ভারতে মুসলিম নারীরা জনসংখ্যা ৬.৯ ভাগ, লোকসভায় ০.৭ ভাগ by নমিতা ভান্ডার

তিনি যদিও তার গ্রামের প্রধান, কিন্তু ২২ জনের বিশাল পরিবারের জন্য রুটি বানানো এখনো তার দায়িত্ব।
হরিয়ানার নুহ জেলার হোসাইনপুর গ্রামে মাটির ছোট্ট চুলায় রুটি বানানোর সময় ফারহুনাকে তার বিয়ে আর নির্বাচন নিয়ে জিজ্ঞাসা করতেই হাসলেন।
তা ছিল ২০১৬ সালের ঘটনা। তখন পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘনিয়ে আসছিল। হরিয়ানা সরকার প্রার্থী হওয়ার নতুন নিয়ম ঘোষণা করেছিল। এ অনুযায়ী, নারী প্রার্থীকে অন্তত অষ্টম শ্রেণি পাস হতে হবে, আর পুরুষ প্রার্থীকে হতে হবে ম্যাট্রিক পাস।
ওই বছর হোসেনপুরের আসনটি নারীদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সমস্যা হলো, তার স্বামীর পরিবারের কোনো নারীই কখনো স্কুলে যায়নি।
ফলে ফারহুনার শ্বশুর যখন ছেলের জন্য বউ খুঁজছিলেন তখন শিক্ষার দিকে নজর দিলেন। ফারহুনা বলেন, তিনি এমনকি যৌতুক পর্যন্ত নেননি। তিনি তার বিএ ডিগ্রির জন্য গর্বিত।
বিশাল পরিবারটির জন্য রুটির দরকার কম হয় না। বিকেলে দরকার হয় ৭০টি, আর রাতেও একই সংখ্যক।
রুটি বানানো আর ছয় মাস বয়সী মেয়ের পরিচর্যা করতে করতেই তার সময় চলে যায়। পঞ্চায়েতের সভায় যোগ দেয়ার সময় খুব একটা পাওয়া যায় না।
তাছাড়া তার দুই ননদের বিয়েও ঘনিয়ে আসছে। এ কারণে তাদের দোতলা বাড়িতে ঘসামাজার কাজ চলছে। ফলে দম ফেলার অবকাশ নেই।
কিন্তু তারপরও ফারহুনা সভায় যোগ দেন, এলাকার নানা সমস্যা সমধানে তাকে কাজ করতেই হয়।
প্রতিটি স্তরে নিম্ন রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব একটি সমস্যা। বর্তমানে ভারতীয় লোকসভায় ৫৪৩ জন সদস্যের মধ্যে মুসলিম নারী মাত্র চারজন। অর্থাৎ মুসলিম নারীরা ০.৭ ভাগ। অথচ জনসংখ্যায় দিক থেকে তারা ৬.৯ ভাগ।
আর্টস গ্রাজুয়েট ফারহুনা তার ২২ সদস্যের পরিবারের জন্য রুটি বানাচ্ছেন
স্বাধীনতার পর ভারতের ১৬টি লোকসভার মধ্যে ৫টিতে কোনো মুসলিম নারী ছিল না। আর তাদের আসন সংখ্যা কখনো চারটির বেশি হয়নি।
ভারতে রয়েছে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৪টি আসন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে এ তথ্য জানিয়েছেন মাইঙ্ক মিশ্র, কুইন্টে। এছাড়া ১৩টি আসনে মুসলিমরা ৪০ ভাগের বেশি। মোট ১০১টি আসনে মুসলিমরা জনসংখ্যার ২০ ভাগের বেশি।
২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মুসলিমরা জনসংখ্যার ১৪.৩ ভাগ। কিন্তু ৫৪৩ আসনবিশিষ্ট লোকসভায় তাদের সদস্য সংখ্যা মাত্র ২২ অর্থাৎ বর্তমান লোকসভায় তাদের প্রতিনিধিত্বের হার মাত্র ৪ ভাগ।
এর একটি কারণ হলো মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলো মুসলিম প্রার্থী দিতে অনীহ থাকে। ২০০৯ সালে মাত্র ৩০ জন ছিলেন মুসলিম। ওই বছর মোট মুসলিম প্রার্থী ছিলেন ৮৩২ জন। এদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক (৪৭.১২ ভাগ) ছিলেন স্বতন্ত্র।
২০১৪ সালে অবস্থার উন্নতি ঘটেনি। ওইসময় ৩,২৪৫ জন প্রার্থীর মধ্যে মুসলিম ছিলেন ৩২০ জন (৯.৮ ভাগ)। বিজেপি ৪৬২ জন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র ২৭ জন মুসলিম (৬ ভাগের চেয়ে কম) প্রার্থী দিয়েছিল। ২০০৯ সালে ছিল ৩১ জন।
অমুসলিম দলগুলোর মধ্যে কেবল সমাজবাদী পার্টি (এসপি), রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) ও কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী) ১৫ ভাগের বেশি মুসলিম প্রার্থী দিয়েছে। এটা ছিল যথাক্রমে ১৮.৪ ভাগ, ২০.৭ ভাগ ও ১৫ ভাগ।
কিন্তু মুসলিম নারীরা আরো বেশি বঞ্চনায় রয়েছেন। একদিকে মুসলিম, অন্য দিকে নারী, উভয় দিক থেকেই তিনি বঞ্চিত হন। অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিজ্ঞানের অধ্যাপক গিলেস ভারনিয়ার বলেন, সব নারীই বঞ্চনার শিকার হন। মুসলিম নারীরা আরো বেশি।
জওহেরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক জয়া হাসান বলেন, স্বাধীনতার সময় থেকেই মুসলিম নারীদের অংশগ্রহণ ছিল কম। এরপর পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে। ডানপন্থী প্রধান দলটি রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্ব থেকে মুসলিমদেরকে বর্জন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা কয়েকজন মুসলিম প্রার্থী দিলেও তা হয় আরো কম সংখ্যায়।
এবারের লোকসভার নির্বাচনে এখন পর্যন্ত ঘোষিত আসনগুলোর মধ্যে বিজেপি মাত্র একজন নারী প্রার্থী দিয়েছে। মাফুজা খাতুন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পশ্চিমবঙ্গের জঙ্গিপুর থেকে।
হরিয়ানার নুহ জেলায় জয়সিংহপুর গ্রামে পেহলু খানের কবর
চলমান লোকসভার শুরুতে মুসলিম এমপি ছিলেন মাত্র দুজন। এদের একজন হলেন মমতাজ সঙ্ঘমিতা (চিকিৎসক, তৃণমূল থেকে প্রথমবারের মতো এমপি হয়েছেন) ও মওসুম নূর (কংগ্রেস থেকে দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচিত এমপি, মালদহ থেকে)। অপর দুজন উপনির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। ২০১৮ সালে। এদের একজন হলেন উত্তর প্রদেশ থেকে বহুজন সমাজ পার্টি থেকে নির্বাচিত তাবাসসুম হাসান (তিনি ২০০৯ সালেও এমপি হয়েছিলেন) ও তৃণমূল থেকে নির্বাচিত সাজদা আহমদ।
প্রাথমিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৃণমূলে এবার প্রথম ধাপে যে ১,২৭৯ জন মুসলিম নারী প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছিল, তাদের মধ্যে ১১১ জন ছিলেন নারী। তবে এদের মাত্র দুজন ছিলেন মুসলিম।
এবার কিন্তু মুসলিম নারীদের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিন তালাকের মতো বিষয় নিয়ে বেশ উত্তপ্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইস্যুটি তাদের হলেও তাদের কথা পার্লামেন্টে সংখ্যার অনুপাতে শোনা যায় না।
এছাড়া গোরক্ষকদের হাতে নির্মমভাবে খুনের শিকার হওয়ার ঘটনাগুলোও মুসলিম নারীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে আলোড়িত করে।
মুম্বাইভিত্তিক ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলনের (বিএমএমএ) জুবাইদা খাতুন বলেন, যারা আমাদের পক্ষে কথা বলার দাবি করে, তাদের আমাদের সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই। ইসলামে নারীদের কী অধিকার দিয়েছে, সে সম্পর্কেও তাদের জানাশোনা নেই।
তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে মুসলিমদের যেভাবে টার্গেট করা হচ্ছে, তাতেও মুসলিম নারীরা উদ্বিগ্ন। দিল্লির জামিয়া নগরের সংকীর্ণ লেনে একদল নারী ভয়ের পরিবেশের কথা বলছিলেন। ২০১৭ সালের জুনে দিল্লি-মাথুরা ট্রেনে জুনায়েদ নিহত হওয়ার পর থেকেই তারা আতঙ্কে রয়েছেন। সারিনা বেগম বলেন, তিনি তার তিন ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ভয়ে আছেন। তারা নিরাপদে বাসায় না ফেরা পর্যন্ত তিনি ঘুমাতে পর্যন্ত পারেন না।
৭৫ বছরের উপরে বয়সী জমিলা (ডানে) এখনো বাড়ির গো-মহিষ দেখভাল করেন
তিনি বলেন, যদি আপনার দাড়ি থাকে, কুর্তা পাজামা পরেন, একটি বিশেষ ধরনের দেখা যায়, তবে আপনি রাস্তায় টার্গেট হবেন। তিনি বলেন, রাস্তায় বের হলে আমি যাতে বোরকা না পরি, সেজন্য আমার স্বামী আমাকে বলেন।
এই নির্বাচনে কী চান, এই প্রশ্নের জবাবে একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে সহকারী হিসেবে কর্মরত রাজনীতি বিজ্ঞানের গ্রাজুয়েট জুবাইরা বলেন, তিনি চান শান্তি। এই নির্বাচনে এটুকুই তার চাওয়া।
গাজিয়াবাদের জাট সম্প্রদায় পরিবেষ্টিত থাকলেও এত দিন আয়েশা কখনো নিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন না। কিন্তু এখন তিনি সবসময় উদ্বেগে থাকেন, বাড়ি থেকে বের হতেই ভয় পান। তিনি জানান, যেকোনো সময় টার্গেট হতে পারেন বলে ভয় পান।
মুসলিম নারীরা এখন টিকে থাকার লড়াইয়ে নিয়োজিত। আর এ কারণেই তারা নির্বাচনকে বেশ গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছেন। আয়েশা বলেন, কংগ্রেস যে খুব ভালো তা নয়। কিন্তু ওই সময় অন্তত আমাদের প্রতি ঘৃণা করা হতো না। তিনি বলেন, তার একমাত্র লক্ষ্য হলো বিজেপিকে হারিয়ে দেয়া।
>>>লেখক: দিল্লিভিত্তিক সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.