সময়ের স্লোগান ও বাংলাদেশ by শফিক রহমান

‘আমার ভাই মরে যায়, নৌমন্ত্রী হেসে যায়’ ঢাকা বিমানবন্দর এলাকার ফুট ওভার ব্রীজের গায়ে শিশুর হাতে লেখা এই লাইনটি শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের একটি স্লোগান। গত বছর বেপরোয়া বাস চাপায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় পরিবহন শ্রমিক নেতা এবং তৎকালীন মন্ত্রী শাজাহান খানের ‘হাসিমাখা মুখে’ মন্তব্যের প্রতিবাদে এটা ছিল শিক্ষার্থীদের কড়া প্রতিবাদ।
শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলন ঝড় তুলেছিল দেশে-বিদেশে সবখানে। ব্যানার হাতে মিছিল করে সংহতি জানায় ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী। তারাও স্লোগান তোলে ‘চলুক গুলি টিয়ার গ্যাস, পাশে আছি বাংলাদেশ’।
এখনও আন্দেলন সংগ্রামের প্রসঙ্গ উঠলে নিকট অতীতের ওই আন্দোলনের প্রসঙ্গ্ই টেনে আনেন বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, সরকারের ভিতকেই নাড়া দেয় শিক্ষার্থীরা যখন তারা স্লোগান তোলে- ‘রাষ্ট্রের সংস্কার চলছে, সাময়িক অসুবিধার জন্য দুঃখিত’।
‘স্লোগানে স্লোগানে রাজনীতি’ শীর্ষক বইয়ের লেখক সাংবাদিক, গবেষক আবু সাঈদ খান বলছেন, মিছিলই স্লোগানের সূতিকাগার। যত স্লোগান আছে; তার বিরাট একটি অংশ মিছিলেই রচিত। তবে বাস্তব বিচারে শুধু মিছিলই নয়, আন্দোলনও স্লোগানের সূতিকাগার। সেটা রাজনৈতিক বা সামাজিক যে ধরনের আন্দোলনই হোক না কেন। উন্নয়ন, লক্ষ্য অর্জন, দারিদ্র বিমোচনসহ আরও অনেক কর্মসূচি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে আন্দোলন হিসেবে ধরে নিয়ে সেখানেও স্লোগান আছে।
প্রচার-প্রপাগান্ডায় স্লোগানের ব্যবহার তাও নতুন কিছু নয়। বিমানবন্দর এলাকার সেই ফুট ওভার ব্রীজ থেকে পশ্চিম দিকে কিছু দূর এগুলেই খিলক্ষেত এলাকায় পল্লী বিদ্যুৎ বোর্ডের প্রধান কার্যালয়। যার ১০ তলা ভবনের দেয়াল জুড়ে লম্বালম্বি ব্যানারে ঝুলছে স্লোগান ‘শেখ হাসিনার উদ্যেগ – ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’। দেশের বিদ্যুৎ খাতে তার সরকারের সাফল্যের প্রচারে এ স্লোগান।
ওই খিলক্ষেত এলাকাতেই আরেকটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) ডিপো। যার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক তলা বা দোতলা বাসগুলোর গায়ে দেখা যায় একটি স্লোগান ‘সুনাগরিক আর দক্ষ চালক, গড়তে পারে নিরাপদ সড়ক’। রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পাশেই বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়। তার দেয়ালে লেখা রয়েছে- ‘সড়ক দুর্ঘটনা আর নয়, সবাই মিলে করবো জয়’।
বলা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পর এ ধরনের কয়েকটি স্লোগানই ধারণ করছে বিআরটিসি, বিআরটিএ তথা রাষ্ট্র। অথচ, গত বছরের ২৯ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত টানা আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের মুখে মুখে স্লোগান ছিল, ‘আর কিছু নয় নিরাপদ সড়ক চাই’; ‘We want justice’; ‘We want safe Bangladesh’; ‘We don’t want digital Bangladesh, We want safe Bangladesh’; ‘4g স্পিড নেটওয়ার্ক নয়, 4g স্পিড বিচার ব্যবস্থা চাই’।
