বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পালকি থেকে রাজহংস by চৌধুরী আকবর হোসেন

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে ১৪ সেপ্টেম্বর যুক্ত হলো আরেকটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। এ নিয়ে রাষ্ট্রীয় এই সংস্থার উড়োজাহাজ হলো ১০টি। অর্ডার করার পর একে একে এগুলো পেতে প্রায় ১১ বছর লেগে গেলো।

২০০৮ সালে মার্কিন আকাশযান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের সঙ্গে ২১০ কোটি মার্কিন ডলারে তিনটি মডেলের ১০টি নতুন উড়োজাহাজ কেনার চুক্তি করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। এর মধ্যে চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর, দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ ও চারটি বোয়িং ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ অর্ডার দেওয়া হয়।

অন্যান্য যানবাহনের মতো উড়োজাহাজেরও নিবন্ধন করতে হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বাংলাদেশি সব এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ ও হেলিকপ্টার স্বতন্ত্র রেজিস্ট্রেশন নম্বর প্রদান করে। নিবন্ধন নম্বর অনুযায়ী বিশ্বজুড়ে উড়োজাহাজকে আলাদাভাবে চেনা যায়।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজগুলোর অবশ্য আলাদা নামকরণও হয়েছে। এটি ব্যতিক্রম একটি দিক। তবে দীর্ঘ বা স্বল্পমেয়াদে ভাড়া করে আনা আকাশযানের বেলায় আলাদা নাম রাখা হয় না।

উড়োজাহাজের নামকরণের ক্ষেত্রে প্রথমে বিমানের কর্মীদের কাছ থেকে নাম চাওয়া হয়। সেগুলোর প্রাথমিক তালিকা তৈরির পর চূড়ান্ত করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কার্যালয়ে পাঠানো হয়। তার পছন্দে ১০টি বিমানের রাখা হয়। এগুলো হলো পালকি, অরুণ আলো, আকাশ প্রদীপ, রাঙা প্রভাত, মেঘদূত, ময়ূরপঙ্খী, আকাশবীণা, হংসবলাকা, গাঙচিল ও রাজহংস।

পালকি (এস২-এএফও)
তিনটি মডেলের মধ্যে প্রথমেই ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজগুলো সরবরাহ শুরু করে বোয়িং। ২০০৮ সালে ক্রয় আদেশ দেওয়ার পর ২০১১ সালের ২১ অক্টোবর একটি ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ প্রথম বিমান বহরে যুক্ত হয়। এর নাম ‘পালকি’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএফও। ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২২। এতে ৩৫টি বিজনেস ক্লাস ও ৩৮৪টি ইকোনমি আসন রয়েছে। এছাড়া আছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন (জিই৯০-১১৫বি)। উড়োজাহাজটি বর্তমানে ঢাকা-জেদ্দা রুটে বাণিজ্যিক ফ্লাইটে ব্যবহার হচ্ছে।

অরুণ আলো (এস২-এএফপি)
২০১১ সালের ২৩ নভেম্বর বিমানকে আরেকটি ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ সরবরাহ করে বোয়িং। এর নাম রাখা হয় ‘অরুণ আলো’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএফপি। ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২৩। এটি বর্তমানে চট্টগ্রাম-মদিনা, ঢাকা-মদিনা ও ঢাকা জেদ্দা রুটে ব্যবহার হচ্ছে। এই উড়োজাহাজে রয়েছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন (জিই৯০-১১৫বি)। এতে আছে ৩৫টি বিজনেস ক্লাস ও ৩৮৪টি ইকোনমি আসন।

আকাশ প্রদীপ (এস২-এএইচএম)
২০১১ সালে দুটি ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ পাওয়ার পর আবারও দীর্ঘ অপেক্ষা। এরপর ২০১৪ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি আরেকটি ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ সরবরাহ করে বোয়িং। এর নাম রাখা হয় ‘আকাশ প্রদীপ’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইচএম। ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২০। এতে রয়েছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন (জিই৯০-১১৫বি)। উড়োজাহাজটি বর্তমানে ঢাকা-জেদ্দা রুটে ব্যবহার হচ্ছে।

