শামীম ঘুষ দিতো ডলারে by শুভ্র দেব

গণপূর্ত বিভাগের সকল টেন্ডারে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল টেন্ডার মুঘল জি কে শামীমের। মন্ত্রী থেকে শুরু করে সচিব, প্রধান প্রকৌশলীদের ম্যানেজ করেই তিনি টেন্ডার বাগাতেন। বিনিময়ে সংশ্লিষ্টদের পকেটে চলে যেত মোটা অঙ্কের ঘুষ। বিশেষ করে গণপূর্ত অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলীরা শামীমের কাছ থেকে নেয়া ঘুষে ফুলে-ফেঁপে উঠেছেন। গড়ে তুলেছেন জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল অর্থ-বৈভব। অনুসন্ধানে এমন তিনজন প্রধান প্রকৌশলীর নাম উঠে এসেছে যারা শামীমের কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছেন অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা। তারা হলেন, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, আব্দুল হাই ও হাফিজুর রহমান মুন্সী। তারা শামীমের খুব ঘনিষ্ট ছিলেন। অভিযোগ আছে, এই প্রকৌশলীরা ডলারে ঘুষ নিতেন। ঝক্কি-ঝামেলা এড়াতে ডলারেই ঘুষ দিতেন শামীমও। এসব ডলার দিয়ে তারা বিদেশের মাটিতে করেছেন বাড়ি। দেশের ভেতরেও রয়েছে তাদের নামে বেনামে অঢেল সম্পত্তি। এর বাইরে শামীম গণপূর্তের আরও বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের ঘুষ দিয়েছেন। র‌্যাবের কাছে আটকের পর এমন আলোচনা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তর এলাকায় চাউর আছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, টেন্ডারবাজ গোলাম কিবরিয়া শামীম, যুবলীগ দক্ষিণের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের ভয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরের ঠিকাদার থেকে শুরু করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও তটস্থ থাকতেন। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শামীমের দৌরাত্ম শুরু হয়। এর আগে সে শিক্ষা ভবন কেন্দ্রীক টেন্ডারবাজি করত। তখন তাকে শেল্টার দিত জিসান। প্রথম দিকে জিসানের ভয়ভীতি দেখিয়ে ছোটখাটো টেন্ডার ছিনিয়ে নিত। কিন্তু ধীরে ধীরে জিসানের ছত্রছায়ায় হয়ে উঠে বেপয়োয়া। জিসানের নির্দেশ ও তার ক্যাডার বাহিনীকে কাজে লাগিয়ে আধিপত্য বিস্তার করার চেষ্টা করে। এ কাজে সে সফলও হয়ে যায়। অস্ত্রের ভয়ভীতি দেখিয়ে সে তার উদ্দেশ্য হাসিল করে নিত। তার কাজে যদি কোনো ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্ট অফিসের কোনো কর্মকর্তা বাধা হয়ে দাঁড়াতেন তাকে বিদেশ থেকে জিসানই ফোন দিয়ে হত্যার হুমকি দিত। প্রাণের ভয়ে কেউ আর কথা বলত না। এভাবেই ধীরে ধীরে সে টেন্ডারবাজ শামীম হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। তবে ২০১৩ সালের পর যুবলীগ দক্ষিণের প্রভাবশালী নেতার ছত্রছায়ায় সে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে। এরপর থেকে তার আর পেছনে তাকাতে হয়নি। যুবলীগ দক্ষিণের ওই দুই নেতা ছাড়াও কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের নাম ভাঙ্গাত শামীম। নিজেকে কখনও যুবলীগ আবার কখনও আওয়ামী লীগ নেতা হিসাবে পরিচয় দিত।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শামীম গণপূর্তের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণের জন্য ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতা থেকে শুরু করে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নিয়ে বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিল। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরাই শামীমকে কাজ পাইয়ে দিতো। এজন্য অবস্থান বুঝে সবার জন্যই ঘুষের ব্যবস্থা থাকত। সূত্র জানিয়েছে, গণপূর্তের টেন্ডার যেন শামীমকে পাইয়ে দেবার জন্যই তৈরি করা হত। প্রধান প্রকৌশলী ও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা টেন্ডারের শর্তাবলী এমনভাবে তৈরি করতেন অনেক বড় ও অভিজ্ঞ ঠিকাদাররা শর্তাবলী পড়েই আনফিট হয়ে যেতেন। এভাবে দিনের পর দিন কাজ না পেয়ে দীর্ঘদিন ধরে ঠিকাদারি করা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন বন্ধ হওয়ার উপক্রম। অনেক ঠিকাদার গত কয়েক বছর ধরে কেনো কাজ পাননি। গতকাল সরজমিন পূর্ত অধিদপ্তরে গিয়ে একাধিক ঠিকাদারের সঙ্গে কথা বলে শামীমের দৌরাত্মের অনেক বিষয় উঠে এসেছে। এছাড়া ঠিকাদারদের দীর্ঘ দিনের ক্ষোভের বিষয়টিও প্রকাশ পায়। প্রায় দেড়শতাধিক নিবন্ধিত ঠিকাদারদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ গণপূর্ত ঠিকাদার এসোসিয়েশন। টেন্ডারবাজ শামীমের কারণে এখানকার অনেক ঠিকাদারের ব্যবসা বন্ধ হওয়ার উপক্রম। র‌্যাবের হাতে শামীম আটক হওয়ার খবরের পর এই ঠিকাদাররা এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। কাজ না থাকায় অনেক ঠিকাদারই এতদিন গণপূর্তের অফিসে আসেননি। কিন্তু গতকাল রোববার থেকে এসব ঠিকাদারদের আনাগোনা বেড়েছে। সবার মুখে এখন শুধু শামীমের নানা অপকর্মের কথা।