শাজাহান খানকে উদ্দেশ্য করে শিক্ষার্থীদের মুখে ছিল আরও কয়েকটি স্লোগান। যেমন, ‘স্বার্থক জনম মাগো জন্মেছি এই দেশে, গাড়ি চাপায় মানুষ মরে মন্ত্রীসাহেব হাসে’; ‘মুজিবকোটে মুজিবকেই মানায়, চামচাদের না’; ‘ছাত্রদের আন্দোলন, নৌমন্ত্রীর নির্বাসন’। বলা হয়, আক্ষরিক অর্থেই শাজাহান খানের নির্বাসন ঘটেছে। বর্তমান মন্ত্রীপরিষদে আর ঠাই পাননি তিনি।
শিক্ষার্থীদের স্লোগানে আক্রমন ছিল প্রধানমন্ত্রীকেও। ‘Dear Mother of Humanity, সন্তানের মৃত্যুতে ‘মা’ কিভাবে চুপ থাকে’; ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজের স্বজন হত্যার বিচারতো করলেন, আমাদের ভাই বোনের হত্যার বিচার কি হবে’। শিক্ষার্থীদের ওই আন্দোলনের মধ্যেই ৬ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভায় খসড়া সড়ক নিরাপত্তা আইন অনুমোদন করা হয়। যেখানে ইচ্ছাকৃতভাবে গাড়ি চালিয়ে মানুষ হত্যায় মৃত্যুদণ্ড এবং বেপরোয়াভাবে চালিয়ে কারো মৃত্যু ঘটালে সর্বোচ্চ পাঁচবছর কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়। যদিও বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে হত্যাতেও মৃত্যুদণ্ড দাবি ছিল আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের।
আন্দোলনে পুলিশ চড়াও হলেই শিক্ষার্থীদের মুখে শোনা যেত স্লোগান ‘পুলিশ ছাত্র ভাই ভাই, ভাই হত্যার বিচার চাই’। এছাড়া স্লোগানে অশ্লিল ভাষায়ও পুলিশদের আক্রমন করা হয়েছে। চড়াও এবং স্লোগানে আক্রমনের এ ঘটনাও নতুন নয়। পাকিস্তান আমলেই বহুল পরিচিত একটি স্লোগান ছিল ‘পুলিশ তুমি যতই মারো, বেতন তোমার একশো বারো’। আবু সাঈদ খান জানাচ্ছেন, সে সময়ে পুলিশের মাসিক বেতন ছিল একশো বারো টাকা। পরে বিভিন্ন সময়ে স্লোগানে হাজার বারো, দু’হাজার বারো, তিন হাজার বারো বলা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের পটভূমিতে শ্রমিক আন্দোলনের প্রধান ধ্বনি- ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ সম্ভবত সবচেয়ে সাড়া জাগানো স্লোগান। ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ মুক্তিকামী মানুষের বহুল উচ্চারিত স্লোগান। ১৮৫৭ সালে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতাযুদ্ধে সিপাহিরা আওয়াজ তুলেছিল-‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে স্লোগান ছিল ‘জয়হিন্দ’ ও ‘বন্দেমাতরম’। পাকিস্তান আন্দোলনে ধ্বনিত হয়েছিল ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রণধ্বনি ছিল ‘জয় বাংলা’। স্বাধীনতা-উত্তরকালেও জয় বাংলাই ছিল দেশের বন্দনাসূচক স্লোগান। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর রাষ্ট্রপতি হয়ে খন্দকার মোশতাক প্রথম উচ্চারণ করেন ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’।
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থী গ্রুপটি প্রথম ‘জয় বাংলা’ স্লোগান তোলে। গ্রুপটির তাত্ত্বিক নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান। ১৯৭০ সালের ৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সভামঞ্চের ব্যাকগ্রাউন্ডে এটি লেখা হয়। ওই বছর আওয়ামী লীগের জনসভা মঞ্চের সামনের অংশে ‘জয় বাংলা’ লেখা হয়েছিল। ১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি শেখ মুজিব ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ উচ্চারণ করেন। তবে ৭ মার্চ তাঁর কন্ঠে ছিল কেবল ‘জয় বাংলা’।
