প্রতিবেশীসুলভ হও by দেব মুখার্জী

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩রা অক্টোবর থেকে ৬ই অক্টোবর পর্যন্ত চারদিনের ভারত সফর সম্পন্ন করেছেন। এ সময়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে আলোচনার পাশাপাশি তিনি বক্তব্য রেখেছেন ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ইন্ডিয়া ইকোনমিক সামিটে। এই সফরের পরে যে যৌথ বিবৃতি দেয়া হয়েছে, তাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপের পারস্পরিক প্রশংসা করা হয়েছে। জোর দেয়া হয়েছে বন্দর ব্যবহারে, সংযুক্তি বা কানেক্টিভিটি, পানি বন্টন, বিদ্যুত, গ্যাস, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও প্রতিরক্ষার ওপর। বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত’ ব্যক্তিদের দুর্ভোগের রেফারেন্স তুলে ধরা একটি ইতিবাচক দিক। প্রথমদিকে এই ইস্যুতে মিয়ানমারের দৃষ্টিভঙ্গি দ্রুততার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল ভারত। বাংলাদেশ আশা করছে এর মধ্য দিয়ে ভারত তার সেই ভুল সংশোধন করে নিচ্ছে। ২০১০ সালে শেখ হাসিনার সফরের পরে ইস্যু করা একটি যৌথ বিবৃতিতে যদি কোনো দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি থাকে, তাহলে তা অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, সন্দেহের ও শত্রুতার এক অন্ধকার সময়ের পরে সম্পর্কের উন্নয়ন করার প্রচেষ্টা এটা।
বর্তমানে এই সম্পর্ক অনেকটাই পরিপক্ব। জোরালো ধারাবাহিকতা ও আন্তঃনির্ভরতার প্রকল্পগুলো নেয়া সম্ভব হচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের মধ্যে একটি সুবর্ণ সময়ের প্রত্যাশা করছেন শেখ হাসিনা। 
মতভেদের বাইরে গিয়ে, যা সাধারণত উচ্চ পর্যায়ের যৌথ বিবৃতি অনুমোদন করে সেখানে এক পক্ষ স্পর্শকাতর ইস্যুতে অন্ধকারে থেকে যায়। এক্ষেত্রে, রেকর্ড অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বক্তব্য রেখেছেন ইন্দো-বাংলাদেশ বিজনেস ফোরামে। সেখানে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যত কল্যাণের গুরুত্বপূর্ণ কিছু পয়েন্ট জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন। এই প্রেসক্রিফশনের প্রথমটিতে বলা হয়েছে, ‘আমাদেরকে অবশ্যই সংখ্যাগরিষ্ঠ-সংখ্যালঘিষ্ট মানসিকতা পরিহার করতে হবে। প্লুরালিজম অথবা বহুত্ববাদই হয়েছে শক্তিশালী। তাই আমাদেরকে দক্ষিণ এশিয়ার ধর্ম, জাতি ও ভাষাগত বৈচিত্রকে সেলিব্রেট করা উচিত।’ এটা তার নিজের দেশ সহ সবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু হয়নি। কিন্তু বর্তমান ভারতের ‘এস্টাবলিশমেন্টের’ কাছে এটাকে দেখা হতে পারে একটি অবগুণ্ঠিত উপদেশ হিসেবে।
আরেকটি প্রেসক্রিপশনে বলা হয়েছে, ‘বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ম্যানেজ করতে হবে। আসুন আমাদের নিজেদের জনগণের স্বার্থে আঞ্চলিক রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রশংসা করি ও ভারসাম্য রক্ষা করি। আমরা সাময়িক সময়ের অর্জনের কাছে দীর্ঘমেয়াদি স্বার্থকে ছেড়ে দিতে পারি না।’ এটা হতে পারে রাষ্ট্রের মৌলিকত্বের জন্য সার্বজনীন। কিন্তু ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার বিষয়ে তার দেশের যেসব মানুষ অনিচ্ছুক তাদের প্রেক্ষিত বিবেচনা করে দেখা যেতে পারে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে বিএনপির সদস্যরা ভারত সফর করেন দুটি বিষয়ে ভারতকে রাজি করাতে। তাদের সেই দুটি বিষয়ের প্রথমটি হলো, তারা যদি পুনরায় নির্বাচিত হয় তাহলে তাদের এ যাবতকালের ভারত বিরোধী অবস্থান ত্যাগ করবে। এর ফলে তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সহযোগিতার একটি পথ তৈরি হবে। দ্বিতীয় বিষয়টি ছিল, বাংলাদেশের জনমত দ্রুতই আওয়ামী লীগের অপশাসনের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। তাই ভারত যে আওয়ামী লীগের প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, নিজেদের স্বার্থে তাদের সেটা আর মনে করা উচিত নয়। ভারতে যারা গেম-খেলোয়াড় তাদের দেখে মনে হয়েছে বিএনপির যুক্তি তাদের কাছে ভিন্ন কিছু বলে মনে হয়নি। বাংলাদেশে সরকার বেছে নেয় এ দেশের মানুষ। এক্ষেত্রে ভারতের অনুমোদনের বিষয়টি শুধুই বিবেচ্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এই ধারণাই অনেক বড় ব্যাপার। ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির প্রতি ভারতের আপাতদৃষ্টিতে সমর্থন এবং এর পরিণামের বিষয়টি হালকাভাবে ভুলে যাওয়া উচিত নয়।
