো
নিরাপত্তা। রাস্তাঘাটের অপরাধ ছাড়াও রয়েছে তালেবান ও আইসিসের মতো
সংগঠনগুলোর হামলা। গত কয়েক বছর ধরে তারা বেশি করে শহুরে এলাকাগুলোকে
টার্গেট করছে।
একটা আধুনিক ভবন, যেখানে ভাড়ার পরিমাণ মাসে এক হাজার ডলারেরও বেশি, সেটা
দেখিয়ে মোহাম্মদি বললেন, “সৌন্দর্যের চেয়েও জনগণ এখন নিরাপদ জায়গা খুঁজছে
থাকার জন্য”।
“একটা ফ্যান্সি নতুন ভবনে থেকে কি লাভ যদি কয়েক মিনিট হাঁটলেই আপনাকে ছিনতাইকারীর কবলে পড়তে হয়?”
বায়ু দূষণ
সারাদেশে কয়েক দশকের সঙ্ঘাতের কারণে বিভিন্ন এলাকার মানুষ কাবুলে আশ্রয় ও
সুযোগ সুবিধা খুঁজতে শুরু করার কারণে শহরের জনসংখ্যা এখন পাঁচ মিলিয়ন
ছাড়িয়ে গেছে। এটা শহরের বায়ু দূষণ বাড়িয়েছে, কারণ মানুষ বেড়ে যাওয়ায়
যানবাহনের সংখ্যা বেড়েছে এবং এই যানবাহনগুলোর অনেকগুলোতেই নিম্নমানের
জ্বালানি ব্যবহার করা হচ্ছে। অনেকে শীতের সময় ঘর গরম রাখতে কয়লার চুলা
ব্যবহার করেন এবং এই চুলার ব্যবহারও এখন অনেক বেড়ে গেছে।
২০১৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক হিসেবে দেখা গেছে যে,
আফগানিস্তানে ১৭ হাজারেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর সাথে বায়ু দূষণের যোগ
রয়েছে।
কাবুলে শিশুদের জন্য বিনোদনেরও তেমন সুযোগ নেই, ছবি: আলি লতিফি |
ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল প্রটেকশান এজেন্সির (এনইপিএ) ডিরেক্টর জেনারেল
শাহ জামান মায়ওয়ান্দি বলেন, সাধারণভাবে আফগানিস্তান এবং বিশেষভাবে এর নগর
কেন্দ্রগুলোতে বেশ কিছু পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ প্রকট হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে
রয়েছে বায়ু দূষণ, স্বচ্ছ পানির সুবিধা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ঘাটতি।
তবে তিনি স্বীকার করেন যে, বায়ু দূষণ কমিয়ে আনা এবং নিয়ন্ত্রণ করাটা সবচেয়ে কঠিন কাজ।
“বায়ু দূষণ ঘটানোর মতো অনেক কিছু রয়েছে এবং যেহেতু এটা বাতাসের মধ্যে রয়েছে, তাই সমাজের সব শ্রেণীকেই এর মুখোমুখি হতে হচ্ছে”।
নতুন কিছু নিয়ে আসা
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কাবুলে নামি দামি রেস্তোরাঁ ও ক্যাফের সংখ্যা বেড়েছে, যাদের টার্গেট হলো অবস্থাসম্পন্ন পরিবার ও তরুণ প্রজন্ম।
২০১৬ সালে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানের তরুণ গ্রাজুয়েট আহমেদ
ফরিদ আমিরি কাবুলের কেন্দ্রস্থলে স্লাইস বেকারি ও ক্যাফে চালু করেন, যেটা
দ্রুত তরুণ আগফানদের আড্ডা দেয়ার একটা জায়গা হয়ে উঠেছে।
বহু বছর ধরে রাজধানীতে বেশ কিছু উচ্চমূল্যের রেস্তোরাঁ ছিল, যেগুলোর
অবস্থান ছিল কাবুলের নিরাপত্তা বেষ্টনির ভেতরে এবং বিদেশীরাই ছিল মূলত
সেখানকার ক্রেতা। কিন্তু স্লাইসের মতো রেস্তোরাঁগুলোর সাফল্যের পর শহরে
রেস্তোরাঁর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। স্লাইসের কাছাকাছির মধ্যেই এখই আরও তিনটি
রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে, যেখানকার মূল ক্রেতা মূলত আফগানরাই।
তবে, আমিরি বললেন, তার রেস্তোরাঁ যদিও এই ধারা বদলে দিয়েছে এবং কাবুলের
খাবারের পরিস্থিতিতে পরিবর্তন নিয়ে এসেছে, কিন্তু তাদের জন্য সরকারের
সহায়তা খুবই সীমিত।
আমিরি বলেন, “আমাদের এখানে অন্তত ৭০ জন কাজ করে; আমরা আফগান পানি ও সোডা
কিনি; আমাদের পেস্ট্রির কাঁচামালগুলোও স্থানীয় বাজার থেকে কেনা; কিন্তু
এরপরও আমরা কোন ধরনের কর ছাড় বা সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা পাই না”।
জনাকীর্ণ হয়ে পরা কাবুল শহরে এখন তৈরি হচ্ছে বহুতল ভবন, ছবি: আলি লতিফি |
No comments