বর্তমানে শুধু আওয়ামী লীগই ‘জয় বাংলা’ স্লোগানটি দেয়। বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী দলসহ সমমনা সব রাজনৈতিক দলই দিচ্ছে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান।
১৯৭৫ সালের ওই সময়ে খন্দকার মোশতাকের আরেকটি স্লোগান ছিল-‘ধর্ম কর্ম গণতন্ত্র’। এর প্রায় কাছাকাছি ‘ধর্ম কর্ম সমাজতন্ত্র’ স্লোগানটি ছিল ন্যাপ (মোজাফফর) এর।
স্লোগানে বঞ্চনা ও বৈষম্য প্রসঙ্গ
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মুসলিম লীগ বিরোধী স্লোগানগুলোর মধ্যে কয়েকটি ছিল- ‘লীগ শাসনের দুর্গতি, দু’আনা হয় ম্যাচবাতি’; ‘লীগের পোলা বিলাত যায়, মোগো পোলা মইশ খেদায়’; ‘পাটের ন্যায্যমূল্য, দিতে হবে দিতে হবে’। মাঝখানে ৬৫টি বছর পার হয়েছে, রাষ্ট্র ক্ষমতায় মুসলিম লীগের স্থানে আওয়ামী লীগ। তখন দাবি উঠেছিল পাটের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তিতে আজকে সেখানে ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিতের দাবি। চলতি বোরো মওসুমে ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বাংলাদেশর কৃষকদের বঞ্চিত হওয়ার ঘটনায় সবাই যখন সরকারের নীতি কৌশলকে দায়ী করছেন তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে বৃদ্ধ এক রিকশা চালকের একটি ছবি। যে ছবিটিতে বৃদ্ধের পিঠে গেঞ্জির ওপর লেখা রযেছে- ‘আর করবো না ধান চাষ, দেখবো তোরা কি খাস’।
গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের কোটা বিরোধী আন্দোলনও ছিল ধারাবাহিক বঞ্চনা ও বৈষম্যের বহিপ্রকাশ। তখনও শিক্ষার্থীদের মুখে শোনা যায়- ‘বেকাররা বৈষম্য থেকে মুক্তি চায়’; ‘বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই’; ‘শেখ হাসিনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই’; ‘কোটা দিয়ে কামলা নয়, মেধা দিয়ে আমলা চাই’।
পরে শিক্ষর্থীদের ওই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে ওই বছেরের ১১ এপ্রিল জাতীয় সংসদে কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী এবং ৩ অক্টোবর সরকারি চাকরিতে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির নিয়োগের ক্ষেত্রে সব ধরনের কোটা না রাখার সুপারিশ অনুমোদন করে মন্ত্রিসভা।
এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজের প্রস্তাবনায় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চ শিক্ষার ওপর ১০ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট চালুর প্রস্তাব করেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। পরবর্তীতে সমালোচনার মুখে তা কমিয়ে ৭.৫ শতাংশ করা হয় এবং ১ জুলাই ২০১৫ থেকে কার্যকর করা হয়। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদেও রাস্তায় নেমে শিক্ষার্থীরা স্লোগান তোলে- ‘বাপের টাকা ঘুষের না, ভ্যাট মোরা দেব না’; ‘ভ্যাট দিবে আমার বাপ, মজা লুটবে কার বাপ’; ‘আমরা শিক্ষার্থী, মাল না’; ‘NO VAT ON EDUCATION’; ‘শিক্ষা কোন পণ্য নয়, শিক্ষা আমাদের অধিকার’; ‘জয় বাংলা, VAT সামলা’।
পরে ১৪ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার বৈঠকে উচ্চ শিক্ষায় ভ্যাট চালুর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নেয়া হয়।
ভোট ও ভোট দিবসের স্লোগান বিতর্ক