দুই দফায় ক্ষমতায় থাকার পর, যদি জনগণের মনোযোগ আওয়ামী লীগ সরকারের প্রতি বিরূপ হয়ে ওঠে তাহলে তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু ছিল না।  কিন্তু হিসাব নিকাশের ক্ষেত্রে  যুক্ত হওয়া উচিত মসৃণভাবে জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়া, অর্থনেতিক কর্মকাণ্ডের সব নিয়ামকের উন্নতি এবং একই সঙ্গে আইন শৃংখলার উন্নতি। সর্বোপরি বিদেশী সমর্থনপুষ্ট জিহাদি কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে রয়েছে পুশব্যাকের প্রতিশ্রুতি। শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পূর্ববর্তী সময়ের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। স্মরণ করা যেতে পারে অসহায়ত্বের কথা, রাষ্ট্র ও এর মিত্রদের মদতে তখন উগ্রবাদের উত্থান ঘটেছিল।
যুক্তি দেয়া হতে পারে যে, বর্তমানে বাংলাদেশ সমালোচনার ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা দেখাচ্ছে। ফটোসাংবাদিক শহিদুল আলমের বিরুদ্ধে মামলার অভিযোগ ব্যাখ্যামুলক। দুর্ভাগ্যজনক হলো, এটা এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে ভারতীয়রা এখন কোনো পরামর্শ দেয়ার সুযোগ নিতে পারে না।
কয়েক মাস ধরেই বাংলাদেশের কাছে উদ্বেগের বিষয় এনআরসি। সর্বোচ্চ পর্যায়কে বার বার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে, তাদের উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। এক্ষেত্রে দৃশ্যত ফর্মুলা হতে পারে যে, এনআরসি হলো আসামে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনা। এখনও এ প্রক্রিয়ায় আপিল করার অনেকগুলো ধাপ আছে। যারা এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা দরিদ্র ও অশিক্ষিত। এখন প্রশ্ন হলো কিভাবে আপিল প্রক্রিয়ার সুবিধা, তারা কোন পর্যায়ে, কিভাবে নেবেন তা নিয়ে। প্রক্রিয়াটি যখন শেষ হয়ে যাবে তখন এ বিষয়ে কি করা হবে সে বিষয়ে কোনো সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন, আমাদেরকে বলা হয়েছে এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এখন উত্তমের মধ্যে সেরা। তবে একই সঙ্গে আমরা আমাদের চোখ খোলা রাখছি (এনআরসি ইস্যুতে)।
এখানে ‘বর্তমানে’ এবং ‘আমাদের চোখ খোলা’ শব্দগুলো গাফিলতি করে উচ্চারণ করা হয় নি। সারা ভারতে এনআরসি হতে পারে ব্যাপক অর্থে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের একটি বিষয়। কিন্তু এর পরিণতি বাংলাদেশের ওপর পড়ে এবং ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দূরে সরে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটি বড় প্রমাণ হতে পারে।
ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ভারসাম্যের দিকে তাকিয়ে এটা স্বীকার করা যায় যে, এতে লেজারটি বাংলাদেশের পক্ষেই, সম্ভবত অনেকটা বেশি ঝুঁকে যেতে পারে। গঙ্গা পানি চুক্তি সরিয়ে রাখা হয়েছিল। এতে উভয় দেশের মধ্যে স্থায়ীভাবে একটি বড় সমস্যা সৃষ্টি হলো। দীর্ঘদিনের জমে থাকা আবেগ তুলে ধরে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইস্যুটিকে গঠনমুলকভাবে তুলে ধরে বড় ধরনের রাজনৈতিক সাহস প্রদর্শন করেন। স্থল ও নৌ সীমান্ত বিষয়ক চুক্তিতে পারস্পরিক সুবিধা হয়েছে। এতে তারা পারস্পরিক আলস্যের শিকারে পরিণত হয়েছে। চূড়ান্তভাবে তা বিজেপি চার বছরের জন্য অচল করে রাখে। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জঙ্গিদের বিষয়ে দীর্ঘদিন উদ্বিগ্ন ছিল ভারত। কিন্তু তাদেরকে সমর্থন দেয়ার বিষয়ে ভারতের যে উদ্বেগ সে বিষয়ে বিস্তৃতভাবে দৃষ্টি দিয়েছে বাংলাদেশ। নিজের পক্ষ থেকে ভারত তিস্তার পানি দিতে অব্যাহতভাবে অক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে গঙ্গা ব্যারেজ নিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক  ও রাজনৈতিক সুবিধা। তবে বাইরের তহবিল পাওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে উপযুক্ত হিসেবে তুলে ধরতে পারেনি ভারত। বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া, নেপাল ইনিশিয়েটিভ বা বিবিআইএন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্ব ব্যাখ্যাতীত। এমনকি ভারত যদিও এক্ষেত্রে প্রধান দায়বদ্ধ নয়, তবু তাদের কাছে অধিকতর মনোযোগ আশা করা যেতে পারে।
শেষ দফায় বলতে হয়, ভারতে ঘৃণাপ্রসূত অপরাধ এবং মুসলিমদের পিটানোর ঘটনা জনগণের ধারণাকে ক্ষতিগ্রস্ত করা ছাড়া আর কিছু করতে পারে না। এখানে আওয়ামী লীগ সরকারকে কৃতিত্ব দেয়াই যায়। কারণ, আমরা ১৯৯২ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর যে প্রতিক্রিয়া দেখেছি তার বিবেচনায় এখনও আমরা জনগণের পক্ষ থেকে কোনো শত্রুতাপূর্ণ প্রতিক্রিয়া দেখি নি। তবে এটা হতে পারে ধীর গতির গলন। আন্তরিকভাবে কেউ আশা করতে পারেন যে, আমরা প্রতিবেশীর সঙ্গে যে গঠনমূলক সম্পর্ক উন্নত করেছি তা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিচ্যুতির কারণে বিচ্যুত হোক।
(লেখক বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের সাবেক হাই কমিশনার। অনলাইন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত তার লেখার অনুবাদ)

No comments

Powered by Blogger.