রাঙা প্রভাত (এস২-এএইচএন)
বিমান চারটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ অর্ডার করেছিল। এই্ সিরিজের সবশেষ উড়োজাহাজ বহরে যুক্ত হয় ২০১৮ সালের ২১ মার্চ। এর নাম রাখা হয় ‘রাঙা প্রভাত’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইচএন। ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২১। এটি বিমান বহরের চতুর্থ ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজ। এতে রয়েছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন (জিই৯০-১১৫বি)। উড়োজাহাজটি বর্তমানে ঢাকা-লন্ডন ও ঢাকা-জেদ্দা রুটে ব্যবহার হচ্ছে।

মেঘদূত (এস২-এএইচও)
চারটি ৭৭৭-৩০০ ইআর আকাশযান পাঠানো শেষে বিমানকে ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ সরবরাহ শুরু করে বোয়িং। অর্ডার দেওয়া দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজের প্রথমটি বিমান বহরে আসে ২০১৫ সালের ২৪ নভেম্বর। এর নাম রাখা হয় ‘মেঘদূত’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইচও, ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০৩৩৪। বিমানের দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজের বিজনেস ক্লাস ১২টি ও ইকোনমি আসন ১৫০টি। এতে আছে আমেরিকা ও ফ্রান্সের দুটি প্রতিষ্ঠানের যৌথ মালিকানাধীন সিএফএম ইন্টারন্যাশনালের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন (সিএফএম ৫৬-৭বিই)। উড়োজাহাজটি বর্তমানে ঢাকা-দিল্লি, ঢাকা-চট্টগ্রাম-মাস্কাট, ঢাকা-কলকাতা, ঢাকা-ব্যাংকক ও ঢাকা-সিলেট রুটে ব্যবহার হচ্ছে।

ময়ূরপঙ্খী (এস২-এএইচভি)
দ্বিতীয় বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ বিমান বহরে যুক্ত হয় ২০১৫ সালের ২২ ডিসেম্বর। এর নাম রাখা হয় ‘ময়ূরপঙ্খী’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এএইচভি, ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০৩৩৫। এতেও রয়েছে সিএফএম ইন্টারন্যাশনালের তৈরি টার্বোফ্যান ইঞ্জিন (সিএফএম ৫৬-৭বিই)। উড়োজাহাজটি বর্তমানে ঢাকা-সিঙ্গাপুর, ঢাকা-ব্যাংকক ও ঢাকা-সিলেট রুটে ব্যবহার হচ্ছে।

আকাশবীণা (এস২-এজেএস)
চারটি ৭৭৭-৩০০ ইআর ও দুটি বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজ পাওয়ার পর ফের দীর্ঘ অপেক্ষা। প্রায় আড়াই বছর পর ২০১৮ সালে ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার সরবরাহ শুরু করে বোয়িং। ওই বছরের ১৯ আগস্ট দেশে আসে প্রথম ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার। এর নাম রাখা হয় ‘আকাশবীণা’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এজেএস, ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২৬। ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ‘আকাশবীণা’ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই দিন বিমানটির প্রথম বাণিজ্যিক ফ্লাইট ঢাকা থেকে মালয়েশিয়ার উদ্দেশে ছেড়ে যায়। এতে বিজনেস ক্লাস ২৪টি ও ইকোনমি আসন ২৪৭টি। এছাড়া আছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি জেট ইঞ্জিন (জিইএনএক্স-১বি৬৭)। ইঞ্জিনটির ফ্লন্ট ফ্যান কেস ও ফ্যান ব্লেড কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। ‘আকাশবীণা’ বর্তমানে ঢাকা-সিলেট-লন্ডন, ঢাকা-দাম্মাম, ঢাকা-লন্ডন ও ঢাকা-দোহা রুটে ব্যবহার হচ্ছে।