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়কে বলা হয় স্বাধীনতার প্রথম সীকৃতি। কিন্তু সেই নির্বাচন নিয়েও ছিল বিভক্তি। স্লোগানেই তার প্রমান পাওয়া যায় যেমন, ভাসানী ন্যাপ এর স্লোগান ছিল- ‘ভোটের আগে ভাত চাই/ আমরা করেছি পণ/ হতে দেব না নির্বাচন’। এর জবাবে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল- ‘আমরাও করেছি পণ, হতেই হবে নির্বাচন’।
ভারতের নকশালবাড়ি আন্দোলনের অনুকরণে গঠিত বাংলাদেশের নকশালপন্থীরাও তখন নির্বাচনের বিরুদ্ধে স্লোগান তোলে যেমন- ‘তোমরা করো নির্বাচন, আমরা চললাম সুন্দরবন’; ‘ভোটের বাক্সে লাথি মার, স্বাধীন পূর্ববাংলা কায়েম কর’। এর জবাবে ছাত্রলীগের নূর আলম সিদ্দিকীর নেতৃত্বের স্বায়ত্তশাসনপন্থীরা স্লোগান তোলে- ‘বাঁশের লাঠি হাতে ধর, পাতি বিপ্লবী খতম কর’। ছাত্রলীগের আ স ম আবদুর রব সমর্থিত স্বাধীনতাপন্থীদের স্লোগান ছিল- ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’; ‘৬ দফার আসল কথা, স্বাধীনতা স্বাধীনতা’।
এর ফাঁকে জামায়াতে ইসলামী স্লোগান দেয়- ‘ভোট দিন পাল্লায়, খুশি হবে আল্লায়’ (পরবর্তীতে বিভিন্ন সময় দলটিকে এই স্লোগানটি ব্যবহার করতে দেখা গেছে)। এর জবাবে আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল-‘ভোট দিলে পাল্লায়, দেশ যাবে গোল্লায়’; ‘স্বাধীনতার শপথ নিন, নৌকা মার্কায় ভোট দিন’; ‘পদ্মা-মেঘনা-মধুমতি, নৌকা ছাড়া নাইকো গতি’, আওয়ামী লীগে দিয়ো ভোট, বীর বাঙালী বাঁধো জোট’।
১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) একটি স্লোগান তোলে- ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব’। পরবর্তীতে স্লোগানটি এতটাই জনপ্রিয়তা পায় যে, দেশের যে কোন প্রান্তের যে কোন স্তরের নির্বাচনে স্লোগানটির ব্যবহার হতে দেখা গেছে। কিন্তু ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মানুষ সেই ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন এমন অভিযোগ দেশে বিদেশে সর্বত্র। সর্বশেষ ৫ জুন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের বার্ষিক ‘মানবাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিবেদন ২০১৮’- শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্য।
এদিকে গত ১ মার্চ ‘ভোটার হব, ভোট দেব’ স্লোগান নিয়ে প্রথমবারের মতো জাতীয় ভোটার দিবস পালন করে নির্বাচন কমিশন। ওই দিনই ওই স্লোগানকে ‘হাস্যকর’ হিসেবে উল্লেখ করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তিনি বলেন, ‘ভোটার যেখানে ভোট দিতে পারে না সেখানে আজকে স্লোগান হচ্ছে- ভোটার হোন, ভোট দিন।… এই সরকারই জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে এই দিবস পালন করে তামাশা সৃষ্টি করেছে। ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর কারচুপির অভিযোগ তুলে পুনর্নির্বাচন চেয়েছিল বিএনপি ও তাদের শরিকরা।
এ নির্বাচনে বিএনপি’র স্লোগান ছিল- ‘এগিয়ে যাব একসাথে, ভোট দেব ধানের শীষে’। আর আওয়ামী লীগের স্লোগান ছিল- ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে দলটির স্লোগান ছিল- ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’। বিগত দুই মেয়াদে সে পথে বাংলাদেশ এগিয়েছে অনেক দূর। সেই অর্জন প্রচারে দলটির নেতা-কর্মীরা এখন স্লোগান দিচ্ছেন- ‘শেখ হাসিনার অবদান, ডিজিটাল হল জীবন মান’; শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল সবাই করছে ভোগ’।
 ভারতের পানি আগ্রাসন ও স্লোগান