বাংলাদেশ কন্ট্রাক্টরস এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক এসএম শাহ আলম মানবজমিনকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে গণপূর্তের ঠিকাদারিতে একক নিয়ন্ত্রণ ছিল। এই সমিতিতে দেড় শতাধিক ঠিকাদার রয়েছেন। অথচ গণপূর্তের বড় কোনো টেন্ডার হলে কোনো ঠিকাদারই জানত না। বছরের পর বছর ধরে এখানকার ঠিকাদাররা বেকার সময় কাটাচ্ছে। প্রধান প্রকৌশলী ও আরও কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যোগসাজশ করে জি কে বিপিএলের শামীম ও তার ঘনিষ্টরা সব কাজ ভাগিয়ে নিত। এমনকি ছোট ছোট কাজও প্যাকেজ তৈরি করে বড় অংকের টেন্ডার বানিয়ে শামীম নিয়ে যেত। পরে সেগুলো ভাগ করে তার ঘনিষ্টদের দিত। এসবের পেছনে মোটা অংকের ঘুষ লেনদেন হতো। শামীমের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে সাবেক কয়েকজন প্রধান প্রকৌশলী হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। তারা দেশে বিদেশে বাড়ি কিনেছেন। তিনি বলেন, কয়েক বছর ধরে গণপূর্তের টেন্ডারের দরপত্র আহবানের ক্ষেত্রে কিছু শর্তাবলী যোগ করে দিতো যাতে করে শামীমের প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করতে না পারে।

গণপূর্তের একাধিক নিবন্ধিত ঠিকাদার মানবজমিনকে বলেন, গণপূর্তে প্রধান প্রকৌশলী হিসাবে গত কয়েক বছর ধরে যারাই আসছেন তারা তাদের আত্মীয় স্বজন ঠিকাদারদেরকে কাজ পাইয়ে দিচ্ছেন। ছোটখাটো কাজ পাওয়ার আশা নাই। শামীম ঠিকাদারদের অফিসে কখনই আসেনি। অথচ ২০০৯ সাল থেকে সে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণে আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। যুবলীগের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম ও দলের নাম ভাঙ্গিয়ে সে কাজ ভাগাচ্ছে। বিনিময়ে ওই নেতাদেরকে দিচ্ছে বড় অংকের টাকা। যখন কোনো কিছুতেই কাজ হয়না তখন সে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে দিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ফোন করায়। জিসান ফোন দিয়ে বলে দিলে আর কোনো কাজ আটকায় না। তিনি বলেন, টেন্ডারবাজিতে শামীম যে কত হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে তার হিসাব নাই। ঢাকা শহরের কত জায়গায় যে তার ভবন, প্লট, ফ্ল্যাট আছে। নন্দী পাড়া ও আশে পাশের এলাকায় শত বিঘা জমি আছে।

বালিশকাণ্ডে শামীম: রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের জন্য তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রিন সিটি আবাসন পল্লী নির্মাণ করা হচ্ছে। এখানে ২০ তলা ও ১৬ তলার মোট ২০টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। এসব ভবনের নির্মানের কাজের নিয়ন্ত্রণ ছিল শামীমের হাতে। বেশ কিছু কাজ তিনি নিজে করেছেন। অভিযোগ আছে কমিশন নিয়ে কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে এসব ভবনের বেশ কিছু কাজ পাইয়ে দিয়েছেন শামীম। আর কাজ পাইয়ে দেয়ার জন্য সাবেক এক মন্ত্রী, একজন সচিব, সাবেক এক প্রধান প্রকৌশলী ও গণপূর্তের আরেক প্রকৌশলীকে দিয়েছেন মোট টেন্ডার মূল্যের তিন শতাংশ টাকা। এছাড়া তার সিণ্ডিকেটের প্রভাবশালী নেতাদেরকে আরও কিছু কমিশন দিয়েছেন।

সূত্র বলছে, কাজ ভাগিয়ে নিয়ে শামীম কমিশনের ভিত্তিতে অন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেন। কিছু কাজ তিনি নিজেই করেছেন। বিশেষকরে নির্মিত ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহের কাজটি শামীম নিজেই করেছেন। এদিকে আবাসিক ভবনে আসবাবপত্র সরবরাহে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল কয়েকমাস আগে। আসবাবপত্র কেনা থেকে শুরু করে ভবনের উপরে উঠানো পর্যন্ত কয়েকগুন খরচ বেশি দেখানো হয়েছিলো। পত্রিকায় এধরনের রিপোর্ট প্রকাশ হওয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। তোপের মুখে পড়ে সংশ্লিষ্টরা। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব ও পূর্ত অধিদপ্তরের একজন অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে দুটি কমিটি গঠন করা হয়। দুই কমিটিই ঘটনার তদন্ত করে সত্যতা পায়। কমিটি এ ঘটনায় ৩৪ জনকে দায়ী করে। ৩৬ কোটি ৪০ লাখ টাকার গড়মিল পায়। তদন্ত কমিঠির প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানই এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

টাকা পাচার হতো বিদেশে: এদিকে রিমাণ্ডে ডিবি কর্মকর্তাদের কাছে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া জানিয়েছেন ক্যাসিনো, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজির টাকা পাঠাতেন বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের কাছে। এই তিনটি ক্ষেত্রেই জিসানের সম্পৃক্ততা ছিল। তাই এসব ক্ষেত্র থেকে আসা টাকার একটি অংশ প্রথমে মধ্যেপাচ্যের একটি দেশের ব্যাংকে পাঠানো হত। সেখানে এই টাকা রিসিভ করত পলাতক আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাদিম। পরে সেই টাকা পৌঁছে যেত জার্মানিতে থাকা জিসানের কাছে।

No comments

Powered by Blogger.