হংসবলাকা (এস২-এজেটি)
বিমানের দ্বিতীয় ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার ঢাকায় এসে পৌঁছায় ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর রাতে। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটল শহরের এভারেট থেকে কোনও যাত্রাবিরতি ছাড়াই টানা ১৫ ঘণ্টা এটি উড়িয়ে নিয়ে আসেন পাইলট স্মল স্কি, মো. আমিনুল, শোয়েব চৌধুরী ও ফার্স্ট অফিসার আনিতা রহমান। এর নাম রাখা হয় ‘হংসবলাকা’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এজেটি, ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২৭। গত বছরের ৫ ডিসেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিভিআইপি টার্মিনালে ‘হংসবলাকা’ উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এতে বিজনেস ক্লাসের সংখ্যা ২৪টি, ইকোনমি আসন ২৪৭টি। এছাড়া আছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি জেট ইঞ্জিন (জিইএনএক্স-১বি৬৭)। ইঞ্জিনটির ফ্লন্ট ফ্যান কেস ও ফ্যান ব্লেড কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি।

গাঙচিল (এস২-এজেভি)
জাতীয় পতাকাবাহী সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের বহরে তৃতীয় ৭৮৭-৮ ড্রিমলাইনার যুক্ত হয় এ বছরের ২৫ জুলাই। দেশে পৌঁছার পর এটিকে ওয়াটার স্যালুটের মাধ্যমে স্বাগত জানানো হয়। এর নাম রাখা হয় ‘গাঙচিল’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এজেভি, ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২৫। গত ২২ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘গাঙচিল’ উদ্বোধন করেন। একই দিন বিকালে ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে আবুধাবি যাওয়ার মধ্য দিয়ে উড়োজাহাজটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়। এতে বিজনেস ক্লাস ২৪টি ও ইকোনমি আসন ২৪৭টি। এছাড়া আছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি জেট ইঞ্জিন (জিইএনএক্স-১বি৬৭)। ইঞ্জিনটির ফ্লন্ট ফ্যান কেস ও ফ্যান ব্লেড কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি। এটি ঢাকা-কুয়েত, ঢাকা-আবুধাবি ও ঢাকা-চট্টগ্রাম-দোহা রুটে ব্যবহার হচ্ছে।

রাজহংস (এস২-এজেইউ)
২০০৮ সালে ক্রয় চুক্তির সবশেষ উড়োজাহাজ দেশে এসেছে গত ১৪ সেপ্টেম্বর। এর নাম রাখা হয়েছে ‘রাজহংস’। রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এজেইউ, ম্যানুফ্যাকচারার সিরিয়াল নম্বর (এমএসএন) ৪০১২৪। এতে বিজনেস ক্লাস ২৪টি ও ইকোনমি আসন ২৪৭টি। এতে রয়েছে জেনারেল ইলেক্ট্রিকের তৈরি জেট ইঞ্জিন (জিইএনএক্স-১বি৬৭)। ইঞ্জিনটির ফ্লন্ট ফ্যান কেস ও ফ্যান ব্লেড কার্বন ফাইবার দিয়ে তৈরি।

বিমানের চারটি ড্রিমলাইনার টানা ১৬ ঘণ্টা উড়তে সক্ষম। উড়োজাহাজগুলো নিয়ন্ত্রণ হয় ইলেক্ট্রিক ফ্লাইট সিস্টেমে। কম্পোজিট ম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি হওয়ায় এগুলো ওজনে হালকা। ভূমি থেকে বিমানগুলোর উচ্চতা ৫৬ ফুট। দুটি পাখার আয়তন ১৯৭ ফুট। এর মোট ওজন ১ লাখ ১৭ হাজার ৬১৭ কিলোগ্রাম, যা ২৯টি হাতির সমান! এগুলোর প্রতিটির ককপিট থেকে টেল (লেজ) পর্যন্ত ২৩ লাখ যন্ত্রাংশ রয়েছে।

No comments

Powered by Blogger.