১৯৭৬ সালের ১৬ মে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে গঙ্গার পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে লংমার্চ অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সামাজিক সংগঠন। তখন তারা স্লোগান তোলেন- ‘চল চল ফারাক্কা চল’; ‘মরণ ফাঁদ ফারাক্কা, ভেঙ্গে দাও গুঁড়িয়ে দাও’; ‘পিন্ডিকে ছেড়েছি, দিল্লিকে ছাড়ব’। এসব স্লোগান এখনও চলছে এবং এর সঙ্গে আরও যুক্ত হয়েছে টিপাই নদী মুখে বাধ বিরোধী ও আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বিরোধী স্লোগান। যেমন: ‘ভারতের পানি আগ্রাসন রুখে দাঁড়াও’; ‘টিপাই বাধের পায়তারা বন্ধ কর’; ‘তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের পানি প্রত্যাহারের পায়তারা বন্ধ কর’; সুরমা-কুশিয়ারা রক্ষা কর’; আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প বাংলাদেশের মরণ ফাঁদ’; আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান’।
এছাড়া ২০১০ সালে সরকার ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানির সিদ্ধান্ত নিলে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টরা স্লোগান তোলেন- ‘উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্র বর্জন করুন, দেশীয় চলচ্চিত্র শিল্পকে রক্ষা করুন’; সাফটা চুক্তির দোহাই দিয়ে ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি চলবে না’; ‘ভারতীয় চলচ্চিত্র আমদানি আদেশ বাতিল কর’। যদিও সেই আদেশ আর বাতিল হয়নি। আদালতের আদেশে আমদানির সিদ্ধান্ত বলবৎ থাকে।
এদিকে ফুলবাড়ি কয়লা খনি বিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প বাতিলসহ তেল, গ্যাস ও বন্দর রক্ষার আন্দোলন চলছে। বন্ধ হয়নি সীমান্ত হত্যা। তাইতো চলছে স্লোগান- ‘সীমান্ত হত্যা বন্ধ কর’।
ইতিহাস ও স্লোগান
পাকিস্তান আন্দোলনের স্লোগান ছিল- ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। তবে রসিকতা করে বলা হতো – ‘হাতমে বিড়ি/ মুখমে পান, লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। ভাষা আন্দোলনের সাড়া জাগানো স্লোগান- ‘রাষ্ট্র ভাষা রাষ্ট্র ভাষা, বাংলা চাই বাংলা চাই’; ‘শহীদদের রক্ত, ‍বৃথা যেতে দেব না’। যদিও পরবর্তীতে নতুন নতুন শহীদদের নাম যুক্ত করে বিভিন্ন আন্দোলনে এই স্লোগানটি দেয়া হয়েছে।
১৯৪৭ সালে সিলেট পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হবে না আসামের সঙ্গে ভারতে থাকবে এই প্রশ্নে একটি রেফারেন্ডাম হয়েছিল। তখন যারা পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে ছিলেন তাদের মুখে স্লোগান ছিল- ‘আসামে আর যাব না, গুলি খেয়ে মরব না’; ‘আসামে আর থাকব না, মশার কামড় খাব না’। অপরদিকে ভারতের পক্ষের স্লোগান ছিল- ‘পূর্ব বঙ্গে যাব না, নালি শাক খাব না’।
এদিকে ষাটের দশকে আইউব খান সবুজ বিপ্লবের অংশ হিসেবে বাংলাদেশে ভুট্টা চাষকে উৎসাহিত করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তখন পাবনায় ভুট্টা খেয়ে কয়েকজন মারা গেছেন এমন একটি খবর প্রচার করা হয়। যার প্রতিবাদে স্লোগান ওঠে- ‘আমরা বাঙালী, ভুট্টা খাই না’; ‘বাংলায় ভুট্টা চাষ, চলবে না চলবে না’।
ওই ষাটের দশকের প্রথমার্ধেই মাওলানা ভাসানী আইউব খানের বিভিন্ন নীতি ও পদক্ষেপ সমর্থন করেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময়েও তিনি আইউবের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন ব্যক্ত করেন। সে সময়ে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ (ওয়ালী খান) স্লোগান তোলে- ‘আইউবের কোলে, ভাসানী দোলে’।
পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনে আওয়ামী লীগ স্লোগান তোলে- ‘তোমার দফা আমার দফা, ৬ দফা ৬ দফা’; ‘৬ দফা মানতে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে’। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৯ সালে ১১ দফা আন্দোলনে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ স্লোগান তোলে- ‘আইউব শাহী মোনায়েম শাহী, নিপাত যাক নিপাত যাক’; ‘আইউব-মোনায়েম ভাই ভাই এক দড়িতে ফাঁসি চাই’; ‘পূর্ব-পশ্চিমে একই আওয়াজ, খতম করো আইউবরাজ’; ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব’। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে স্লোগানগুলো পরিবর্তন হয়ে যায় যেমন- ‘জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি’; ‘তোমার নেতা আমার নেতা, শেখ মুজিব শেখ মুজিব, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের (বিএলএফ) প্রশিক্ষণ শিবির থেকে স্লোগান তোলা হয়- ‘বিশ্বে এলো নতুন বাদ, মুজিববাদ মুজিববাদ’। পরে ছাত্রলীগও (সিদ্দিকী) এই স্লোগানটি দেয় এবং সঙ্গে আরও যুক্ত করে- ‘অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, মুজিববাদে সমাধান’; ‘মার্কসবাদে লাথি মার, মুজিববাদ কায়েম কর’।
যদিও এর বিরুদ্ধে রব ও শাজাহান সিরাজরা স্লোগান তোলে- ‘মুজিববাদ, নবরূপে পুঁজিবাদ’; ‘মুজিববাদ বস্তায় ভর, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম কর’; ‘নতুন করে মশাল জ্বালো, মুজিববাদ পুড়িযে ফেলো’।
১৯৭৪ সালে স্লোগান ওঠে- ‘আট টাকা সের আটা, নৌকার তলি ফাটা’। এরই মাঝে পাকিস্তান পন্থীরা স্লোগান তোলে- ‘ভাত কাপড় বাসস্থান, নইলে আবার পাকিস্তান’; ‘আরেকবার অস্ত্র ধর, মুসলিম বাংলা কায়েম কর’।
জিয়াউর রহমান বিরোধী আন্দোলনে স্লোগান ছিল- ‘ধর্মের নামে রাজনীতি, চলবে না চলবে না’; ‘আইউব গেছে যে পথে, জিয়া যাবে সেই পথে’; ‘পাক-মার্কিন দালালেরা, হুশিয়ার সাবধান’। এর আগে স্লোগানটি ছিল- ‘রুশ-ভারতের দালালেরা, হুশিয়ার সাবধান’।
সাবেক সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে শত শত স্লোগানের মধ্যে যেকয়টি প্রধান হয়ে উঠেছিল তার মধ্যে দু’টি ছিল- ‘ধাক্কা মারো আরেকবার, জয় হবে জনতার’; ‘এক দফা এক দাবি, এরশাদ তুই কবে যাবি’। পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়া এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেও শেষের স্লোগানটি দিতে শোনা গেছে।
তবে ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ‘স্বৈরাচার নীপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক’ কথাটি বুকে-পিঠে লিখে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন নূর হোসেন। মূলত মুক্তিকামি ও গণতন্ত্রকামি মানুষের হৃদয়েই লেখা রয়েছে এই স্লোগানটি।
উল্লেখ্য, গত ১৪ জুলাই রবিবার সকাল পৌনে ৮টায় সাবেক ওই রাষ্ট্রপতি, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিল্লাহি … রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। গত ২৬ জুন থেকে তিনি রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন ছিলেন।

No comments

Powered by Blogger.